ইয়াসিন আরাফাত
নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মানুষের মধ্যে বিরোধ চিরকালীন নয়। এই বিরোধ প্রাচীন কোনো ঘৃণার ভিত্তিতেও তৈরি হয়নি। এর শুরু ২০ শতকের গোড়ার দিকে। সে সময় আজেরি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। সর্বশেষ এমন সংঘর্ষ দেখা গেছে গত বছর। এই করোনা মহামারির মধ্যেই নাগোরনো–কারাবাখ নিয়ে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক প্রাণহানি হয় উভয় পক্ষের।
আজকের দ্বন্দ্বের উৎস হলো সার্বভৌম আজারবাইজানে আর্মেনিয়ার সামরিক দখলদারি। আর্মেনিয়া বর্তমানে এই সংঘাতকে মুসলিম আজারবাইজানের সঙ্গে ‘সভ্যতার সংঘাত’ হিসেবে চিত্রিত করে। মূলত হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ কথাটিই সুকৌশলে তারা ব্যবহার করে। বহু আগে থেকেই আর্মেনিয়া ‘খ্রিষ্টান কার্ড’ খেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই প্রচার বাজারে খুব একটা বিকোচ্ছে না।
১৯২০–এর দশকের গোড়ার দিকে নাগোরনো-কারাবাখে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (এনকেএও) গঠনের মধ্য দিয়ে যে সংকটের শুরু, তার সমাধান হয়নি আজও। এই সংকট এখনো আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার সম্পর্কে বিষ ঢালছে; নিচ্ছে হাজার মানুষের প্রাণ। গেল বছরের সংঘর্ষেই উভয় পক্ষের প্রায় ৭ হাজার সেনা নিহত হয়েছে। পরে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তি হয়। কিন্তু এমন শান্তিচুক্তি তো আগেও হয়েছে। সে চুক্তি ভঙ্গও হয়েছে। কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি আজও। কিন্তু এই পর্যায়ে এই সংকট পৌঁছাল কীভাবে, তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে এর ইতিহাসের দিকে।
যেভাবে শুরু
১৯২১ সালে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন আজারবাইজানের কাছে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল হস্তান্তর করেছিলেন। এর দুই বছরের মাথায় একে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়। সমস্যা হলো, ওই সময় নাগোরনো-কারাবাখের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ছিল আর্মেনীয় এবং তাদের বেশির ভাগই ছিলেন খ্রিষ্টান। অথচ আজারবাইজান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এনকেএও সৃষ্টির আদেশের নথিতে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের আজারবাইজানের সঙ্গেই ‘থাকা উচিত’। এর অর্থ, এই ভূখণ্ডকে শুরু থেকেই আজারবাইজানের অংশ হিসেবে মনে করা হতো। সমস্যার শুরু তখন থেকেই। দিন দিন তা শুধু বেড়েছে।
সোভিয়েতের শেষ কাল
সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নিজেই টিকে থাকার লড়াই করছে। দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধে নিজে নাকাল। ঠিক ওই অস্থিতিশীল সময়ে ১৯৮৮ সালে আজারবাইজান নাগোরনো–কারাবাখের আঞ্চলিক সরকারকে উৎখাত করে। সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার জাতিগত আর্মেনীয়রা কার্যত বিদ্রোহ শুরু করে। নাগোরনো–কারাবাখের আঞ্চলিক আইনসভায় একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণভোটে অঞ্চলটি আর্মেনিয়ার সঙ্গে থেকে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয়ে যায় ওই এলাকার আজেরি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে জাতিগত সংঘাত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া সাবেক সোভিয়েত সরকারের টেনে দেওয়া সীমান্ত নিয়েই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক আইনে নাগোরনো-কারাবাখ আজারবাইজানের সার্বভৌম অঞ্চল। আর সেখানে আর্মেনিয়ার সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি দখল হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার সময়টিতেই আর্মেনীয় বাহিনী এই অঞ্চলে আক্রমণ করে। সম্মুখ সংঘাত তীব্র হয়।
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর ১৯৯২ সালে নাগোরনো-কারাবাখের সংঘাত স্বাধীন আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে পুরাদস্তুর যুদ্ধের রূপ নেয়। রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে আজারবাইজান থেকে প্রায় আড়াই লাখের বেশি আর্মেনীয়কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্যদিকে নাগোরনো–কারাবাখ ছাড়তে হয়েছিল প্রায় লাখখানেক আজেরিকে। ১৯৯৩ সালে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আর্মেনিয়ার বাহিনীকে আজারবাইজানের অধিকৃত অঞ্চল থেকে অবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু আর্মেনিয়া সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ১৯৯৪ সালের মে মাসে যুদ্ধবিরতি হলেও আর্মেনিয়া নাগোরনো–কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিতে সেখানে আর্মেনীয়দের ক্ষমতায় বসায়। যুদ্ধবিরতির পর থেকে ‘মিনস্ক গ্রুপ ‘নামে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল নাগোরনো–কারাবাখ সংকট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি আপস মীমাংসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজও একটি স্থায়ী সমাধান অধরাই রয়ে গেছে।
ফের যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়
নাগোরনো–কারাবাখ আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের স্বীকৃত অংশ হলেও এর নিয়ন্ত্রণ বরাবরই ছিল আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণে। স্বাভাবিকভাবেই এটি কখনোই মানতে পারেনি আজারবাইজান। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতি কখনোই স্থায়ী শান্তিতে রূপ নেয়নি। ২০১৬ সালে আবারও যুদ্ধে মাতে দুই দেশ। চার দিন স্থায়ী সে যুদ্ধ পরে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে থামে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। আসেনি শান্তি। আসেনি যে, তা এই করোনাকালে উভয় পক্ষের যুদ্ধে জড়ানোর মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়। ২০২০ সালের জুলাইয়ে গত বছরের মাঝামাঝি করোনা মহামারির মধ্যেই মধ্য এশিয়ার দুই বৈরী প্রতিবেশী আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরুর শঙ্কা তৈরি হয়। এ শঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয় ১০ জুলাই। আর্মেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে তাভুশ সীমান্তে দুই দেশের সেনারা ট্যাংক ও কামানের মতো ভারী অস্ত্র নিয়ে লড়াই শুরু করে। সমস্যার কেন্দ্রে নাগোরনো–কারাবাখ অঞ্চল চলে আসতে সময় লাগেনি। সেপ্টেম্বরে উভয় পক্ষের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংঘর্ষ শুরু হয়। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এমন দুর্যোগকালে এ ধরনের যুদ্ধ শুরুর নিন্দা জানান এবং দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান তাঁরা। কিন্তু ব্যাপক রক্তক্ষয়ের পরই কেবল নভেম্বরে শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয় দুই পক্ষ। এই চুক্তির আওতায় আজারবাইজানের হাতে নাগোরনো–কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। চুক্তির পর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের প্রতিক্রিয়াই বলে দেয় সংকট আসলে সমাধান হয়নি। এটি জিইয়েই থাকল। যেকোনো সময় যেকোনো পক্ষের আচরণ থেকে এই সংকট আবার মাথা চাড়া দেবে এবং ফের রক্তক্ষয় হতে পারে।
আর্মেনীয় বাহিনী এ পর্যন্ত আজারবাইজানের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল দখল করেছে। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার আর্মেনীয় আজারবাইজানের বাকু, গাঞ্জা এবং অন্যান্য শহরে আছে। তিন দশকজুড়ে থেমে থেমে সংঘাত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই যুদ্ধে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান দৃশ্যমান দুটি পক্ষ হলেও এর সঙ্গে আরও কয়েকটি পক্ষ জড়িত। শুরু থেকেই রাশিয়ার কথা বলা হয়েছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণেই এই অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বেশি। সময়ের সঙ্গে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি দেশ। আর্মেনিয়ার দিক থেকে ‘সভ্যতার সংঘাত’ সামনে আনার কারণে, কিছু কিছু মুসলিম দেশ এই সংকটের সঙ্গে ধর্মীয় বিবেচনায় যুক্ত হয়েছে। জাতিগত সংঘাতের গোড়াটি তাই ক্রমেই ধর্মীয় বিভাজনের দিকে এগোচ্ছে। সর্বশেষ সংঘাতে তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষ নেয়। লক্ষ্য আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার হলেও বিশ্বের সামনে তারা মুসলিম ইস্যুটিকেই সামনে এনেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এ ধরনের ঘটনা যত বাড়বে, আর্মেনিয়ার দিক থেকে ‘খ্রিষ্টান কার্ড’ খেলার চেষ্টা তত সফল হবে। যদিও আজারবাইজান ও তুরস্ক—দুই পক্ষই এই অভিযোগ অস্বীকার করে। অন্যদিকে ইরানের সীমান্ত কারাবাখ অঞ্চল লাগোয়া। তবে ধর্মনিরপেক্ষ আজারবাইজানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ভালো না থাকায় আর্মেনিয়াকে গোপনে সহায়তা দেওয়ার কথা অস্বীকার করে ইরান। এই তিন দেশ ছায়াসঙ্গী হওয়ায় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের এই যুদ্ধ তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। আর ইরানের যুক্ত হওয়া মানেই তো সৌদি আরবকে বিপরীত অবস্থানে পাওয়া। সব মিলিয়ে যত দিন যাচ্ছে, সংকটটি আর আঞ্চলিক পরিসরে আটকে থাকছে না। ক্রমেই এটি আন্তর্জাতিক রূপ নিচ্ছে। খুব সহসা এর মীমাংসা হবে—এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মানুষের মধ্যে বিরোধ চিরকালীন নয়। এই বিরোধ প্রাচীন কোনো ঘৃণার ভিত্তিতেও তৈরি হয়নি। এর শুরু ২০ শতকের গোড়ার দিকে। সে সময় আজেরি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। সর্বশেষ এমন সংঘর্ষ দেখা গেছে গত বছর। এই করোনা মহামারির মধ্যেই নাগোরনো–কারাবাখ নিয়ে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক প্রাণহানি হয় উভয় পক্ষের।
আজকের দ্বন্দ্বের উৎস হলো সার্বভৌম আজারবাইজানে আর্মেনিয়ার সামরিক দখলদারি। আর্মেনিয়া বর্তমানে এই সংঘাতকে মুসলিম আজারবাইজানের সঙ্গে ‘সভ্যতার সংঘাত’ হিসেবে চিত্রিত করে। মূলত হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ কথাটিই সুকৌশলে তারা ব্যবহার করে। বহু আগে থেকেই আর্মেনিয়া ‘খ্রিষ্টান কার্ড’ খেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই প্রচার বাজারে খুব একটা বিকোচ্ছে না।
১৯২০–এর দশকের গোড়ার দিকে নাগোরনো-কারাবাখে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (এনকেএও) গঠনের মধ্য দিয়ে যে সংকটের শুরু, তার সমাধান হয়নি আজও। এই সংকট এখনো আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার সম্পর্কে বিষ ঢালছে; নিচ্ছে হাজার মানুষের প্রাণ। গেল বছরের সংঘর্ষেই উভয় পক্ষের প্রায় ৭ হাজার সেনা নিহত হয়েছে। পরে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তি হয়। কিন্তু এমন শান্তিচুক্তি তো আগেও হয়েছে। সে চুক্তি ভঙ্গও হয়েছে। কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি আজও। কিন্তু এই পর্যায়ে এই সংকট পৌঁছাল কীভাবে, তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে এর ইতিহাসের দিকে।
যেভাবে শুরু
১৯২১ সালে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন আজারবাইজানের কাছে নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল হস্তান্তর করেছিলেন। এর দুই বছরের মাথায় একে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়। সমস্যা হলো, ওই সময় নাগোরনো-কারাবাখের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ছিল আর্মেনীয় এবং তাদের বেশির ভাগই ছিলেন খ্রিষ্টান। অথচ আজারবাইজান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এনকেএও সৃষ্টির আদেশের নথিতে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের আজারবাইজানের সঙ্গেই ‘থাকা উচিত’। এর অর্থ, এই ভূখণ্ডকে শুরু থেকেই আজারবাইজানের অংশ হিসেবে মনে করা হতো। সমস্যার শুরু তখন থেকেই। দিন দিন তা শুধু বেড়েছে।
সোভিয়েতের শেষ কাল
সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নিজেই টিকে থাকার লড়াই করছে। দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধে নিজে নাকাল। ঠিক ওই অস্থিতিশীল সময়ে ১৯৮৮ সালে আজারবাইজান নাগোরনো–কারাবাখের আঞ্চলিক সরকারকে উৎখাত করে। সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার জাতিগত আর্মেনীয়রা কার্যত বিদ্রোহ শুরু করে। নাগোরনো–কারাবাখের আঞ্চলিক আইনসভায় একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণভোটে অঞ্চলটি আর্মেনিয়ার সঙ্গে থেকে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয়ে যায় ওই এলাকার আজেরি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে জাতিগত সংঘাত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া সাবেক সোভিয়েত সরকারের টেনে দেওয়া সীমান্ত নিয়েই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক আইনে নাগোরনো-কারাবাখ আজারবাইজানের সার্বভৌম অঞ্চল। আর সেখানে আর্মেনিয়ার সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি দখল হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার সময়টিতেই আর্মেনীয় বাহিনী এই অঞ্চলে আক্রমণ করে। সম্মুখ সংঘাত তীব্র হয়।
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর ১৯৯২ সালে নাগোরনো-কারাবাখের সংঘাত স্বাধীন আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে পুরাদস্তুর যুদ্ধের রূপ নেয়। রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে আজারবাইজান থেকে প্রায় আড়াই লাখের বেশি আর্মেনীয়কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্যদিকে নাগোরনো–কারাবাখ ছাড়তে হয়েছিল প্রায় লাখখানেক আজেরিকে। ১৯৯৩ সালে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আর্মেনিয়ার বাহিনীকে আজারবাইজানের অধিকৃত অঞ্চল থেকে অবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু আর্মেনিয়া সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ১৯৯৪ সালের মে মাসে যুদ্ধবিরতি হলেও আর্মেনিয়া নাগোরনো–কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিতে সেখানে আর্মেনীয়দের ক্ষমতায় বসায়। যুদ্ধবিরতির পর থেকে ‘মিনস্ক গ্রুপ ‘নামে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল নাগোরনো–কারাবাখ সংকট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি আপস মীমাংসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজও একটি স্থায়ী সমাধান অধরাই রয়ে গেছে।
ফের যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়
নাগোরনো–কারাবাখ আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের স্বীকৃত অংশ হলেও এর নিয়ন্ত্রণ বরাবরই ছিল আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণে। স্বাভাবিকভাবেই এটি কখনোই মানতে পারেনি আজারবাইজান। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতি কখনোই স্থায়ী শান্তিতে রূপ নেয়নি। ২০১৬ সালে আবারও যুদ্ধে মাতে দুই দেশ। চার দিন স্থায়ী সে যুদ্ধ পরে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে থামে। কিন্তু বন্ধ হয়নি। আসেনি শান্তি। আসেনি যে, তা এই করোনাকালে উভয় পক্ষের যুদ্ধে জড়ানোর মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়। ২০২০ সালের জুলাইয়ে গত বছরের মাঝামাঝি করোনা মহামারির মধ্যেই মধ্য এশিয়ার দুই বৈরী প্রতিবেশী আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরুর শঙ্কা তৈরি হয়। এ শঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয় ১০ জুলাই। আর্মেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে তাভুশ সীমান্তে দুই দেশের সেনারা ট্যাংক ও কামানের মতো ভারী অস্ত্র নিয়ে লড়াই শুরু করে। সমস্যার কেন্দ্রে নাগোরনো–কারাবাখ অঞ্চল চলে আসতে সময় লাগেনি। সেপ্টেম্বরে উভয় পক্ষের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংঘর্ষ শুরু হয়। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এমন দুর্যোগকালে এ ধরনের যুদ্ধ শুরুর নিন্দা জানান এবং দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান তাঁরা। কিন্তু ব্যাপক রক্তক্ষয়ের পরই কেবল নভেম্বরে শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয় দুই পক্ষ। এই চুক্তির আওতায় আজারবাইজানের হাতে নাগোরনো–কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। চুক্তির পর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের প্রতিক্রিয়াই বলে দেয় সংকট আসলে সমাধান হয়নি। এটি জিইয়েই থাকল। যেকোনো সময় যেকোনো পক্ষের আচরণ থেকে এই সংকট আবার মাথা চাড়া দেবে এবং ফের রক্তক্ষয় হতে পারে।
আর্মেনীয় বাহিনী এ পর্যন্ত আজারবাইজানের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল দখল করেছে। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার আর্মেনীয় আজারবাইজানের বাকু, গাঞ্জা এবং অন্যান্য শহরে আছে। তিন দশকজুড়ে থেমে থেমে সংঘাত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই যুদ্ধে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান দৃশ্যমান দুটি পক্ষ হলেও এর সঙ্গে আরও কয়েকটি পক্ষ জড়িত। শুরু থেকেই রাশিয়ার কথা বলা হয়েছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণেই এই অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বেশি। সময়ের সঙ্গে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি দেশ। আর্মেনিয়ার দিক থেকে ‘সভ্যতার সংঘাত’ সামনে আনার কারণে, কিছু কিছু মুসলিম দেশ এই সংকটের সঙ্গে ধর্মীয় বিবেচনায় যুক্ত হয়েছে। জাতিগত সংঘাতের গোড়াটি তাই ক্রমেই ধর্মীয় বিভাজনের দিকে এগোচ্ছে। সর্বশেষ সংঘাতে তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষ নেয়। লক্ষ্য আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার হলেও বিশ্বের সামনে তারা মুসলিম ইস্যুটিকেই সামনে এনেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এ ধরনের ঘটনা যত বাড়বে, আর্মেনিয়ার দিক থেকে ‘খ্রিষ্টান কার্ড’ খেলার চেষ্টা তত সফল হবে। যদিও আজারবাইজান ও তুরস্ক—দুই পক্ষই এই অভিযোগ অস্বীকার করে। অন্যদিকে ইরানের সীমান্ত কারাবাখ অঞ্চল লাগোয়া। তবে ধর্মনিরপেক্ষ আজারবাইজানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ভালো না থাকায় আর্মেনিয়াকে গোপনে সহায়তা দেওয়ার কথা অস্বীকার করে ইরান। এই তিন দেশ ছায়াসঙ্গী হওয়ায় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের এই যুদ্ধ তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। আর ইরানের যুক্ত হওয়া মানেই তো সৌদি আরবকে বিপরীত অবস্থানে পাওয়া। সব মিলিয়ে যত দিন যাচ্ছে, সংকটটি আর আঞ্চলিক পরিসরে আটকে থাকছে না। ক্রমেই এটি আন্তর্জাতিক রূপ নিচ্ছে। খুব সহসা এর মীমাংসা হবে—এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
ইসলামাবাদে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান। তাদের বৈঠকের টেবিলে দুই দেশের পতাকা সাজানো ছিল। কামরুল হাসান পাকিস্তানের অন্যান্য সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও তাঁর এই সফরের প্রধান আকর্ষণ ছিল সেনাপ্রধা
৩ দিন আগেপাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক কেমন হবে, সেই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। আগেরবারের দেশ দুটিকে ঘিরে নীতিমালায় যে অসামঞ্জস্য ছিল, সেগুলো টিকে থাকবে নাকি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুসংগত হবে, তা লক্ষ্য করার বিষয়। এক্ষেত্রে ২০২৪ সালে উভয় দেশের সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ একটা গুরুত্বপ
৩ দিন আগেফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছে ১৫ মাস ধরে। এই সময়ে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডে প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে; আহত হয়েছে লক্ষাধিক। আর পুরো গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় শতভাগই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ত্রিদেশীয় মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আশ
৩ দিন আগেভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা ও চিকিৎসাসেবা ব্যাপকভাবে সীমিত হয়ে পড়েছে। গত আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভারত বাংলাদেশে তাদের ভিসা...
৪ দিন আগে