উপপরিচালক মুক্তির ‘ঘুষ-বাণিজ্য’ থেকে মুক্তি নেই বীজ ডিলারদের

  • চাহিদামতো ঘুষ পাওয়ার পর বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে দেন বীজের বরাদ্দ।
  • যেসব ডিলার বেশি ঘুষ দেন, তাঁরা বীজের বরাদ্দও পান তুলনামূলক বেশি।
  • দাম বেড়ে যাওয়ায় বিএডিসির বীজের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকেরা।
সাজন আহম্মেদ পাপন, কিশোরগঞ্জ
Thumbnail image
এ কে এম মনিরুজ্জামান মুক্তি। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক (বীজ বিপণন) এ কে এম মনিরুজ্জামান মুক্তির বিরুদ্ধে বীজ বরাদ্দে ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ডিলারদের দাবি, মোটা অঙ্কের ঘুষ ছাড়া কোনো ডিলারকে বীজ বরাদ্দ দেন না মুক্তি। চাহিদামতো ঘুষ পাওয়ার পর বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে তিনি বীজের বরাদ্দ দেন। যেসব ডিলার বেশি ঘুষ দেন, তাঁরা বীজের বরাদ্দও পান বেশি। এতে বীজ বরাদ্দে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন ডিলাররা। ঘুষ দিয়েও বেশ কয়েকজন ডিলার বীজ না পাওয়ায় উপপরিচালক মুক্তির ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।

ভুক্তভোগী ডিলারদের একজন অলিউল ইসলাম। তিনি জানান, গত ৪ নভেম্বর বীজ উত্তোলনের জন্য গুদামে যান তিনি। গুদামরক্ষক শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবের কাছে গেলে হাতের ইশারায় অতিরিক্ত টাকা নিয়ে উপপরিচালকের (বীজ) কাছে যেতে বলেন। সেখানে গেলে উপপরিচালক জানান, বীজের বরাদ্দের সময় শেষ। এখন বীজ নিতে হলে প্রতি টনে দুই হাজার এবং মধুপুরের বীজ (টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় বিএডিসির খামারে উৎপাদিত) নিতে হলে প্রতি টনে তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। ডিলারশিপ টিকিয়ে রাখতে মধুপুরের পাঁচ টন ব্রি-২৯ জাতের ধানের বীজ চান অলিউল। এ জন্য তাঁর কাছে ১৫ হাজার টাকা চাওয়া হলেও পরে দর-কষাকষি করে ১২ হাজার টাকায় রাজি করান তিনি। পরদিন অলিউলের বাড়িতে মধুপুরের বীজ না পাঠিয়ে অন্য বীজ পাঠানো হয়।

অলিউল আরও জানান, মধুপুরের বীজের জন্য দেওয়া টাকা ফেরত নিতে গত ১০ নভেম্বর উপপরিচালক মুক্তির কাছে যান তিনি। পরে গুদামরক্ষক শুভ্রানিয়ামের কাছে পাঠালে অলিউলকে পাঁচ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়। বাকি ৭ হাজার চাওয়ায় মুক্তি ও শুভ্রানিয়াম মিলে মারধর করেন অলিউলকে।

এ ঘটনায় গত ২০ নভেম্বর বিএডিসির মহাব্যবস্থাপকের (বীজ) কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী অলিউল।

একইভাবে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন ডিলার আখেরুল বাবু। বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে তাঁকে ১০ টন ডায়মন্ড আলুর বীজের বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁকে পাঁচ টন বীজ সরবরাহ করা হয়। বাকি পাঁচ টন বীজ না পেয়ে তিনি এ নিয়ে দেনদরবার করেন। এ পরিস্থিতিতে তাঁকে ঘুষের এক লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয় এবং পাঁচ টন বোরোর বীজ সরবরাহ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বিএডিসির ২৯৫ জন বীজ ডিলার রয়েছেন। তাঁদের প্রায় সবাইকে একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মুক্তিকে কমবেশি ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করে বীজের বরাদ্দ নিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাঁদের কাছ থেকে তিনি বেশি ঘুষ পেয়েছেন, তাঁদের বেশি বরাদ্দ দিয়েছেন। মুক্তির এ ঘুষ-বাণিজ্যের সহযোগী ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা শিউলী আক্তার এবং সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা গুদামরক্ষক শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব। ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর মুক্তি নিজের অপকর্ম ঢাকতে শুভ্রানিয়ামকে পাকুন্দিয়া উপজেলায় বদলি করে দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশেষ এই টোকেন হাতে থাকলে সিরিয়াল ছাড়া পছন্দমতো বীজ সংগ্রহ করা যায়। উপপরিচালক মুক্তির স্বাক্ষর করা একটি বিশেষ টোকেনের ছবিতে দেখা যায়, এক ডিলারকে ১০ টন ডায়মন্ড আলুবীজের একটি বিশেষ টোকেন দিয়েছেন তিনি। একসঙ্গে ১০ টন একজনকে দিলে সমালোচনায় পড়তে পারেন, তাই দুই ভাগে লিখে দিয়েছেন। এই বিশেষ টোকেনপ্রাপ্ত ডিলারের কাছ থেকেও ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব টোকেনের মাধ্যমে আলুবীজের কেজিপ্রতি ৩-১০ টাকাও নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার কেজিপ্রতি অতিরিক্ত টাকা নিয়েও বীজ কম দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মুক্তির বিরুদ্ধে।

ডিলাররা বলছেন, বীজ বরাদ্দে বিভিন্ন উপজেলায় বৈষম্য করেছেন উপপরিচালক মুক্তি। ইটনার কোনো ডিলারকে আগাম জাতের ধান ব্রি-৮৮-এর এক গ্রাম বীজও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে পাকুন্দিয়ার প্রত্যেক ডিলারকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭০০ কেজি। হাওরবেষ্টিত অষ্টগ্রামের প্রত্যেক ডিলারকে ব্রি-৮৮ ভিত্তি বীজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪০ কেজি। আর মান ঘোষিত ব্রি-৮৮ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে পাঁচ টন।

চলতি মৌসুমে কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে মোট বরাদ্দ আসে ৩ হাজার ২০০ টন। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪৫০ টনের মতো বীজ বিক্রি হলেও অবিক্রীত রয়ে গেছে ১ হাজার ৭৫০ টন। এতে চলতি মৌসুমে সরকারের লোকসান গোনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। অবীজ (খাদ্য) হিসেবে বিক্রি করলে প্রতি কেজিতে লোকসান হবে ১৫-১৭ টাকা।

ডিলাররা বলছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ বীজ থাকা সত্ত্বেও প্রতি টনে ৩-৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত না দিলে বীজ পান না তাঁরা। এতে মাঠপর্যায়ে বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিএডিসির বীজের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকেরা। ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার টন বীজ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। এতে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একটি সূত্র জানায়, অবীজ বিক্রিতে মোটা অঙ্কের অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সুযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার।

বিএডিসির কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক (বীজ বিপণন) এ কে এম মনিরুজ্জামান মুক্তির সঙ্গে গত মঙ্গলবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি কটিয়াদী উপজেলার গচিহাটাতে রয়েছেন বলে জানান। পরে সরেজমিনে বিএডিসির (বীজ উৎপাদন) কার্যালয়ে গেলে একটি সূত্র জানায়, তিনি গেস্টহাউসে রয়েছেন। পরে ওই গেস্টহাউসে যেতে চাইলে নিরাপত্তাপ্রহরী বাবুল ও শ্রমিক মনসুর আলম তুষার বাধা দেন। এ সময় তাঁরা এই প্রতিনিধির সঙ্গে তর্কে জড়ালে মনিরুজ্জামান গেস্টহাউস থেকে বের হয়ে জানান, অসুস্থ থাকার কারণে ফোনে কটিয়াদীতে থাকার কথা জানিয়েছেন তিনি। তবে অনিয়মের বিষয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

কিশোরগঞ্জে বিএনপি নেতা হত্যা: সাবেক চেয়ারম্যানসহ গ্রেপ্তার ৪

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত