‘সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রামের ইতিহাস’, চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরার এই মন্ত্রবাক্য বিস্মৃতির বিরুদ্ধে আমাদের স্মৃতিচর্চাকে উৎসাহিত করে। বিস্মৃতির ছাইয়ে চাপা শত বছর আগের একজন মানুষ, হীরালাল সেনকে নিয়ে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করতে গিয়ে আমার এই ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল। যে চলচ্চিত্রকারের কোনো চলচ্চিত্র আমাদের হাতে নেই, অথচ তাঁর জীবন ও চলচ্চিত্র সম্পর্কে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য আছে পরবর্তী প্রজন্মের কালানুক্রমিক প্রচেষ্টা, যা আমাদের সামনে মানুষটির অবয়ব নির্মাণের সুযোগ রাখে আজও।
দুনিয়ার চলচ্চিত্র মানচিত্রে বাংলা যে এক প্রাচীনতম চলচ্চিত্রদেশ, সে খবর কয়জন রাখে বলুন! বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ১৮৮৯ সালে ‘কিনেটোগ্রাফ’ আবিষ্কার করার পর, মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের মাঝে বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় এ ভূখণ্ডে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর প্রথম খবর। প্রকাশিত সংবাদমতে, কলকাতার ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের এক সাহেবি প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে অভিজাত শ্রেণির মানুষের জন্য ১ রুপিতে চলচ্চিত্র দেখানো হয়।
কলকাতা হাইকোর্টের অখ্যাত আইনজীবী চন্দ্রমোহন সেনের ছেলে হীরালাল সেন তখন সর্বভারতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদকজয়ী আলোকচিত্রশিল্পী। হীরালাল সেন যে সময় আলোকচিত্রে মুনশিয়ানা অর্জন করছেন, ঠিক একই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপজুড়ে চলচ্চিত্রের জন্মলগ্ন চলছে। ১৮৯৪ সালে ‘কিনেটোস্কোপ’ যন্ত্র প্রবর্তিত হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে চলচ্চিত্রের প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে জার্মানিতে প্রদর্শিত হয় ‘বায়োস্কোপ’ এবং ডিসেম্বরে ফ্রান্সে প্রদর্শিত হয় ‘সিনেমাটোগ্রাফ’।
ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে কিনেটোস্কোপ প্রদর্শনীর পরে কলকাতায় বায়োস্কোপ আসে, এর কিছু পর ‘সিনেমাটোগ্রাফ’ যন্ত্র। হীরালালের ছেলে বৈদ্যনাথ সেন বলেছেন, তাঁর বাবা ১৮৯৬ সালে প্রথম চলচ্চিত্র করেছেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম কোনো স্বদেশির চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস। হীরালাল সেন শুধু প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি, ১৮৯৮ সালে ভারতীয় ইতিহাসে প্রথম চলচ্চিত্র সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সে বছর হীরালাল সেন প্রতিষ্ঠিত ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ বর্তমান বাংলাদেশের ভোলা জেলায় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে।
হীরালাল সেন যখন ১৮৯৬ সালে বাংলায় বসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের স্বদেশি নির্মাতাদের বাইরে অন্যান্য জায়গায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় ১৮৯৬ সালে, তবে অজ্ঞাতনামা নির্মাতা কোনো আফ্রিকান নন। এরপর জাপানে শিরো আসানো ১৮৯৮, মেক্সিকোতে সালভাদোর তাসচেনো ১৮৯৮, চীনে রেনে কিংতাই ১৯০৫, মিসরে নাম না জানা একজন ১৯০৭ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এসব প্রাপ্ত তথ্যমতে, হীরালাল সেন হচ্ছেন চলচ্চিত্রের জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাইরে বাদবাকি দুনিয়ার প্রথম কোনো স্বদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা।
কলকাতায় কবে প্রথম চলচ্চিত্র এসেছে, বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। চলচ্চিত্র ইতিহাসবেত্তা কালীশ মুখোপাধ্যায় বলেছেন স্টিফেন্সের কথা, যিনি ১৮৯৬-৯৭ সালের দিকে কলকাতায় চলচ্চিত্র আনেন। চলচ্চিত্র আবির্ভাব গ্রন্থে জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে স্টিফেন্স ও হাডসন নামে দুই সাহেব কলকাতায় চলচ্চিত্র নিয়ে আসেন। শঙ্কর ভট্টাচার্যের রঙ্গালয়ের ইতিহাসভিত্তিক বইয়ের সূত্র দিয়ে নিত্যপ্রিয় ঘোষ জানিয়েছেন, ১৮৯৭ সালের ১৯ জানুয়ারি হাডসন কলকাতায় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শঙ্কর ভট্টাচার্যের ‘রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উপাদান’ গ্রন্থের কোথাও স্টিফেন্সকে খুঁজে পাওয়া যায় না। শঙ্কর ভট্টাচাযের্র রঙ্গালয়ের ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থে স্টিফেন্সের কথা বাদ পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। কারণ, শঙ্কর ভট্টাচার্য শুধু থিয়েটারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন, সুতরাং চলচ্চিত্রের সব বিষয় তাঁর গ্রন্থে গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে থিয়েটারের বাইরে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের খবর তাঁর গবেষণায় উঠে আসেনি। আর কালীশ মুখোপাধ্যায়ের বয়ানে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট, স্টিফেন্স স্টার থিয়েটারের বাইরে মাঠে-ময়দানে তাঁবু টানিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছেন। তাই হয়তো এসব মাঠ-ময়দানের প্রদর্শনীর খোঁজ শঙ্কর ভট্টাচার্যের গ্রন্থে উল্লেখ নেই। আর স্টিফেন্সের স্টার থিয়েটারের প্রদর্শনীর খোঁজ শংকর ভট্টাচার্যের বইতে না থাকার আরও একটি কারণ, তিনি মূলত স্টেটসম্যান পত্রিকার বিজ্ঞাপন নিয়ে কাজ করেছেন। সুতরাং সহজেই বোঝা যাচ্ছে, অন্যান্য সমকালীন পত্রিকার তথ্য তাঁর বইতে স্থান পায়নি।
কালীশ মুখোপাধ্যায় ও জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় তথ্যের সূত্র উল্লেখ না করলেও, ইতিহাস বিশ্লেষণ করে আমরা বরং ১৮৯৬ সালে স্টিফেন্সের মাধ্যমে কলকাতায় চলচ্চিত্র প্রদর্শন হওয়ার তথ্যে যৌক্তিকতা খুঁজে পাই। ১৯২৩ সালে ভারতী পত্রিকায় সৌরেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণমূলক রচনা প্রকাশিত হয়, যেখানে কলকাতার প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অন্তর্নিহিত ইতিহাস রয়েছে। ‘শিবসুন্দর’ ছদ্মনামে তাঁর রচনা ‘বাঙলা বায়োস্কোপ’ প্রবন্ধে ১৮৯৬ সালে মি. স্টিফেন্সের কলকাতায় প্রথম চলচ্চিত্র (বায়োস্কোপ) প্রদর্শনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মূলধারার চলচ্চিত্র ইতিহাসে লুমিয়রদের কোম্পানির মুম্বাইয়ে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসে আরও বলা হয়েছে, লুমিয়েরদের প্রতিনিধি মরিস সেস্তেয়ার মুম্বাইয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পর জাপান হয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন। এখন কথা হচ্ছে, মরিস সেস্তেয়ার মুম্বাইতে চলচ্চিত্র (সিনেমাটোগ্রাফ) প্রদর্শন করলেন অথচ তৎকালীন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার রাজধানী কলকাতায় এলেন না কেন? আবার স্টিফেন্সও লুমিয়েরদের প্রতিনিধি ছিলেন না, কারণ, স্টিফেন্সের চলচ্চিত্র যন্ত্রের নাম ছিল ‘বায়োস্কোপ’, সিনেমাটোগ্রাফ নয়।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়, এই বায়োস্কোপ-এর প্রবর্তক ছিলেন জার্মান ভ্রাতৃদ্বয়, যাঁরা লুমিয়েরদের আগে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছেন জার্মানির বার্লিন শহরে। কিন্তু প্রাধান্যশীল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জার্মান ভাইদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সে আলোচনায় আপাতত না-ই গেলাম। এ পর্যায়ে কলকাতায় চলচ্চিত্র আগমনের ইতিহাসে স্থির থাকি। তাহলে কি ইতিহাসটা এমন: মরিস সেস্তেয়ার ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই যখন লুমিয়েরদের সিনেমাটোগ্রাফ নিয়ে হাজির হয়েছেন মুম্বাইতে, সে সময় (বা তার আগে থেকে) কলকাতায় জার্মান ভাইদের বায়োস্কোপ নিয়ে অবস্থান করছিলেন স্টিফেন্স! আমরা কিন্তু ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছি ১৮৯৫ সালের শেষের দিকে কলকাতায় প্রথম কিনেটোস্কোপ (চলচ্চিত্র) প্রদর্শনের খবর।
যে কারও মনে সহজ জিজ্ঞাসা জাগতে পারে, তাহলে মূলধারার চলচ্চিত্র ইতিহাসে কলকাতা এবং হীরালাল সেনের চলচ্চিত্রের ইতিহাস বাদ পড়ল কী করে? আমরা এর যৌক্তিক উত্তর সন্ধান করেছি। আমরা জানি, ভারতের চলচ্চিত্র-ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণ শুরু হয়েছে ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রকাশিত রঙ্গাচারিয়া প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র তদন্ত ও উন্নতি করার লক্ষ্যে মাদ্রাজের বিশিষ্ট আইনজীবী দেওয়ান বাহাদুর রঙ্গাচারিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে ১৯২৭ সালে।
১৯২৮ সালের মে মাসে কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। রঙ্গাচারিয়া কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদন থেকেই পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাস লেখা হয়। রঙ্গাচারিয়া প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেল, এই কমিটি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে কোনো মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করেনি। অথচ এই অপূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনকে এতকাল ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের আকরিক তথ্যভান্ডার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সে সময় রঙ্গাচারিয়া কমিটি যদি কলকাতার চলচ্চিত্র ইতিহাসকে ওই প্রতিবেদনে সংযুক্ত করত তবে উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সূচনাপর্ব নিয়ে এত ধূম্রজাল তৈরি হতো না।
কলকাতায় চলচ্চিত্রের গোড়ার ইতিহাসের সঙ্গে হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। কলকাতার সাধারণ মানুষ বায়োস্কোপই প্রথম দেখেছে। আর তাইতো চলচ্চিত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে এখানকার মানুষেরা বায়োস্কোপ শব্দটিকে আজও ব্যবহার করে থাকেন। হীরালাল সেনও বায়োস্কোপে আকৃষ্ট ছিলেন, তাইতো আমরা দেখতে পাই, তাঁর কোম্পানির নামের সঙ্গে বায়োস্কোপ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।
হীরালাল সেন স্টিফেন্সের বায়োস্কোপ দেখে ক্ষান্ত হননি। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্যমতে, স্টিভেনসনকে (স্টিফেন্সকে) সেলামি দিয়ে বায়োস্কোপে চলচ্চিত্র ধারণ করেছেন। কিরণময় রাহা তাঁর ‘বেঙ্গলি সিনেমা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, স্টিফেন্স ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় ঘোড়দৌড় ও রেলওয়ের চলমান দৃশ্য ধারণ করেছিলেন।
যেহেতু আমরা এখনো নিশ্চিত নই স্টিফেন্স ঠিক কবে বায়োস্কোপ নিয়ে কলকাতায় এসেছেন, আর ঠিক কবে থেকে কলকাতায় চলচ্চিত্র ধারণ শুরু করেছেন, তাই প্রভাত মুখোপাধ্যায় ও কিরণময় রাহার দেওয়া এই তথ্যযুগল থেকে এটা স্পষ্ট, হীরালাল সেন ওই সময় (ডিসেম্বর ১৮৯৬) বা তার আগে স্টিফেন্সকে সেলামি দিয়ে চলচ্চিত্র (একচুয়েলিটি) ধারণ করেছিলেন, যেভাবে সে সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। হীরালালের ছেলে বৈদ্যনাথ সেনও একই সালের (১৮৯৬) কথা উল্লেখ করে গেছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, কালীশ মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বৈদ্যনাথ সেন জানিয়েছেন, তাঁর বাবা ১৮৯৬ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। কালীশ মুখোপাধ্যায় যদিও তাঁর ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে এবং ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত গ্রন্থে হীরালালের চলচ্চিত্র নির্মাণের এ তথ্য গ্রহণ করতে পারেননি, তখন পর্যন্ত তিনি জানতেন হীরালাল সেন ১৯০৩ সালে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। কিন্তু সে সময় কালীশ মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রকাশের পর রামপতি দত্ত জানালেন, হীরালাল সেন ১৯০০ সালে ক্লাসিক থিয়েটারে নিজের নির্মাণ করা বায়োস্কোপ দেখিয়েছেন।
রামপতি দত্তের এ তথ্য পেয়ে কালীশ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণা জারি রাখেন। তিনি ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত আরেক প্রবন্ধে এবং ১৯৭২ সালে তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে ১৯০০ সালে হীরালাল প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বলে জানান। পরবর্তীকালে কালীশ মুখোপাধ্যায়, গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ ঘোষ, অনুপম হায়াৎ, সৈকত আসগর, সজল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক-গবেষক থিয়েটারনির্ভর ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে ১৮৯৮ সালে হীরালালের চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা উল্লেখ করে গেছেন। যথাযথ গবেষণার অভাবে বৈদ্যনাথ-প্রদত্ত তথ্য তখনো কেউ গ্রহণ করেননি।
কালীশ মুখোপাধ্যায় লিখছেন—
‘১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে স্বর্গগত হীরালাল সেন আলীবাবা চিত্র তোলেন বলে বৈদ্যনাথ সেন অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে এই উক্তি সমর্থনযোগ্য নয়। বৈদ্যনাথ বাবু সাধারণ ধারণা থেকেই এ কথা বলেছেন আমার বিশ্বাস।’
সে সময়ে কালীশ মুখোপাধ্যায়ের এমন অবিশ্বাস হওয়ার ঘটনা অমূলক ছিল না। তখন পর্যন্ত ভারতীয় গবেষকদের জানা ছিল না ফরাসি সিনেমাটোগ্রাফ-এর আগে জার্মান বায়োস্কোপ-এর ইতিহাস। এবং সেই বায়োস্কোপ কলকাতায় প্রদর্শনের ইতিহাস। বৈদ্যনাথের তথ্য বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, তখন পর্যন্ত এসব তথ্য অনাবিষ্কৃত থাকা।
বৈদ্যনাথ সেনের তথ্যেও ভ্রান্তি একটা ছিল। তিনি ১৮৯৬ সালে ‘আলীবাবা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। অথচ ‘আলীবাবা নাটক’ (যা থেকে হীলালাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন) প্রথমবারের মতো থিয়েটারে আসে ১৮৯৭ সালে। বাবার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সাল (১৮৯৬) ঠিকঠাকভাবে উল্লেখ করলেও, হীরালালের ছেলে চলচ্চিত্রের নাম বলতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। গুলিয়ে ফেলার কারণ, হীরালাল সেনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের নাম আলীবাবা (১৯০৩)। নরেন দেব, কালীশ মুখোপাধ্যায়, প্রভাত মুখোপাধ্যায় ও পরবর্তী গবেষকগণ গুলিয়েছেন অন্য আরেক জায়গায়, সেটা হচ্ছে ‘স্টিফেন্স/স্টিফেনস’ এবং ‘ষ্টিভেনসন/স্টিফেনসন’ নামে। এখন আমরা সে আলোচনায় পদার্পণ করছি।
প্রভাত মুখোপাধ্যায় তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘নরেন দেবের বক্তব্য অনুযায়ী হীরালাল প্রথম দিনই স্টার থিয়েটারে বায়োস্কোপ দেখেছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বায়োস্কোপের কর্তা স্টিভেনসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপরই হীরালাল উঠেপড়ে লেগে যান টাকার ব্যবস্থা করতে, আর বাবা চন্দ্রমোহন টাকা দিতে অস্বীকৃত হওয়ায় টাকাটা দেন তাঁর মা। ওই টাকা তিনি স্টিভেনসনকে সেলামি দিয়ে তাঁর নির্দেশনায় প্রথম ছবি করেন ‘ফ্লাওয়ার অব পার্সিয়া’ অপেরার একটি নৃত্যদৃশ্য।
বর্তমানে আমরা জানি, মি. স্টিফেন্স ও জে. জে. স্টিভেনসন দুজন আলাদা ব্যক্তি। কলকাতায় মি. স্টিফেন্সের চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট উপস্থিতি লক্ষ করা যায় ১৮৯৬ সালের দিকে, সে সময় তিনি বায়োস্কোপ নিয়ে আসেন। জে. জে. স্টিফেনসনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় ১৮৯৭-৯৮-এর দিকে এবং তারও পরে ১৮৯৯ সালের দিকে টি. জে. স্টিভেনসন নামে আরেক ব্যক্তি রয়্যাল বায়োস্কোপের সঙ্গে কাজ করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে, বৈদ্যনাথের দেওয়া তথ্যকে (প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সাল ১৮৯৬) গ্রহণ করে নিচ্ছি, হীরালাল ১৮৯৬ সালে চলচ্চিত্র করেছেন। সে সময় স্টিফেন্সকে সেলামি দিয়ে তাঁর ক্যামেরায় হীরালাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, স্টিভেনসনকে সেলামি দিয়ে নয়। ফ্লাওয়ার অব পার্সিয়া (১৮৯৮) কিংবা আলীবাবা (১৯০৩) নয়, এ সময় নির্মাণ করেন নাম না জানা অন্য কোনো চলচ্চিত্র। স্টিফেন্সের বায়োস্কোপ যন্ত্রে হাতেখড়ি বলে পরবর্তীকালে হীরালাল নিজের কোম্পানির নামের সঙ্গে বায়োস্কোপ শব্দটি জুড়ে দিয়েছেন। কলকাতায় চলচ্চিত্র আগমনের ইতিহাস এবং হীরালাল সেনের চলচ্চিত্রযাত্রার শুরুর ইতিহাস এক সূত্রে গাঁথা। এ ব্যাপারে আমরা বিদ্যমান ইতিহাস পুনর্গঠন করার প্রস্তাব রাখছি।
সেকালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষক ফাদার লাফো প্রযুক্তিগত বিষয়ে প্রাগ্রসর ছিলেন। বিশ্ববিজয়ী বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন এই ফাদার লাফোরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের প্রদর্শন ব্যবসায়ী জে. জে. স্টিভেনসনকে কলকাতায় আমন্ত্রণ জানান। স্টিফেন্স চলে যাওয়ার পর, হীরালাল সেন জে. জে. স্টিভেনসনের কাছে গিয়ে তেমন কোনো সহযোগিতা লাভ করেন না। পরে বিদেশি পত্রিকার বিজ্ঞাপন ঘেঁটে লন্ডনের ১৫০ নম্বর গ্রেজইন রোডের ‘জন রেঞ্জ অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানি থেকে হীরালাল চলচ্চিত্র সরঞ্জামাদি আনান এবং ১৮৯৭ সালের শেষাশেষি নিজের ক্যামেরায় চলচ্চিত্রচর্চা শুরু করেন।
১৮৯৮ সালে হীরালাল সেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি খোলেন। সে বছরই বাংলাদেশের ভোলায় এসডিও কার্যালয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন। এখানে হীরালাল সেনের নির্মিত জানা-অজানা সব চলচ্চিত্রের নাম উপস্থাপন করা গেল না। সৈকত আসগর প্রদত্ত তথ্যমতে, ৪৩টি চলচ্চিত্রের নাম পাওয়া যায়। তবে কোনো কোনো গবেষকের মতে, ছোট-বড় মিলিয়ে তিনি শতাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এই সৃষ্টিশীল মানুষটির জীবনের শেষের দিনগুলো কেটেছে চরম সংকটের মধ্যে। তিনি অসুস্থতার মধ্যে লোকের ছবি এঁকে, বাড়ি বিক্রি করে, ক্যামেরা বন্ধক রেখে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করেছেন।
হীরালালের অবয়ব নির্মাণ করতে গিয়ে একদিকে আমরা যেমন পাই বিস্মৃতিকে পুঁজি করে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাধান্যশীল অংশের অনীহা, অন্যদিকে পাই নানা মানুষের সত্যাগ্রহী চেষ্টা। এসব অনীহার পেছনে বিরাজ করে, এক ধরনের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও জাতীয়তাবাদী অন্তর্দ্বন্দ্ব। বিপ্রতীপে, বিস্মৃতির আড়াল থেকে মানুষের স্মৃতি খোঁজার নিরন্তর সাধনা আমাদের উৎসাহিত করে নতুন পাঠ আস্বাদনে।
(স্বজন মাঝি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা, দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন হীরালাল সেনের ওপর পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে)