একটি কবিতার জন্ম

মশিউল আলম
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯: ৫৬

পথে-প্রান্তরে সোনা ঝরিয়ে যে শরৎ চলে গেল, বনে-বনে-আগুন-লাগা সেই দিনগুলোতে আমরা জড়ো হয়েছিলাম আমেরিকার মিডওয়েস্টে, তৃণভূমি আর ভুট্টাখেত পরিবেষ্টিত আইওয়া সিটিতে। আমরা ৩২ দেশের ৩৩ জন। কেউ কবিতা লিখি, কেউ গল্প-উপন্যাস, কেউ নাটক; কেউ কেউ আবার একই হাতে লিখি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, এমনকি গানের বাণীও। একজন বলে সে শুধু ইশতেহার লেখে, আর লেখে ই-মেইল। ককেশাস পাহাড়ের দেশ জর্জিয়া থেকে আসা ছিপছিপে সুন্দর তরুণী ঔপন্যাসিক নানা আবুলাদজে বলে, সে জীবনে কখনো কবিতা লেখেনি; কবিদের দিকে বিস্ময়মাখা চোখে চেয়ে সে শুধায়: কী করে কবিতা হয় তোমাদের হাতে?

আইওয়া সিটি থেকে একবার আমরা দুদিনের জন্য দল বেঁধে বেড়াতে গেলাম শিকাগো শহরে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে লেক মিশিগানের তীরবর্তী ওই শহরে কী প্রবল ঠান্ডা বাতাসই না বইছিল! বিশাল সে শহর, দুদিনে আমরা যা দেখলাম, তা অতি সামান্য। কিন্তু মনে দাগ কেটে দিল শিকাগো। কারও কারও জন্য বেশ গভীর হলো সে দাগ। অন্তত একজনের লেখালেখির জীবনটাই বুঝি খানিক বদলে গেল। অবশ্য তখন আমরা তা বুঝতে পারিনি।

৩১ অক্টোবর ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ার ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম ২০২২ শেষ হয়েছে। আমরা নিজ নিজ দেশে ফিরেছি। কিন্তু কেউ কাউকে ভুলতে পারছি না: হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চ্যাটে দিনরাত চলছে আমাদের বার্তা চালাচালি; ছবি, ভিডিও ইত্যাদি বিনিময়। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ নানা আবুলাদজের একটা সারপ্রাইজ বার্তা: ‘প্রিয় বন্ধুরা, অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে, দ্যাখো’। তারপর ‘ভয়েস অ্যান্ড ভার্স পোয়েট্রি’ ম্যাগাজিনের একটা লিংক; সেটা খুলে দেখা গেল, হংকংয়ের বিখ্যাত এই পোয়েট্রি ম্যাগাজিনের ৬৯তম সংখ্যায় প্রকাশিত হবে নানা আবুলাদজের লেখা একটা কবিতা। সে কবিতার নাম ‘দ্য ওয়াটার টাওয়ার’, নানা এটা লিখেছে ইংরেজিতে, অথচ সে লেখালেখি করে জর্জিয়ান ভাষায়।

মানে, আমাদের সেই শিকাগো সফর নানা আবুলাদজের কবিতা লেখার উদ্বোধন ঘটিয়েছে। এই কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নানা লিখেছে, ‘আমি যখন বলি যে এই শরতে ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ আমার জন্য জীবন বদলে-দেওয়া একটা অভিজ্ঞতা, তখন লোকজন বলে, আরে, তোমার কালচার শক হয়েছে। ও কিছু না, কেটে যাবে। কিন্তু না, আমার জন্য এটা কালচার শক নয়। এই কবিতা তার প্রমাণ, আমি কবিতা লিখি না। উপরন্তু আমি ইংরেজিতে লিখি না।

তবিলিসিতে ফিরে আসার পর প্রথম সপ্তাহটা আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর ছিল। আমি রাতে ঘুমোতে পারতাম না। তখনই কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তিটা আসে। ওই সপ্তাহেই লেখা হয় ‘দ্য ওয়াটার টাওয়ার’। প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে আমাদের শিকাগো বেড়াতে যাওয়া বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে শহরটার বিশিষ্টতা—সব সময় বাতাস বয় সেখানে।

তারপর মনে পড়ল ওয়াটার টাওয়ার নামের বিল্ডিংটার কথা। এর পেছনে যে ভীষণ অন্য রকমের একটা গল্প আছে, তা জানার আগেই ওটার সামনে গিয়ে হাজির হয়েছি। আর সমস্ত বিল্ডিং থেকে ওটা এত আলাদা যে কাছকাছি গেলেই তফাতটা বোঝা যায়। মনে আছে, কী অপ্রত্যাশিতভাবে আর হঠাৎ করে ওটা আমার নজরে এসেছিল। এমনকি একটা দেয়ালে ওটার নামও পড়েছিলাম। কবিতার চিত্রকল্পটা এভাবেই এসেছে। তারপর এসেছে শব্দগুলো।

ভূমিকা ও অনুবাদ: মশিউল আলম

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত