চট্টগ্রামে কারখানার পোড়া চিনি পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে

সৌগত বসু, সাইফুল মাসুম ও রাসেল মাহমুদ, ঢাকা
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪, ২০: ৫১
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪, ২৩: ৩৫

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের এক দিন পার হলেও এখনো আগুন জ্বলছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ করছে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড। আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই-তিন দিন লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবদুর রাজ্জাক।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, গুদামে পানি দেওয়ার পর পুরো কারখানা এলাকায় গলিত চিনির কালো প্রলেপ ছড়িয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ক্লান্ত হয়ে দায়িত্ব বদল করে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। গুদামের ভেতর জ্বলছে আগুন।

এদিকে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে চিনির কাঁচামালের আগুনে পোড়া বর্জ্যগুলো কারখানার ড্রেন দিয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। এতে করে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

পোড়া চিনির বর্জ্যের কারণে পাশের কর্ণফুলী নদীর একটি অংশের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। ড্রেন ও নালার মধ্য দিয়ে এসব বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ার কারণে এ দূষণ হচ্ছে। এতে নদীর পানির ইকো সিস্টেম নষ্ট হতে পারে জানিয়ে অবিলম্বে এ দূষণ বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। এ ছাড়া পুড়ে অঙ্গার হওয়া চিনির ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে ওই এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, এটা একটা জরুরি অবস্থা। এ অবস্থায় অগ্নিনির্বাপণের পানি কোথায় গিয়ে পড়ছে তা দেখার সুযোগ নেই। আগুন থেকে সৃষ্ট বর্জ্যের কারণে নদীর পানির স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কর্ণফুলী নদীতে যেহেতু জোয়ার ভাটা হয় তাই এ সংক্রান্ত দূষণের স্থায়িত্ব বেশি হবে না বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা।

পোড়া চিনির বর্জ্যে পরিবেশ দূষণের শঙ্কা। ছবি: আজকের পত্রিকাএকই বিষয়ে পরিবেশবিদ প্রফেসর ইদ্রিস আলী বলেন, চিনি কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের পরমাণু দিয়ে তৈরি। তাপ দেওয়ার কারণে আগুনের সঙ্গে এ উপাদানগুলো বিক্রিয়া করে তরলে পরিণত হয়। তাপের ফলে চিনির পরমানুগুলো বাতাসে অক্সিজেনের সঙ্গে নতুন গ্রুপের পরমাণু সৃষ্টি করে। এই বিক্রিয়ায় চিনি কালো হয়ে ধোঁয়া ও শক্তি বের করে দেয়। পুড়লে কালো কয়লার মতো হয়ে যায়। এ থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ও বাতাস পরিবেশের ক্ষতি করে।

তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ড থেকে সৃষ্ট বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে যাতে না পড়ে; এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

কর্ণফুলী এলাকার ইছানগরের এস আলম সুগার মিলে অগ্নিকাণ্ডের ফলে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিবেশ দূষণের ফলে নানা রোগ ব্যাধির আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

গতকাল সোমবার বিকেল ৪টায় লাগা আগুনে ধোঁয়াও বের হচ্ছে এখনো। অপরদিকে আগুন আগা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে একরাতেই বেড়ে গেছে চিনির দাম। গত সোমবার রাত থেকে খুচরা বাজারে চিনির দাম ১৪০ টাকা নিলেও মঙ্গলবার ১৪৫-১৫০ টাকা করে চিনি বিক্রি করছে বলে ক্রেতারা অভিযোগ করেন।

পোড়া চিনির বর্জ্য গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। ছবি: আজকের পত্রিকাকারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিনিকলটির পাঁচটি গুদাম রয়েছে। প্রতিটি গুদামের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার মেট্রিক টন। কারখানার এক নম্বর গুদামে আগুন লাগে। আগুন লাগার সময় কারখানার উৎপাদন চালু ছিল। কারখানাটিতে প্রায় সাড়ে ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। আগুন লাগার পর কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকে কারখানার মালিক পক্ষের লোকজন ও বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন।

এ ঘটনা তদন্তে নয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সার্বিক ও ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা।

মঙ্গলবার দুপুরে কর্ণফুলীর ইছানগর গ্রামে অবস্থিত কারখানা পরিদর্শন করেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপক (এমডি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।

মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা এই ধরনের পরিস্থিতিকে পুঁজি করতে চান। তবে আমাদের কাছে ইতিমধ্যেই সরবরাহ করার জন্য চিনির পর্যাপ্ত স্টক রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। আসন্ন রমজানে চিনির সরবরাহে এই অগ্নিকাণ্ডের প্রভাব বাজারে পড়বে না। এ রকম কোনো সমস্যা হয় কিনা আমি তা দেখে গেলাম।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দু’একদিনের জন্য কারসাজি করতে পারে। তবে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো দু’একদিনের জন্য হবে আরকি। দুই একদিন পর থেকে আমার ডেলিভারি শুরু হয়ে যাবে। প্রোডাকশন চালু করব এবং বানানো মাল আছে। তা দিয়ে এক সপ্তাহ মিনিমাম চলবে। প্রোডাকশনে যেতে সময় লাগবে দুই দিন। আর সমস্যা হবে না। এগুলো সমস্যা নাই, মালেরও সমস্যা নাই। মেইনলি আগুনটা নিভে গেলে হয়ে যাবে। ইনশা আল্লাহ।’

এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) মো. আখতার হোসেন বলেন, ‘কারখানার একটি গুদামে আগুন লাগলেও আরও চারটি গুদাম অক্ষত রয়েছে। তাই দু-এক দিনের মধ্যে পুরোদমে উৎপাদনে ফিরে আসতে পারব আমরা। আশা করি বাজারে চিনির দামে প্রভাব পড়বে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত