চীন-যুক্তরাষ্ট্র, ৭০ বছরের বিরোধের ইতিহাস

ইয়াসিন আরাফাত 
আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২১, ১২: ৫৬
Thumbnail image

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ হঠাৎ করেই যেন গোটা বিশ্বে নব্বইয়ের দশকের স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তপ্ত বাক্য, চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে বেইজিংয়ের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা এবং এসবকে কেন্দ্র করে দুই বাণিজ্যশক্তির দ্বৈরথ একেবারে নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠেছিল। বরাবরের মেতোই জারি ছিল ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি। কথা হলো চীন-যুক্তরাষ্ট্র এমন উত্তেজনা কি হঠাৎ করেই জন্ম নিল? এটা কি শুধুই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনের দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণেই হচ্ছে? নাকি এর মূল আরও অনেক দূর বিস্তৃত?

‘এমপ্রেস অব চায়না’ নামের জাহাজটি যখন চীনের ক্যান্টনে (বর্তমার গুয়াংঝু) পৌঁছায়, তখন আগস্ট মাস। এই ক্যান্টনই তখন পশ্চিমের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের ভরকেন্দ্র। সেই ১৭৬০ সাল থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে যাবতীয় বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষায় এই বন্দরের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। সে যা-ই হোক, ১৭৮৪ সালের আগস্টে এই ক্যান্টনে ভেড়া ‘এমপ্রেস অব চায়না’ জাহাজে চড়ে শুধু পণ্যই এল না, এলেন চীনে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের পাঠানো অনানুষ্ঠানিক প্রতিনিধি (কনসাল) স্যামুয়েল শ। মার্কিন কংগ্রেস নিযুক্ত হলেও তিনি কিন্তু চীনের তৎকালীন কর্তৃপক্ষকে নিজের কাজ ও আগমন কোনো কিছু সম্পর্কেই কিছু জানালেন না। কূটনৈতিক তথ্য দেওয়া বা না দেওয়ার সূত্রটি তাই বলা যায় অনেক পুরোনো। আজকে যে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এক দেশে আরেক দেশের বিরুদ্ধে তোলে, তার মূলটি বহু বছর আগেই প্রোথিত ছিল বলা যায়।

আধুনিক সময়ের কথা বললে এই দুই দেশের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে ৭২ বছর আগে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাকালে। লাখো কৃষকের আশার বাতি হয়ে মাও সে তুংয়ের চীনের জন্মের সময়েই রোপিত হয়েছিল চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধের বীজ। নানা সময়ে এর মাত্রা বেড়েছে-কমেছে। ট্রাম্প জমানায় এই উত্তেজনা এতটাই বেড়েছিল যে, মানুষের মনে এমনকি সত্যিকারের যুদ্ধের আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার পর এই উত্তেজনায় ভাটা পড়ার আশা দেখেছিল মানুষ। কিন্তু তা হয়নি। এই না হওয়ার পেছনে বিরোধের দীর্ঘ ইতিহাস যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি ও এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের নানা সমীকরণ।

অক্টোবর, ১৯৪৯

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা হয়

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সেতুং ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী সরকার চিয়াং কেই শেককে পরাজিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা করে। তখন চিয়াং এবং তার অনুগামী হাজার হাজার সেনা তখন তাইওয়ানে পালিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র চীনের জাতীয়তাবাদে সমর্থন দিয়েছিল এবং তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে লড়েছিল। চিয়াংকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরও তাকে সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মূলত তখন থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ চলছে।

জুন, ১৯৫০

কোরিয়া যুদ্ধ (১৯৫০), সংগৃহীতকোরিয়ায় শুরু হয় যুদ্ধ

১৯৫০ সালের ২৫ জুন; তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ করে। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ নেয়। চীন সমাজতন্ত্রে আস্থা রাখায় উত্তর কোরিয়ার পক্ষ নেয়। ওই যুদ্ধে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। জাতিসংঘ, চীন ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৫৩ সালে যুদ্ধটি শেষ হয়।

আগস্ট, ১৯৫৪

তাইওয়ান প্রণালী , সংগৃহীততাইওয়ান প্রণালী নিয়ে প্রথম সংকট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার ১৯৫৪ সালে তাইওয়ানের ওপর থেকে মার্কিন নৌবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। একই বছরের আগস্টে চিয়াং কাইন তাইওয়ান প্রণালীতে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করে। তখন চীনের সেনারা হামলা চালিয়ে চিয়াং কাইনের বাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পরে ওয়াশিংটন চিয়াংইয়ের জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৫৫ সালের বসন্তে যুক্তরাষ্ট্র চীনে পরমাণু হামলার হুমকি দেয়। ওই বছরের এপ্রিলে চীন আলোচনায় বসতে রাজি হয়। তবে দাচেন দ্বীপ জয়ের মাধ্যমে চীন তখন সীমিত পরিসরে নিজেদের জয়ী দাবি করে। এই সংকট ১৯৫৬ ও ১৯৯৬ সালেও দেখা দিয়েছিল।

১৯৫৯ সালের তিব্বত বিদ্রোহ

তিব্বত দখলের নয় বছর পর তিব্বতে চীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। তিব্বতের লাসা থেকে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। চীনা বাহিনীর হাতে তখন হাজার হাজার তিব্বতি নিহত হয় এবং দালাই লামা বাধ্য হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য চীনের এমন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০-এর দশকে তিব্বতে চীনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ হয়েছিল, তাতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সমর্থন ছিল।

পরমাণু শক্তিধর দেশের তালিকায় চীনের প্রবেশ

চীন প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়১৯৬৪ সালে, যখন ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ চলছিল। সে সময় চীন সীমান্ত এলাকায় ভিয়েতনামের সেনাদের সাহায্য করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

পিংপং কূটনীতি

১৯৭১ সালে চীনের আমন্ত্রণে মার্কিন টেবিল টেনিস (পিংপং) দল চীন সফর করে। এ জন্য এর নামকরণ হয় পিংপং কূটনীতি। ‘পিং পংকূটনীতি’ চীন-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে। ১৯৬৪ সালে স্নায়ুযুদ্ধের কালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। কৌশলগত মিত্র পাকিস্তানের স্বার্থ বিবেচনায় ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কৌশল নেয়। ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার চীনে গোপন সফরে আসেন। এরপরই চীনকে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

Richard_M._Nixon

নিক্সনের চীন সফর

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭২ সালে চীন সফর করেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নিক্সন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সাংহাই কমিউনিক চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে জটিল ইস্যুতে আলোচনা করতে রাজি হয় দুই দেশ। তবে ওই দশকের বেশির ভাগ সময় এ সম্পর্কের উন্নয়ন ধীর গতিতে চলেছে।

‘এক চীন’ নীতিতে মার্কিন স্বীকৃতি

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রশাসন ১৯৭৯ সালে চীনের কূটনীতিকে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমেই ‘এক চীন’ নীতিতে মার্কিন স্বীকৃতি মেলে। চীনের তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী ডেং জিয়াওপিং যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এপ্রিলে মার্কিন কংগ্রেস তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্টে অনুমোদন দেয়। এর মাধ্যমে তাইওয়ান-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক শুরু হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী তাইপেতে অস্ত্র সরবরাহ করার কথা ছিল ওয়াশিংটনের। তবে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক চীন’ নীতির লঙ্ঘন করেনি। 

রিগান যুগ

প্রেসিডেন্ট পদে রোনাল্ড রিগান আসার পর তার প্রশাসন তাইওয়ানকে ছয়টি বিষয়ে আশ্বস্ত করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাইওয়ান ইস্যুতে হস্তক্ষেপ না করার আশ্বাস। তবে কবে নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। একই সময়ে চীনের সঙ্গে হওয়া চুক্তিতে এক চীন নীতির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পরোক্ষে বড় ভূমিকা রেখেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ। রিগান ১৯৮৪ সালে চীন সফর করেন। সে সময়ই যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন অস্ত্র কেনার অনুমতি পায়।

তিয়েনআনমেন গণহত্যা , সূত্র এনবিসি নিউজতিয়েনআনমেন গণহত্যা

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ১৯৮৯ সালে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। তখন চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্বও ভীষণভাবে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী অ্যাসল্ট রাইফেল ও ট্যাংক ব্যবহার করে। এ হত্যাযজ্ঞ তিয়েনআনমেন স্কয়ার গণহত্যা বা ৪ জুন গণহত্যা নামে পরিচিত। এই গণহত্যার পর চীনের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয় চীন।

লি তেং-হুই, তাইওয়ানের প্রথম প্রেসিডেন্ট, সূত্র- রয়টার্সতাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

তাইওয়ানে ১৯৯৬ সালের মার্চে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, যেখানে জয় পান লি তেং-হুই। তাকে হংকংয়ের 'গণতন্ত্রের জনক বলা হয়। তাইওয়ানের ভোটারদের গণতন্ত্রপন্থী প্রার্থীকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখতে চীন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। নির্বাচিত হওয়ার এক বছর আগে লি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে ওয়াশিংটনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন।

বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ

ইউএস-চীনা রিলেশন অ্যাক্ট ২০০০-এ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সই। ওই চুক্তির কারণে ২০০১ সালের চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য ৫০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০০৬ সালে চীন মেক্সিকোকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার হয়।

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বিমান সংঘর্ষ

২০০১ সালের এপ্রিলে মার্কিন নজরদারি বিমানের সঙ্গে চীনের যুদ্ধবিমানের সংঘর্ষ হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের এক পাইলট নিহত হন। চীনের হাইনা দ্বীপে মার্কিন বিমানবাহিনীর ২৪ সদস্য আটক করা হয়।, যাদের ১২ দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়।

চীনের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি

চীনের পরাশক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ক্রমে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে। ২০০৭ সালের মার্চে চীন সামরিক বাজেট ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। একে ভালো চোখে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতায় পরিণত হয় চীন

জাপানকে ছাড়িয়ে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতায় পরিণত হয় চীন। তখন চীনের থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পাওনা ছিল ৬০ হাজার কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অর্থনীতির মধ্যে এই নির্ভরতা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভারসাম্যহীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়।

এশিয়ার প্রতি মনযোগী হয় যুক্তরাষ্ট্র

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসন ২০১১ সালে এশিয়ার প্রতি বেশি মনোযোগী হলে চীনের কপালে ভাঁজ পড়ে। এশিয়ার আটটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রান্স-প্যাসিফিক চুক্তিতে পৌঁছাতে একমত হলে চীন-মার্কিন ঠান্ডা লড়াইয়ের আভাস সুস্পষ্ট হয়। চীনের সঙ্গে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং বিরল ধাতুর একচেটিয়াকরণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরে সোচ্চার হয় যুক্তরাষ্ট্র। এই অবস্থার মধ্যেই ২০১২ সালে দৃষ্টিহীন ভিন্নমতাবলম্বী চেন গুয়াংচেং-এর গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয় দু দেশের মধ্যে। পরে সমঝোতা হলেও এর রেশ থেকে যায়।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিং পিং, সূত্র- রয়টার্সপ্রেসিডেন্ট হলেন সি চিন পিং

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮তম কংগ্রেসে নতুন প্রেসিডেন্ট হন সি চিন পিং। পাশাপাশি লি কেকিয়াংকে চীনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্ষমতায় এসেই চীনের পুনর্জাগরণের ডাক দেন সি।

সানিল্যান্ডস সামিট

ক্যালিফোর্নিয়ার সানিল্যান্ডে ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠক করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। একে উভয়পক্ষ আশাব্যঞ্জক বললেও বছর না ঘুরতেই হ্যাকিংকে কেন্দ্র করে আবার উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অভিযোগ ওঠে, চীনা হ্যাকার যুক্তরাষ্ট্রের ২ কোটি ২০ লাখ সাবেক ও বর্তমান কর্মীর তথ্য চুরি করেছে।

দক্ষিণ চীন সাগর

এশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত শ্যাংরি লা সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশটন কার্টার দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সেনা মোতায়েন নিয়ে আপত্তি জানান। শুরু হয় নতুন করে উত্তেজনা।

ট্রাম্প জমানা

এক চীন নীতিতে সম্মান দেখাতে চান ট্রাম্প। তবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রচলিত চর্চা ভেঙে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট টিসাই ইং-ওয়েনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। একই বছর এপ্রিলে ট্রাম্প ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দু দিনব্যাপী সম্মেলনে অংশ নেন। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও উত্তর কোরিয়ার বিষয়টি ছিল চীন-যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এজেন্ডা। ২০১৮ সালের মার্চে 'চীনে মার্কিন প্রযুক্তি ও মেধা সম্পদের অন্যায্য হস্তান্তর' বন্ধ করতে চীনের ৫ হাজার কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্কারোপ শুরু করে। শুরু হয় বাণিজ্যযুদ্ধ। ওই বছর তিন দফায় মোট ২৫ হাজার কোটি ডলারের চীনা পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রত্যুত্তরে ৫ হাজার কোটি ডলারের মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করে চীন। এরই মধ্যে বছরের শেষ নাগাদ কানাডায় গ্রেফতার হন হুয়াওয়ের সিএফও। ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করার অভিযোগ তুলে এ পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। চীন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। এদিকে মার্কিন ফেডারেল এজেন্সিগুলোতে হুয়াওয়ের পণ্য ব্যবহার নিষিদ্ধের পর ২০১৯ সালের ৬ মার্চ হুয়াওয়ে পাল্টা মামলা করে। ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশকে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক তৈরিতে হুয়াওয়ের পণ্য ব্যবহার না করার আহ্বান জানায়। একই বছর মে মাসে বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা ভেস্তে যায়। ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ২০ হাজার কোটি ডলারের পণ্যের ওপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ায়। একই ধরনের পদক্ষেপ নেয় চীন। আগস্টে চীনকে ‘কারেন্সি ম্যানিপুলেটর’ আখ্যা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। হংকং সমর্থকদের পক্ষে বিল সই করেন ট্রাম্প। বদলা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় চীন। পরের বছর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী হয় ট্রাম্প প্রশাসন। দীর্ঘ ১৮ মাসের উত্তেজনার পর বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।

করোনায় নতুন সংযোজন

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। পরে ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন নাগরিক ছাড়া যারা চীন সফর করেছে তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন করোনা নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে। তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে আখ্যা দেন। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ইস্যুতে চীনকে সমর্থন করছে বলে অভিযোগ তুলে সংস্থাটি থেকে বেরিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। একই বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ৬০ সাংবাদিকের পরিচয়পত্র বাতিল করে। জবাবে চীন সরকার কমপক্ষে ১৩ মার্কিন সাংবাদিককে বরখাস্তের ঘোষণা দেয়। হংকংয়ের বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র টেক্সাসের হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় চীন চেংদুতে মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়।

বাইডেন প্রশাসন

আশা ছিল জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে বাণিজ্যযুদ্ধসহ চীনের সঙ্গে হওয়া নানা উত্তেজনার কিছুটা প্রশমন হবে। বেইজিংও নতুন করে সম্পর্কোন্নয়নের কথা ভাবছিল। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর বাইডেন এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেননি। ফলে বিদ্যমান নীতি অনুসরণেরই সম্ভাবনা বেশি। তাই সাত দশকের যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক, তা একরকম অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত