মনিজা রহমান
‘জানেন, এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ার সময়ে আমার ক্রাশ ছিল ডাইনোসর। মিডল স্কুল শুরুর পরে হলো ফ্রাঙ্কো!’
আনিকার কথায় গ্যাব্রিয়েলা জিওভান্নির মুখে হাসি ফুটল কি ফুটল না, ঠিক বোঝা গেল না। কয়েক দিন টানা বৃষ্টির পরে আকাশ যখন পরিষ্কার হতে শুরু করে, তেমন একটি স্মিত ভাব তার চেহারায়। গ্যাব্রিয়েলার নীরবতায় আনিকা চারদিকে শুধু তাকাতে লাগল। এক কোণে একটা টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলো ঘরটাকে ছায়াঘেরা পরিবেশ এনে দিয়েছে। দুই সেট সোফা আর টেবিল ছাড়া ঘরে কোনো আসবাব নেই। দেয়ালে কিছু ছবি আর পেইন্টিং। ফ্রাঙ্কোর শিশু বয়সের ছবি নিয়ে কোলাজ আছে একটাতে। সেদিকে তাকিয়ে আনিকার আবার মনে হলো, ফ্রাঙ্কোর মতো সুন্দর চেহারার মানুষ ও আসলে কোনো দিন দেখেনি।
ফ্রাঙ্কোকে আনিকার ভালো লাগার অনেক কারণ ছিল। মিডল স্কুল ও হাইস্কুলে পড়ার সময়ে দুর্দান্ত অ্যাথলেট ছিল ও। স্কুলের মেয়েরা আড়ালে ফিসফাস করত ফ্রাঙ্কোকে নিয়ে। আনিকার সব সময় সেটা ভালো লাগত না শুনতে।
আনিকাকে ফ্রাঙ্কোর ভালো লাগার তেমন কোনো কারণ ছিল না। হয়তো ওর বুদ্ধিমত্তা ও আর্দ্র হৃদয় আকৃষ্ট করতে পারে ফ্রাঙ্কোকে।
লেখাপড়ায় ভালো হওয়াতে আনিকা ক্লাসের শিক্ষকদের আলাদা মনোযোগ পেত। ক্লাসের পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের সাহায্যের জন্য শিক্ষকেরা ওর সাহায্য নিত। এভাবে ক্যালকুলাসের একটি নিয়ম বোঝাতে গিয়ে ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা। ফ্রাঙ্কোর প্রতি ওর গোপন ক্রাশের কথা আর গোপন থাকল না। সেটাকে পুঁজি করে ফ্রাঙ্কো আনিকাকে খাটিয়ে নিত! মুখে বলত, শিক্ষকদের চেয়ে ওর শেখানোর পদ্ধতি ফ্রাঙ্কোর ভালো লাগে।
আনিকা আর যায় কোথায়! রোজার ঈদে আর কোরবানি ঈদে পাওয়া সেলামির সমুদয় অর্থ ফ্রাঙ্কোকে দিয়ে দিত ও। ভিডিও গেমসের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিল। মা যাতে সন্দেহ না করে এ জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি মিথ্যা কথা বলত। ও তখন সব করতে পারত ফ্রাঙ্কোর জন্য।
শুরুতে মিডল স্কুলে দুজনের সম্পর্ককে আনিকার মা-বাবা কিশোর বয়সের বন্ধুত্ব হিসেবে নিয়েছিল। হাইস্কুলে যাওয়ার আগে বিরাট ঝাঁকুনি খায় ওরা। আনিকা ইচ্ছা করে স্পেশালাইজড স্কুলের পরীক্ষা দেয়নি নানা অজুহাতে। ওর মনে হতো, ফ্রাঙ্কোর খুব কাছাকাছি থাকতে হবে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অত্যন্ত কাছাকাছি। ও কাছে না থাকলে ফ্রাঙ্কোকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। মা-বাবার প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও ওদের সম্পর্ক অব্যাহত রইল। বন্ধুত্ব প্রেমের সম্পর্কে রূপান্তর নিল আর সেটা গোপন থাকল না!
ফ্রাঙ্কোর বিষণ্নতাবোধের সমস্যা ছিল অনেক আগে থেকে। মা-বাবার বিচ্ছেদ সেই সমস্যাকে প্রকট করল। স্থানীয় হাইস্কুলের সাদামাটা পড়াশোনার সঙ্গেও ও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না। দিনের পর দিন অনুপস্থিতি, ক্লাসের পরীক্ষা না দেওয়ায় টুয়েলভথ গ্রেডে উঠতে পারল না ফ্রাঙ্কো!
বিচ্ছেদের পরে মা গ্যাব্রিয়েলার সঙ্গে থাকত ফ্রাঙ্কো। মাকে সাহায্য করার জন্য অড জব করতে শুরু করল। স্কুলে আসা কমে যেতে লাগল। আনিকা ওর সর্বোচ্চ দিয়ে সাহায্য করতে লাগল। করোনা মহামারি এসে ওলটপালট করে দিল সবকিছু। আনিকার বাবা-মা বাড়ি কিনে অনেকটা জোর করে মেয়েকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে চলে গেল বাফেলোতে। অনলাইনে ওদের হাইস্কুলের গ্র্যাজুয়েশন হলো। ফ্রাঙ্কো হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হলো এক বছর পরে।
হাইস্কুল থেকে বের হওয়ার পরে বাবা-মা আনিকাকে বাধ্য করল ইউনিভার্সিটি অব বাফেলোতে ভর্তি হতে। ফ্রাঙ্কো এক বছর পরে হাইস্কুল শেষ করে স্থানীয় এক কমিউনিটি কলেজে ঢুকেছিল, তবে আগের মতো কাজের কারণে ঠিকমতো ক্লাস করত না।
‘তোমার জন্য কফি বানিয়ে এনেছি। এই নাও!’
গ্যাব্রিয়েলার ভারী কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল অন্যমনস্ক আনিকা। গ্যাব্রিয়েলার বানানো গরম কফি গলা থেকে নামার পরে কেমন উষ্ণ হয়ে উঠল ওর পুরো শরীর। বড় করে নিশ্বাস নিয়ে কফির ঘ্রাণ নিল। চারদিকে কী তীব্রভাবে ফ্রাঙ্কোর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে! এই তীব্রতা কমে আসবে ধীরে ধীরে। বাতাসে আর পাওয়া যাবে না কারও দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। ‘কোনোভাবে বুঝতে পারছি না, কীভাবে আমি এত দূরে সরে গেলাম ফ্রাঙ্কোর কাছ থেকে! কীভাবে? যার জন্য আমি সবকিছু ত্যাগ করতে পারতাম, সেই তার অনুপস্থিতি ধীরে ধীরে সয়ে এল!’ নতুন জায়গা, নতুন কলেজ, বন্ধুরা আনিকার মস্তিষ্কের নিউরনে জায়গা করে নিতে লাগল। অথচ ফ্রাঙ্কোর খুব কাছাকাছি থাকা দরকার ছিল ওর!
‘রবার্ট এভাবে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় ফ্রাঙ্কো মনে মনে খুব ভেঙে পড়েছিল, জানো তো?’
কথাটা বলার পরেই আনিকার মনে হলো, না বললেও পারত। কিন্তু এখন তো কথাটা ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। ছেলের সহপাঠীর সামনে এভাবে নিজেকে মেলে ধরার মানুষ নন গ্যাব্রিয়েলা। স্বামী রবার্টের সঙ্গে বিচ্ছেদকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন স্বাভাবিকভাবে নিতে! সাবেক স্বামীর প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না কখনো। যে কারও অধিকার আছে নতুন কারও সঙ্গে জীবন শুরু করার। ‘ফ্রাঙ্কো খুব বাবা অন্তঃপ্রাণ ছিল। মিডল স্কুল থেকে ও শুধু বাবার গল্প করত। ওর বিশ্বাস ছিল সম্পর্কে, বিচ্ছেদে নয়! যে কারণে হয়তো এতগুলো বিচ্ছেদ ও নিতে পারেনি।’ আনিকার কথায় গ্যাব্রিয়েলা অভিব্যক্তিহীন চেহারায় তাকিয়ে থাকেন।
‘ফ্রাঙ্কোকে আমি অনেকবার বলেছি, বাবাকে ক্ষমা করে দিতে! ও পারেনি। বহুবার বলা সত্ত্বেও পারেনি। বাবার সঙ্গে শেষ চার বছর কোনো কথা না বলেই চলে গেল ও। রবার্ট প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে! সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে!’ খুব শান্ত ও ধীর কণ্ঠে কথাগুলো বলেন গ্যাব্রিয়েলা।
আনিকা ঠিক বুঝতে পারে না, মানুষ কীভাবে নিজের আবেগকে এভাবে সংযত রাখতে পারে! বাসায় মাকে দেখেছে সামান্য কিছুতে কীভাবে ভেঙে পড়েন, অথচ গ্যাব্রিয়েলা কত শান্ত, ধীরস্থির! ফ্রাঙ্কোর ঘটনায় রবার্টের মতো আনিকা কি কম দায়ী নয়! অনুতপ্ত তো ওর হওয়া উচিত। অথচ গ্যাব্রিয়েলা আকারে-ইঙ্গিতে সে কথা একবারও বললেন না!
গ্যাব্রিয়েলার চার তলার ফ্ল্যাটে বসার ঘরের জানালাটা বিশাল। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন থাকলে ঘরটা ঝলমল করত। মেঘলা হওয়াতে ঘরে বাড়তি বাতি জ্বালাতে হয়েছে। শোয়ার ঘর থেকে হালকা সংগীতের সুর ভেসে আসছে। গ্যাব্রিয়েলা রেডিও শুনছিলেন হয়তো। আবার না-ও শুনতে পারেন। এমনি চালিয়ে রেখেছেন।
একা ফ্ল্যাটে ধেয়ে আসা বিষণ্নতা আর হাহাকারের মধ্যে মানুষ কী করতে পারে, জানা নেই আনিকার। ও ব্যাগ খুলে কিছু ছবির প্রিন্ট কপি বের করে। গ্যাব্রিয়েলার জন্য নিয়ে এসেছে ও। ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে ওর বিভিন্ন সময়ে তোলা অনেক ছবি। প্রতিটি ছবির সঙ্গে ক্যাপশন লিখে রেখেছে ও। ছবিগুলো গ্যাব্রিয়েলার হাতে দিতে ওকে সামান্য বিস্মিত দেখায়। এই প্রথম গ্যাব্রিয়েলার চেহারায় অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখতে পায় আনিকা। বিস্ময় ক্রমে রূপ নেয় বেদনাময় আবেগে। এমনভাবে ছবিগুলো দেখতে থাকেন, যেন কোনো রত্নভান্ডারের সন্ধান পেয়েছেন।
ফ্রাঙ্কো বলত, ওর মা ছবি তুলতে পছন্দ করেন না! শৈশবে ওর সব ছবি বাবার তোলা! আনিকা বিভিন্ন সময়ে কখনো ফ্রাঙ্কোকে খেপাতে, কখনো আনন্দ দিতে ওর ছবি তুলে রাখত। ওদের স্কুলের ট্রিপের ছবি। স্কুল ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ খাওয়ার ছবি। ক্লাসে বিভিন্ন প্রোগ্রামের ছবি। ওদের ঘোরাঘুরির ছবি। আন্তস্কুল বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে তোলা ফ্রাঙ্কোর ছবি। প্রতিটি ছবি যেন কথা বলছে! বিশ্বাসই হতে চায় না মানুষটি আর নেই! গ্যাব্রিয়েলা আনিকাকে ডাকেনি বাসায় আসার জন্য। ও নিজেই বলেছিল, একদিন বাসায় আসতে চায়। তিন দিন নীরবতার পরে গ্যাব্রিয়েলা সম্মতি জানায়! হঠাৎ চারদিক ঝাপসা করে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আনিকা ভাবতে থাকে, কীভাবে ফিরবে ও। ছাতা বা রেইনকোট কিছুই তো সঙ্গে আনেনি।
চিন্তিতভাবে গ্যাব্রিয়েলার দিকে তাকাতে ওর সারা শরীর কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন গ্যাব্রিয়েলা। এমন আকুল হয়ে নীরবে কেউ কাঁদতে পারে, আনিকার জানা ছিল না। গ্যাব্রিয়েলার কান্না না দেখলে ওর কোনো দিন জানা হতো না, হাসির মতো কান্নারও একটা নির্মল সৌন্দর্য আছে।
‘দোষ তো আমারও ছিল! কেন আমি রবার্টের আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম! ফ্রাঙ্কোকে তো তাহলে এভাবে অড জব করতে হতো না। ও স্কুল আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারত! আমাকে সাহায্য করার জন্য কাজ করতে হতো না। সবার কাছ থেকে পিছিয়ে পড়ে ও যে মানসিকভাবে এতখানি শূন্য হয়ে গেছে, সেটা কখনো বুঝতে চেষ্টা করিনি!’ গ্যাব্রিয়েলার কথায় চারদিক কেমন শূন্য শূন্য লাগতে থাকে আনিকার। শূন্যের ভেতরে যে এত ঢেউ থাকে, কোনো দিন কি ভেবেছিল কেউ!
‘জানেন, এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ার সময়ে আমার ক্রাশ ছিল ডাইনোসর। মিডল স্কুল শুরুর পরে হলো ফ্রাঙ্কো!’
আনিকার কথায় গ্যাব্রিয়েলা জিওভান্নির মুখে হাসি ফুটল কি ফুটল না, ঠিক বোঝা গেল না। কয়েক দিন টানা বৃষ্টির পরে আকাশ যখন পরিষ্কার হতে শুরু করে, তেমন একটি স্মিত ভাব তার চেহারায়। গ্যাব্রিয়েলার নীরবতায় আনিকা চারদিকে শুধু তাকাতে লাগল। এক কোণে একটা টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলো ঘরটাকে ছায়াঘেরা পরিবেশ এনে দিয়েছে। দুই সেট সোফা আর টেবিল ছাড়া ঘরে কোনো আসবাব নেই। দেয়ালে কিছু ছবি আর পেইন্টিং। ফ্রাঙ্কোর শিশু বয়সের ছবি নিয়ে কোলাজ আছে একটাতে। সেদিকে তাকিয়ে আনিকার আবার মনে হলো, ফ্রাঙ্কোর মতো সুন্দর চেহারার মানুষ ও আসলে কোনো দিন দেখেনি।
ফ্রাঙ্কোকে আনিকার ভালো লাগার অনেক কারণ ছিল। মিডল স্কুল ও হাইস্কুলে পড়ার সময়ে দুর্দান্ত অ্যাথলেট ছিল ও। স্কুলের মেয়েরা আড়ালে ফিসফাস করত ফ্রাঙ্কোকে নিয়ে। আনিকার সব সময় সেটা ভালো লাগত না শুনতে।
আনিকাকে ফ্রাঙ্কোর ভালো লাগার তেমন কোনো কারণ ছিল না। হয়তো ওর বুদ্ধিমত্তা ও আর্দ্র হৃদয় আকৃষ্ট করতে পারে ফ্রাঙ্কোকে।
লেখাপড়ায় ভালো হওয়াতে আনিকা ক্লাসের শিক্ষকদের আলাদা মনোযোগ পেত। ক্লাসের পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের সাহায্যের জন্য শিক্ষকেরা ওর সাহায্য নিত। এভাবে ক্যালকুলাসের একটি নিয়ম বোঝাতে গিয়ে ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা। ফ্রাঙ্কোর প্রতি ওর গোপন ক্রাশের কথা আর গোপন থাকল না। সেটাকে পুঁজি করে ফ্রাঙ্কো আনিকাকে খাটিয়ে নিত! মুখে বলত, শিক্ষকদের চেয়ে ওর শেখানোর পদ্ধতি ফ্রাঙ্কোর ভালো লাগে।
আনিকা আর যায় কোথায়! রোজার ঈদে আর কোরবানি ঈদে পাওয়া সেলামির সমুদয় অর্থ ফ্রাঙ্কোকে দিয়ে দিত ও। ভিডিও গেমসের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিল। মা যাতে সন্দেহ না করে এ জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি মিথ্যা কথা বলত। ও তখন সব করতে পারত ফ্রাঙ্কোর জন্য।
শুরুতে মিডল স্কুলে দুজনের সম্পর্ককে আনিকার মা-বাবা কিশোর বয়সের বন্ধুত্ব হিসেবে নিয়েছিল। হাইস্কুলে যাওয়ার আগে বিরাট ঝাঁকুনি খায় ওরা। আনিকা ইচ্ছা করে স্পেশালাইজড স্কুলের পরীক্ষা দেয়নি নানা অজুহাতে। ওর মনে হতো, ফ্রাঙ্কোর খুব কাছাকাছি থাকতে হবে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অত্যন্ত কাছাকাছি। ও কাছে না থাকলে ফ্রাঙ্কোকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। মা-বাবার প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও ওদের সম্পর্ক অব্যাহত রইল। বন্ধুত্ব প্রেমের সম্পর্কে রূপান্তর নিল আর সেটা গোপন থাকল না!
ফ্রাঙ্কোর বিষণ্নতাবোধের সমস্যা ছিল অনেক আগে থেকে। মা-বাবার বিচ্ছেদ সেই সমস্যাকে প্রকট করল। স্থানীয় হাইস্কুলের সাদামাটা পড়াশোনার সঙ্গেও ও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না। দিনের পর দিন অনুপস্থিতি, ক্লাসের পরীক্ষা না দেওয়ায় টুয়েলভথ গ্রেডে উঠতে পারল না ফ্রাঙ্কো!
বিচ্ছেদের পরে মা গ্যাব্রিয়েলার সঙ্গে থাকত ফ্রাঙ্কো। মাকে সাহায্য করার জন্য অড জব করতে শুরু করল। স্কুলে আসা কমে যেতে লাগল। আনিকা ওর সর্বোচ্চ দিয়ে সাহায্য করতে লাগল। করোনা মহামারি এসে ওলটপালট করে দিল সবকিছু। আনিকার বাবা-মা বাড়ি কিনে অনেকটা জোর করে মেয়েকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে চলে গেল বাফেলোতে। অনলাইনে ওদের হাইস্কুলের গ্র্যাজুয়েশন হলো। ফ্রাঙ্কো হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হলো এক বছর পরে।
হাইস্কুল থেকে বের হওয়ার পরে বাবা-মা আনিকাকে বাধ্য করল ইউনিভার্সিটি অব বাফেলোতে ভর্তি হতে। ফ্রাঙ্কো এক বছর পরে হাইস্কুল শেষ করে স্থানীয় এক কমিউনিটি কলেজে ঢুকেছিল, তবে আগের মতো কাজের কারণে ঠিকমতো ক্লাস করত না।
‘তোমার জন্য কফি বানিয়ে এনেছি। এই নাও!’
গ্যাব্রিয়েলার ভারী কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল অন্যমনস্ক আনিকা। গ্যাব্রিয়েলার বানানো গরম কফি গলা থেকে নামার পরে কেমন উষ্ণ হয়ে উঠল ওর পুরো শরীর। বড় করে নিশ্বাস নিয়ে কফির ঘ্রাণ নিল। চারদিকে কী তীব্রভাবে ফ্রাঙ্কোর ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে! এই তীব্রতা কমে আসবে ধীরে ধীরে। বাতাসে আর পাওয়া যাবে না কারও দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। ‘কোনোভাবে বুঝতে পারছি না, কীভাবে আমি এত দূরে সরে গেলাম ফ্রাঙ্কোর কাছ থেকে! কীভাবে? যার জন্য আমি সবকিছু ত্যাগ করতে পারতাম, সেই তার অনুপস্থিতি ধীরে ধীরে সয়ে এল!’ নতুন জায়গা, নতুন কলেজ, বন্ধুরা আনিকার মস্তিষ্কের নিউরনে জায়গা করে নিতে লাগল। অথচ ফ্রাঙ্কোর খুব কাছাকাছি থাকা দরকার ছিল ওর!
‘রবার্ট এভাবে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় ফ্রাঙ্কো মনে মনে খুব ভেঙে পড়েছিল, জানো তো?’
কথাটা বলার পরেই আনিকার মনে হলো, না বললেও পারত। কিন্তু এখন তো কথাটা ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। ছেলের সহপাঠীর সামনে এভাবে নিজেকে মেলে ধরার মানুষ নন গ্যাব্রিয়েলা। স্বামী রবার্টের সঙ্গে বিচ্ছেদকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন স্বাভাবিকভাবে নিতে! সাবেক স্বামীর প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না কখনো। যে কারও অধিকার আছে নতুন কারও সঙ্গে জীবন শুরু করার। ‘ফ্রাঙ্কো খুব বাবা অন্তঃপ্রাণ ছিল। মিডল স্কুল থেকে ও শুধু বাবার গল্প করত। ওর বিশ্বাস ছিল সম্পর্কে, বিচ্ছেদে নয়! যে কারণে হয়তো এতগুলো বিচ্ছেদ ও নিতে পারেনি।’ আনিকার কথায় গ্যাব্রিয়েলা অভিব্যক্তিহীন চেহারায় তাকিয়ে থাকেন।
‘ফ্রাঙ্কোকে আমি অনেকবার বলেছি, বাবাকে ক্ষমা করে দিতে! ও পারেনি। বহুবার বলা সত্ত্বেও পারেনি। বাবার সঙ্গে শেষ চার বছর কোনো কথা না বলেই চলে গেল ও। রবার্ট প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে! সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে!’ খুব শান্ত ও ধীর কণ্ঠে কথাগুলো বলেন গ্যাব্রিয়েলা।
আনিকা ঠিক বুঝতে পারে না, মানুষ কীভাবে নিজের আবেগকে এভাবে সংযত রাখতে পারে! বাসায় মাকে দেখেছে সামান্য কিছুতে কীভাবে ভেঙে পড়েন, অথচ গ্যাব্রিয়েলা কত শান্ত, ধীরস্থির! ফ্রাঙ্কোর ঘটনায় রবার্টের মতো আনিকা কি কম দায়ী নয়! অনুতপ্ত তো ওর হওয়া উচিত। অথচ গ্যাব্রিয়েলা আকারে-ইঙ্গিতে সে কথা একবারও বললেন না!
গ্যাব্রিয়েলার চার তলার ফ্ল্যাটে বসার ঘরের জানালাটা বিশাল। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন থাকলে ঘরটা ঝলমল করত। মেঘলা হওয়াতে ঘরে বাড়তি বাতি জ্বালাতে হয়েছে। শোয়ার ঘর থেকে হালকা সংগীতের সুর ভেসে আসছে। গ্যাব্রিয়েলা রেডিও শুনছিলেন হয়তো। আবার না-ও শুনতে পারেন। এমনি চালিয়ে রেখেছেন।
একা ফ্ল্যাটে ধেয়ে আসা বিষণ্নতা আর হাহাকারের মধ্যে মানুষ কী করতে পারে, জানা নেই আনিকার। ও ব্যাগ খুলে কিছু ছবির প্রিন্ট কপি বের করে। গ্যাব্রিয়েলার জন্য নিয়ে এসেছে ও। ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে ওর বিভিন্ন সময়ে তোলা অনেক ছবি। প্রতিটি ছবির সঙ্গে ক্যাপশন লিখে রেখেছে ও। ছবিগুলো গ্যাব্রিয়েলার হাতে দিতে ওকে সামান্য বিস্মিত দেখায়। এই প্রথম গ্যাব্রিয়েলার চেহারায় অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখতে পায় আনিকা। বিস্ময় ক্রমে রূপ নেয় বেদনাময় আবেগে। এমনভাবে ছবিগুলো দেখতে থাকেন, যেন কোনো রত্নভান্ডারের সন্ধান পেয়েছেন।
ফ্রাঙ্কো বলত, ওর মা ছবি তুলতে পছন্দ করেন না! শৈশবে ওর সব ছবি বাবার তোলা! আনিকা বিভিন্ন সময়ে কখনো ফ্রাঙ্কোকে খেপাতে, কখনো আনন্দ দিতে ওর ছবি তুলে রাখত। ওদের স্কুলের ট্রিপের ছবি। স্কুল ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ খাওয়ার ছবি। ক্লাসে বিভিন্ন প্রোগ্রামের ছবি। ওদের ঘোরাঘুরির ছবি। আন্তস্কুল বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে তোলা ফ্রাঙ্কোর ছবি। প্রতিটি ছবি যেন কথা বলছে! বিশ্বাসই হতে চায় না মানুষটি আর নেই! গ্যাব্রিয়েলা আনিকাকে ডাকেনি বাসায় আসার জন্য। ও নিজেই বলেছিল, একদিন বাসায় আসতে চায়। তিন দিন নীরবতার পরে গ্যাব্রিয়েলা সম্মতি জানায়! হঠাৎ চারদিক ঝাপসা করে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আনিকা ভাবতে থাকে, কীভাবে ফিরবে ও। ছাতা বা রেইনকোট কিছুই তো সঙ্গে আনেনি।
চিন্তিতভাবে গ্যাব্রিয়েলার দিকে তাকাতে ওর সারা শরীর কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন গ্যাব্রিয়েলা। এমন আকুল হয়ে নীরবে কেউ কাঁদতে পারে, আনিকার জানা ছিল না। গ্যাব্রিয়েলার কান্না না দেখলে ওর কোনো দিন জানা হতো না, হাসির মতো কান্নারও একটা নির্মল সৌন্দর্য আছে।
‘দোষ তো আমারও ছিল! কেন আমি রবার্টের আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম! ফ্রাঙ্কোকে তো তাহলে এভাবে অড জব করতে হতো না। ও স্কুল আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারত! আমাকে সাহায্য করার জন্য কাজ করতে হতো না। সবার কাছ থেকে পিছিয়ে পড়ে ও যে মানসিকভাবে এতখানি শূন্য হয়ে গেছে, সেটা কখনো বুঝতে চেষ্টা করিনি!’ গ্যাব্রিয়েলার কথায় চারদিক কেমন শূন্য শূন্য লাগতে থাকে আনিকার। শূন্যের ভেতরে যে এত ঢেউ থাকে, কোনো দিন কি ভেবেছিল কেউ!
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে