শ্রীপুরে শিল্পায়নের আগ্রাসনে কমছে কৃষিজমি

রাতুল মণ্ডল, শ্রীপুর (গাজীপুর) 
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ২০: ৩১

গাজীপুরের শ্রীপুরে শিল্পায়নের আগ্রাসনে দিন দিন কমছে কৃষিজমি। রাতারাতি কৃষিজমিতে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। শিল্পমালিকেরা সাধারণ কৃষকদের জমি উচ্চমূল্যে নিয়ে গড়ে তুলছেন বহুতল ভবন। আবার কোনো কোনো শিল্পমালিক সুকৌশলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে হাতিয়ে নিচ্ছেন অসহায় কৃষকের ফসলি জমি। শিল্পায়নের ফলে প্রতিবছর কমছে কৃষি উৎপাদন। যত্রতত্র শিল্পায়নের ফলে বন্ধ হচ্ছে জলধারা তাতে করে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার মধ্যে কৃষিজমিতে বেশি শিল্পায়ন হয়েছে মাওনা, গাজীপুর ও তেলিহাটি ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকায়। এই তিনটি ইউনিয়ন ও পৌর এলায় গত কয়েক বছরে অর্ধশতাধিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। মাওনা ইউনিয়নের মাথারপাড়া গ্রামের লবলঙ্গ নদীঘেঁষা পাথারের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব জমিতে কৃষকেরা ধান, সরিষা, শাকসবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদন করতেন।

স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে প্রথমে কিছু জমি উচ্চমূল্যে কিনে সীমানা প্রাচীর দিয়ে পাশের জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করা হয়। পরে সাধারণ কৃষক শিল্পমালিকদের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে সেই জলাবদ্ধ জমি কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া যথাযথ কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণেও অনেক কৃষিজমি কৃষকের হাতছাড়া হয়। মাওনা গাজীপুর ইউনিয়ন পাথারে গড়ে তোলা হয়েছে মেঘনা ও ডিবিএল গ্রুপের বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। শ্রীপুর পৌরসভার বেড়াইদেরচালা গিলারচালা এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ইকো কটন মিলস। এ ছাড়া মাওনা শ্রীপুর পৌরসভা এলাকায় নির্মাণাধীন বেশ কয়েকটি কারখানার সাইনবোর্ড না থাকায় তথ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মাওনা ইউনিয়নের ধনুয়া গ্রামে ডেকো নামক একটি পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কৃষকদের জমি দখল করে বালু ভরাট করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নে নোমান গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে কৃষি জমির ওপর। তেলিহাটি ইউনিয়নের টেপিরবাড়ি এলাকায় বিভিন্ন শিল্পমালিকের বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া গাজীপুর ইউনিয়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের মালিকানাধীন একটি কারখানা কৃষিজমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে দখলে নেওয়া হয়েছে লবলঙ্গ নদী।

ধনুয়া গ্রামের ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ডেকো নামক পোশাক কারখানা রাতারাতি সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে আমাদের ধানের জমি দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। পরে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সমাধান পাইনি। কিছু করতে না পেরে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে বসে আছি।’

ধনুয়া গ্রামের ভুক্তভোগী কৃষক আলাল মিয়া বলেন, ‘শিল্পমালিকেরা প্রথমে অল্প জমি কেনে। এরপর সেখানে বিশাল সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এরপর কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে জমি হাতিয়ে নেয়। এ রকম ভুক্তভোগী কৃষক শত শত, শুধু আমি একা নই।’

স্থানীয় সমাজকর্মী মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘রাতারাতি আমাদের চোখের সামনে সবুজ ফসলের মাঠে গড়ে উঠেছে ইট পাথরের উঁচু দালান। বিভিন্ন ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে কৌশলে চালা জমি বানিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। দখল করা হচ্ছে জলাধার, ছোট ছোট খাল। তাতে দিন দিন কমছে ফসলি জমি। পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।’

ইকো কটন মিলস লিমিটেডের দায়িত্বে থাকা মো. তাজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জমি কেনার বিষয়ে আমি কোনো তথ্য দিতে পারব না। আপনি হেড অফিসে যোগাযোগ করেন।’

নদী পরিব্রাজক দল শ্রীপুর শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘লবলঙ্গ নদীর উৎপত্তিস্থল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র আতিকুল ইসলাম দখলে নিয়েছেন। এটা নিয়ে আমরা ইতিপূর্বে অনেক প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুমাইয়া সুলতানা বর্না বলেন, কৃষি জমিতে শিল্পায়ন হওয়ার ফলে উপজেলায় প্রতিবছর কমছে কৃষি উৎপাদন। এটি বন্ধ না করতে পারলে শিল্পায়নের আগ্রাসনে কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে।

শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আল মামুন বলেন, কৃষিজমি রক্ষায় শিল্পকারখানার নামজারির জন্য জমা দেওয়া কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে তারপর কনফার্ম করা হয়। এ বিষয়ে ইউনিয়ন তহসিল অফিসগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে।

শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র মো. আনিছুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, কৃষিজমিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য শিল্পমালিকদের অনুমতিপত্র দেওয়া হয় না। কৃষিজমি রক্ষা করতে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বর্তমানে জমির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকে।

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীমা ইয়াসমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ২০১৫ সালে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিন ফসলি ও দুই ফসলি জমিতে শুধু শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়, বাড়িঘরও করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কৃষিজমিতে গড়ে তোলা নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। আমরা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ছাড়পত্র দিয়ে থাকি। কিছু কারখানা পরিবেশ অধিদপ্তরকে ফাঁকি দিয়ে যত্রতত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত