ইয়াসিন আরাফাত
‘ত্রিশঙ্কু দশা’ বলে বাংলায় একটা কথা আছে। কেউ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বা কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে দোটানায় থাকলে হরহামেশাই একে ‘ত্রিশঙ্কু দশা’ বলে বর্ণনা করা হয়। যদিও এটি একটু বাড়িয়ে বলাই। কারণ, ত্রিশঙ্কু দশা এর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার, যা সাত দশকের বেশি সময় ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ‘ভূ–স্বর্গ’ খ্যাত কাশ্মীর।
হিমালয় অঞ্চলের রাজ্য কাশ্মীর তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য দিয়ে গোটা বিশ্বের কাছ থেকেই ‘ভূ–স্বর্গ’ খ্যাতি অর্জন করেছে। আর এই খ্যাতিই বোধ হয় তার বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে যেমন উল্লেখ আছে—‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’, ঠিক তেমনই যেন কাশ্মীরের কপালেও ঘটেছে। কাশ্মীর নাম শুনলেই এখন মন সচেতন হয় ‘মৃত্যু’, ‘হামলা’, ‘অভিযান’ ইত্যাকার শব্দের জন্য।
হিমালয় অঞ্চলের উপত্যকা কাশ্মীরকে দখল করেছে তিনটি দেশ, যা তাকে আক্ষরিক অর্থেই ফেলেছে ত্রিশঙ্কু দশায়। এর মধ্যে ভারত যে অংশটিকে দখল করেছে, তার নাম জম্মু কাশ্মীর। পাকিস্তান যে অংশটিকে দখল করেছে, তার নাম আজাদ কাশ্মীর এবং চীন যে অংশটিকে দখল করেছে তার নাম আকসাই চীন।
কাশ্মীর এমন একটি অঞ্চল যা বরাবরই উত্তেজনার কারণ। ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে তিন দফা যুদ্ধ করেছে ভারত ও পাকিস্তান। গত শতকের আশির দশকের পর থেকে দফায় দফায় পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট ইসলামপন্থী আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে অঞ্চলটিতে। এতে নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাও বাতিল করেছে ভারতের মোদি সরকার।
যেভাবে দশকের পর দশক ধরে চলছে এ বিরোধ—
দেশভাগ থেকেই শুরু
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানের উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংয়ের সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হয়। এ সময় তিনি ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চান। এরপরই ভারতে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি চুক্তি সই করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে কাশ্মীর বিতর্ক পৌঁছায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। কিন্তু সেখানে অস্ত্রবিরতি ও গণভোট নিয়ে ঐকমত্য অধরাই থেকে যায়।
মুখোমুখি ভারত–পাকিস্তান
গোটা ৫০–এর দশক কাশ্মীর ছিল ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে দোটানায়। তখনো অস্ত্রের ঝনঝনানি সেভাবে শুরু হয়নি। ১৯৫১ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু কাশ্মীরে ভোটের আয়োজন করা হয়। তখন কাশ্মীর নিয়ে গণভোটের প্রস্তাব নাকচ করে ভারত। ভারতের এই অবস্থানের বিরোধিতা করে জাতিসংঘ ও পাকিস্তান। তার দাবি করে—কাশ্মীরের জনগণ কোন দেশের সঙ্গে যেতে চায়, তা নিয়ে গণভোটের প্রয়োজন। গণভোটের পক্ষ নেওয়ায় ভারত সমর্থিত কর্তৃপক্ষ কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে ১৯৫৩ সালে বরখাস্ত করে। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জম্মু কাশ্মীর ভারত সমর্থিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। চার বছর পর ১৯৫৭ সালে ভারতীয় সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে ঘোষণা করা হয়।
সমীকরণে চীনের সরাসরি প্রবেশ
১৯৬০ সালে কাশ্মীরের পূর্বাঞ্চল দখল করে চীন, যা এখন আকসাই চীন হিসেবে পরিচিত। এ নিয়ে উত্তেজনার শুরু অবশ্য আগের দশকেই শুরু হয়, যখন ১৯৫৯ সালে ভারত দালাই লামাকে আশ্রয় দেয়। ১৯৬২ সালে দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে বাজেভাবে পরাজিত হয় ভারত। লাদাখের আকসাই চীন অংশ দখলে নেয় চীন। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত অঞ্চলটি চীনের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
একই দশকে সরাসরি যুদ্ধ জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ শেষ হয় একই বছরের সেপ্টেম্বরে। যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক সেনাক্ষয় হয়। উভয় পক্ষই নিজেদের মতো করে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কাশ্মীরের দশা হয় দুই রাজার লড়াইয়ে উলুখাগড়ার মতো। যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় চীন। পাকিস্তানকে অস্ত্রসহ নানা সহায়তা দেয় তারা। আর এর মধ্য দিয়েই এক দীর্ঘসূত্রী মৈত্রীর সূচনা হয় দু দেশের মধ্যে। পরে তাসখন্দে দুই দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও শিমলা চুক্তি
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয় পাকিস্তান। তখন ভারতীয় বাহিনী ও বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ ছাড়ে। পরের বছরই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি সই। এতে নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে চলার বিষয়ে দুই পক্ষের সমঝোতা হয়। আজ সিমলা চুক্তির ৪৯তম বার্ষিকী। যদিও এই এত বছরে চুক্তির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে না বলে উভয় পক্ষ থেকেই পরস্পরকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য এসেছে বহুবার। এসব অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রেই পরে সংঘাতে রূপ নিয়েছে।
বিদ্রোহ এবার কাশ্মীরে
সিয়াচেন হিমবাহ ১৯৮৪ সালে দখল করে ভারতীয় সেনারা। এটি পুনর্দখলের জন্য পরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালায় পাকিস্তান। এই টানাপোড়েনের মধ্যে ১৯৮৭ সালে কাশ্মীরে বিদ্রোহ শুরু হয়। জম্মু কাশ্মীরে বিতর্কিত রাজ্য নির্বাচন নিয়ে জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট নামের একটি দল এ বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহের সময় জম্মু কাশ্মীরে পাকিস্তান নিজেদের সেনা পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ তোলে ভারত। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ১৯৯০ সাল নাগাদ কাশ্মীরে বিদ্রোহের তীব্রতা আরও বাড়ে। ওই বছর গাওয়াকদল ব্রিজে ভারতীয় সেনারা প্রায় ১০০ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। হামলার শিকার হয়ে জম্মু কাশ্মীরে বাস করা হিন্দুরা উপত্যকাটি ছাড়তে থাকেন। বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে আর্মড ফোর্সেস অ্যাক্ট নামের বিশেষ আইন চালু করে ভারত। ১৯৯০–এর দশকের পুরো সময় কাশ্মীরে বিদ্রোহ, সংঘর্ষের ঘটনা বাড়তে থাকে। একদিকে পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা উপত্যকাটিতে প্রবেশ করতে শুরু করে, অন্যদিকে ভারতও জম্মু কাশ্মীরে সেনা উপস্থিতি বাড়াতে থাকে। মাঝখান থেকে একের পর এক সংঘর্ষে জেরবার হতে থাকে কাশ্মীর ও এর বাসিন্দারা। এই সংঘর্ষ ১৯৯৯ সালে পুরোপুরি যুদ্ধের রূপ নেয়। শুরু হয় কারগিল যুদ্ধ। আইসি-৮১৪ নামের ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে অঞ্চলটির স্বাধীনতাকামীরা। যাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তিন স্বাধীনতাকামীকে মুক্তি দেয় ভারত।
খণ্ড যুদ্ধের কাল
২০০১ সালে জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে আইনসভায় হামলার চালায় অঞ্চলটির স্বাধীনতাকামীরা। এর পর থেকে এমন বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটতেই থাকে কাশ্মীরজুড়ে, যা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে থাকে। ২০১০–১১ সময়ে কাশ্মীর উপত্যকায় ব্যাপক সহিংসতা শুরু। স্বাধীনতাকামীরা সরাসরি বিরোধের পথ বেছে নেয়। ওই সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্দেশে পাথর ছোড়ায় অভিযুক্ত ১২০০ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীকে’ ক্ষমা করে দেন জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ। এর দু বছর পর ২০১৩ সালে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জয়শ-ই-মোহাম্মদের সদস্য আফজল গুরুর ফাঁসি কার্যকর হয়। আফজাল গুরু কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা, যিনি আইনসভায় সন্ত্রাসী হামলায় অভিযুক্ত হন। কাশ্মীর সীমান্তে সংঘাত কমাতে ওই বছরই আলোচনায় বসেন ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
সমঝোতা দূর অস্ত
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগে ২০১৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বাতিল করে ভারত। ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের বৈঠককে কেন্দ্র করে এই বৈঠক বাতিল করা হয়। ২০১৫-১৬ সালে কাশ্মীরের ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি। স্থানীয় পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে জোট করে বিজেপি কাশ্মীরের ক্ষমতায় আসে। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো নারী মুখ্যমন্ত্রী পায় জম্মু-কাশ্মীর। পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মেহবুবা তাঁর বাবা মুফতি মোহাম্মদ সাইদের মৃত্যুর পর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর হামলা চালালে আবার পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। ওই ঘটনায় কমপক্ষে সাতজন নিহত হন; আহত হয় ১৬ জন। ২০০০ সালের পর এটিই ছিল কাশ্মীরে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা। ২০১৯ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিককে বদলি করা হয়। একই বছর সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে মোদি সরকার। ফলে কাশ্মীর ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়।
বিশ্বগ্রামের বাইরে কাশ্মীর
বিশেষ সুবিধা বাতিল হওয়ার পর উত্তাল হয়ে ওঠে জম্মু-কাশ্মীর। সংঘাত নিয়ন্ত্রণে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে টু–জি ইন্টারনেট সেবা চালু রাখা হয়। এক অর্থে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে গোটা কাশ্মীরকে বিশ্বগ্রাম থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। এ সময় ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর আবদুল্লাহ এবং এই উপত্যকার আরেক নেত্রী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকে বেশ কয়েকবার গৃহবন্দী করা হয়। এদিকে কাশ্মীর সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধে ভারত-পাকিস্তানের বিরল সমঝোতা হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক যৌথ বিবৃতিতে দেশ দুটির সামরিক বাহিনী এ কথা জানায়।
সমঝোতার বিবৃতিও আদতে কাশ্মীরকে খুব একটা আশা দেখাতে পারছে না। কাশ্মীর হচ্ছে সেই ঘরপোড়া গরু, যে সিঁদুরে মেঘ নয়, বাতাসের জোর হালকা বাড়লেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। পাবে না কেন, তার ইতিহাস তো আর দশটা অঞ্চলের মতো নয়। ভূ–স্বর্গ কাশ্মীর তো তার নিজ ঐশ্বর্য দিয়েই নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। এখানে ১৯৪৭ সাল থেকে সংকট তুলে ধরা হলেও কাশ্মীরের এই যন্ত্রণাকাল শুরু হয়েছে তারও বহু আগে। এর মূলটি খুঁজতে হলে অন্তত চলে যেতে হবে ১৮৪৬ সালে, যখন গুলাব সিং নতি স্বীকার করেন ব্রিটিশরাজের কাছে। কিংবা তারও আগে যাওয়া যায়, যেদিন প্রথম কোনো ভিনদেশি ক্ষমতাধরের চোখ মুগ্ধ হয়েছিল কাশ্মীরের রূপে। সে ইতিহাস অন্যদিকে।
আরও পড়ুন:
‘ত্রিশঙ্কু দশা’ বলে বাংলায় একটা কথা আছে। কেউ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বা কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে দোটানায় থাকলে হরহামেশাই একে ‘ত্রিশঙ্কু দশা’ বলে বর্ণনা করা হয়। যদিও এটি একটু বাড়িয়ে বলাই। কারণ, ত্রিশঙ্কু দশা এর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার, যা সাত দশকের বেশি সময় ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ‘ভূ–স্বর্গ’ খ্যাত কাশ্মীর।
হিমালয় অঞ্চলের রাজ্য কাশ্মীর তার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য দিয়ে গোটা বিশ্বের কাছ থেকেই ‘ভূ–স্বর্গ’ খ্যাতি অর্জন করেছে। আর এই খ্যাতিই বোধ হয় তার বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে যেমন উল্লেখ আছে—‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’, ঠিক তেমনই যেন কাশ্মীরের কপালেও ঘটেছে। কাশ্মীর নাম শুনলেই এখন মন সচেতন হয় ‘মৃত্যু’, ‘হামলা’, ‘অভিযান’ ইত্যাকার শব্দের জন্য।
হিমালয় অঞ্চলের উপত্যকা কাশ্মীরকে দখল করেছে তিনটি দেশ, যা তাকে আক্ষরিক অর্থেই ফেলেছে ত্রিশঙ্কু দশায়। এর মধ্যে ভারত যে অংশটিকে দখল করেছে, তার নাম জম্মু কাশ্মীর। পাকিস্তান যে অংশটিকে দখল করেছে, তার নাম আজাদ কাশ্মীর এবং চীন যে অংশটিকে দখল করেছে তার নাম আকসাই চীন।
কাশ্মীর এমন একটি অঞ্চল যা বরাবরই উত্তেজনার কারণ। ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে তিন দফা যুদ্ধ করেছে ভারত ও পাকিস্তান। গত শতকের আশির দশকের পর থেকে দফায় দফায় পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট ইসলামপন্থী আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে অঞ্চলটিতে। এতে নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাও বাতিল করেছে ভারতের মোদি সরকার।
যেভাবে দশকের পর দশক ধরে চলছে এ বিরোধ—
দেশভাগ থেকেই শুরু
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানের উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংয়ের সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হয়। এ সময় তিনি ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চান। এরপরই ভারতে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি চুক্তি সই করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে কাশ্মীর বিতর্ক পৌঁছায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। কিন্তু সেখানে অস্ত্রবিরতি ও গণভোট নিয়ে ঐকমত্য অধরাই থেকে যায়।
মুখোমুখি ভারত–পাকিস্তান
গোটা ৫০–এর দশক কাশ্মীর ছিল ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে দোটানায়। তখনো অস্ত্রের ঝনঝনানি সেভাবে শুরু হয়নি। ১৯৫১ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু কাশ্মীরে ভোটের আয়োজন করা হয়। তখন কাশ্মীর নিয়ে গণভোটের প্রস্তাব নাকচ করে ভারত। ভারতের এই অবস্থানের বিরোধিতা করে জাতিসংঘ ও পাকিস্তান। তার দাবি করে—কাশ্মীরের জনগণ কোন দেশের সঙ্গে যেতে চায়, তা নিয়ে গণভোটের প্রয়োজন। গণভোটের পক্ষ নেওয়ায় ভারত সমর্থিত কর্তৃপক্ষ কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে ১৯৫৩ সালে বরখাস্ত করে। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জম্মু কাশ্মীর ভারত সমর্থিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। চার বছর পর ১৯৫৭ সালে ভারতীয় সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে ঘোষণা করা হয়।
সমীকরণে চীনের সরাসরি প্রবেশ
১৯৬০ সালে কাশ্মীরের পূর্বাঞ্চল দখল করে চীন, যা এখন আকসাই চীন হিসেবে পরিচিত। এ নিয়ে উত্তেজনার শুরু অবশ্য আগের দশকেই শুরু হয়, যখন ১৯৫৯ সালে ভারত দালাই লামাকে আশ্রয় দেয়। ১৯৬২ সালে দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে বাজেভাবে পরাজিত হয় ভারত। লাদাখের আকসাই চীন অংশ দখলে নেয় চীন। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত অঞ্চলটি চীনের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
একই দশকে সরাসরি যুদ্ধ জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ শেষ হয় একই বছরের সেপ্টেম্বরে। যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক সেনাক্ষয় হয়। উভয় পক্ষই নিজেদের মতো করে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কাশ্মীরের দশা হয় দুই রাজার লড়াইয়ে উলুখাগড়ার মতো। যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় চীন। পাকিস্তানকে অস্ত্রসহ নানা সহায়তা দেয় তারা। আর এর মধ্য দিয়েই এক দীর্ঘসূত্রী মৈত্রীর সূচনা হয় দু দেশের মধ্যে। পরে তাসখন্দে দুই দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও শিমলা চুক্তি
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয় পাকিস্তান। তখন ভারতীয় বাহিনী ও বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ ছাড়ে। পরের বছরই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি সই। এতে নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে চলার বিষয়ে দুই পক্ষের সমঝোতা হয়। আজ সিমলা চুক্তির ৪৯তম বার্ষিকী। যদিও এই এত বছরে চুক্তির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে না বলে উভয় পক্ষ থেকেই পরস্পরকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য এসেছে বহুবার। এসব অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রেই পরে সংঘাতে রূপ নিয়েছে।
বিদ্রোহ এবার কাশ্মীরে
সিয়াচেন হিমবাহ ১৯৮৪ সালে দখল করে ভারতীয় সেনারা। এটি পুনর্দখলের জন্য পরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালায় পাকিস্তান। এই টানাপোড়েনের মধ্যে ১৯৮৭ সালে কাশ্মীরে বিদ্রোহ শুরু হয়। জম্মু কাশ্মীরে বিতর্কিত রাজ্য নির্বাচন নিয়ে জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট নামের একটি দল এ বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহের সময় জম্মু কাশ্মীরে পাকিস্তান নিজেদের সেনা পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ তোলে ভারত। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ১৯৯০ সাল নাগাদ কাশ্মীরে বিদ্রোহের তীব্রতা আরও বাড়ে। ওই বছর গাওয়াকদল ব্রিজে ভারতীয় সেনারা প্রায় ১০০ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। হামলার শিকার হয়ে জম্মু কাশ্মীরে বাস করা হিন্দুরা উপত্যকাটি ছাড়তে থাকেন। বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে আর্মড ফোর্সেস অ্যাক্ট নামের বিশেষ আইন চালু করে ভারত। ১৯৯০–এর দশকের পুরো সময় কাশ্মীরে বিদ্রোহ, সংঘর্ষের ঘটনা বাড়তে থাকে। একদিকে পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা উপত্যকাটিতে প্রবেশ করতে শুরু করে, অন্যদিকে ভারতও জম্মু কাশ্মীরে সেনা উপস্থিতি বাড়াতে থাকে। মাঝখান থেকে একের পর এক সংঘর্ষে জেরবার হতে থাকে কাশ্মীর ও এর বাসিন্দারা। এই সংঘর্ষ ১৯৯৯ সালে পুরোপুরি যুদ্ধের রূপ নেয়। শুরু হয় কারগিল যুদ্ধ। আইসি-৮১৪ নামের ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে অঞ্চলটির স্বাধীনতাকামীরা। যাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তিন স্বাধীনতাকামীকে মুক্তি দেয় ভারত।
খণ্ড যুদ্ধের কাল
২০০১ সালে জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে আইনসভায় হামলার চালায় অঞ্চলটির স্বাধীনতাকামীরা। এর পর থেকে এমন বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটতেই থাকে কাশ্মীরজুড়ে, যা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে থাকে। ২০১০–১১ সময়ে কাশ্মীর উপত্যকায় ব্যাপক সহিংসতা শুরু। স্বাধীনতাকামীরা সরাসরি বিরোধের পথ বেছে নেয়। ওই সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্দেশে পাথর ছোড়ায় অভিযুক্ত ১২০০ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীকে’ ক্ষমা করে দেন জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ। এর দু বছর পর ২০১৩ সালে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জয়শ-ই-মোহাম্মদের সদস্য আফজল গুরুর ফাঁসি কার্যকর হয়। আফজাল গুরু কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা, যিনি আইনসভায় সন্ত্রাসী হামলায় অভিযুক্ত হন। কাশ্মীর সীমান্তে সংঘাত কমাতে ওই বছরই আলোচনায় বসেন ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
সমঝোতা দূর অস্ত
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগে ২০১৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বাতিল করে ভারত। ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের বৈঠককে কেন্দ্র করে এই বৈঠক বাতিল করা হয়। ২০১৫-১৬ সালে কাশ্মীরের ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি। স্থানীয় পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে জোট করে বিজেপি কাশ্মীরের ক্ষমতায় আসে। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো নারী মুখ্যমন্ত্রী পায় জম্মু-কাশ্মীর। পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মেহবুবা তাঁর বাবা মুফতি মোহাম্মদ সাইদের মৃত্যুর পর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর হামলা চালালে আবার পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। ওই ঘটনায় কমপক্ষে সাতজন নিহত হন; আহত হয় ১৬ জন। ২০০০ সালের পর এটিই ছিল কাশ্মীরে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা। ২০১৯ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিককে বদলি করা হয়। একই বছর সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে মোদি সরকার। ফলে কাশ্মীর ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়।
বিশ্বগ্রামের বাইরে কাশ্মীর
বিশেষ সুবিধা বাতিল হওয়ার পর উত্তাল হয়ে ওঠে জম্মু-কাশ্মীর। সংঘাত নিয়ন্ত্রণে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে টু–জি ইন্টারনেট সেবা চালু রাখা হয়। এক অর্থে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে গোটা কাশ্মীরকে বিশ্বগ্রাম থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। এ সময় ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর আবদুল্লাহ এবং এই উপত্যকার আরেক নেত্রী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকে বেশ কয়েকবার গৃহবন্দী করা হয়। এদিকে কাশ্মীর সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধে ভারত-পাকিস্তানের বিরল সমঝোতা হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক যৌথ বিবৃতিতে দেশ দুটির সামরিক বাহিনী এ কথা জানায়।
সমঝোতার বিবৃতিও আদতে কাশ্মীরকে খুব একটা আশা দেখাতে পারছে না। কাশ্মীর হচ্ছে সেই ঘরপোড়া গরু, যে সিঁদুরে মেঘ নয়, বাতাসের জোর হালকা বাড়লেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। পাবে না কেন, তার ইতিহাস তো আর দশটা অঞ্চলের মতো নয়। ভূ–স্বর্গ কাশ্মীর তো তার নিজ ঐশ্বর্য দিয়েই নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। এখানে ১৯৪৭ সাল থেকে সংকট তুলে ধরা হলেও কাশ্মীরের এই যন্ত্রণাকাল শুরু হয়েছে তারও বহু আগে। এর মূলটি খুঁজতে হলে অন্তত চলে যেতে হবে ১৮৪৬ সালে, যখন গুলাব সিং নতি স্বীকার করেন ব্রিটিশরাজের কাছে। কিংবা তারও আগে যাওয়া যায়, যেদিন প্রথম কোনো ভিনদেশি ক্ষমতাধরের চোখ মুগ্ধ হয়েছিল কাশ্মীরের রূপে। সে ইতিহাস অন্যদিকে।
আরও পড়ুন:
ইউক্রেনের ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, রাশিয়ার এ ধরনের আক্রমণকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে—যেমনটি ইসরায়েল উত্তর গাজাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে হয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ,
২০ ঘণ্টা আগেড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
২ দিন আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
২ দিন আগে