Ajker Patrika

মেলাজুড়ে একুশের ছবি

শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকা
স্টলে বই দেখছেন দুই তরুণী। গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্টলে বই দেখছেন দুই তরুণী। গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে। ছবি: আজকের পত্রিকা

একুশের প্রথম প্রহরে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানো শুরু করার চল অনেক দিনের। রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের পর একুশের ভোর থেকে শহীদ মিনারের বেদি ভরে ওঠে সর্বসাধারণের ভালোবাসার ফুলে। আর বরাবরই এই মানুষদের একটা বড় অংশের পরবর্তী গন্তব্য হয় অদূরে চলমান অমর একুশে বইমেলা। দেশে বইয়ের প্রচার ও বিক্রির মাসব্যাপী এই আসরের সবচেয়ে জনাকীর্ণ দিন থাকে এটিই। গতকাল শুক্রবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে মেলায় ভিড় তুঙ্গে ওঠে বিকেলের দিকে।

এবারের মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পড়েছে শুক্রবার ছুটির দিনে। সব মিলিয়ে চারদিকে ছিল ছুটির আবহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে সকাল থেকে আশপাশজুড়ে তৈরি হয় জনস্রোত। শাহবাগ, নীলক্ষেত, ঢাকা মেডিকেল, কার্জন হল এলাকা হয়ে জনস্রোতের একাংশ ভিড় জমায় বইমেলায়। মেলা হয়ে ওঠে লোকারণ্য।

শহীদ দিবসের স্মরণে মেয়েদের অনেকে পরেছিলেন কালো বা সাদা-কালোয় মেশানো শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ। কারও পোশাকে ছিল বর্ণমালার প্রিয় অক্ষরগুলো। ছেলেদের গায়ে কালো কিংবা সাদা পাঞ্জাবি। শিশুদের গালে আঁকা হয় বাংলা অক্ষর বা শহীদ মিনারসহ একুশের নানা প্রতীক। একুশে ফেব্রুয়ারি অতীতে ছিল মূলত ভাষাশহীদদের জন্য শোক ও শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ভাবগম্ভীর দিন। তবে সাম্প্রতিককালে বাণিজ্যিক মনোবৃত্তির প্রভাব ও সাধারণের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতিসহ নানা কারণে এর মধ্যেও যেন কিছুটা উৎসবের হাওয়া লেগেছে।

বইমেলায় তিল ধারণের ঠাঁই না থাকলেও মানুষের হাতে বই দেখা গেছে কম। ছবি তোলা আর ঘোরাঘুরিতেই ব্যস্ত ছিল বেশির ভাগ। মেলা বিষয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞদের কয়েকজন অবশ্য মনে করিয়ে দিলেন, একুশের খুব ভিড়ের মধ্যে স্টলে দাঁড়িয়ে বই দেখা বা কেনায় অনেকে স্বস্তি পান না।

বই হাতে এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের মধ্যে তরুণ আল আমিন তালুকদার পড়ছেন সরকারি তিতুমীর কলেজে। তিনি কিনেছেন ক্যারিয়ার নিয়ে একটি বই ও হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস। আল আমিন বললেন, ‘স্টলগুলোতে বেশ ভিড়, কিন্তু বেশির ভাগই বই হাতে নিয়ে ছবি তুলছেন। আমি আরেক দিন আসব। আজকে আর বই কেনা হবে না।’

যাকে ঘিরে এই এত বড় মেলার আয়োজন, সেই মাতৃভাষা বাংলা ভাষার পরিস্থিতি নিয়ে অভিমত জানতে চাইলে আল আমিন বললেন, ‘আমাদের আসলে নিজস্ব কোনো কিছু নিয়ে তেমন গর্ব নেই। নিজেদের ভাষার জন্য নিজেদের উদ্যোগ নিতে হবে। সব জায়গায় বাংলার ব্যবহার বাড়ানো দরকার।’

মিমি আক্তার এসেছেন মিরপুর থেকে। পেশায় গৃহিণী। বললেন, ‘ঘুরতে আসছি পরিবার নিয়ে। ভাষার মাস। শহীদ মিনারে গেলাম, বইমেলায়ও আসছি।’

এবারের মেলায় দর্শনার্থী আসছেন ঠিকই, তবে প্রকৃত পাঠক ও ক্রেতা কম। অনেকের এমন মতেরই প্রতিধ্বনি করলেন পুথিনিলয় প্রকাশনীর কর্ণধার শ্যামল পাল। তিনি বললেন, ‘তা-ও দর্শনার্থীরা আসুক। তাঁরা একদিন পাঠক হয়ে যাবেন।’

শ্যামল পালের মতে, মেলায় অংশ নেওয়া সব প্রকাশকের কমবেশি একই অবস্থা। বইও এবার কম বের হয়েছে।

নতুন বইয়ের খোঁজে

ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতার বই এনেছে দিব্যপ্রকাশ। ৮০টি কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। বাংলার পাশাপাশি আছে কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদও। ভাষান্তর করেছেন শ্রীমন্তী সেনগুপ্ত এবং মুহম্মদ মুহসিন।

মুস্তাফা মজিদের সম্পাদনায় আগামী বের করেছে বই ‘ফ্যাসিবাদ ও বাংলাদেশ।’ বইটিতে ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক মতবাদটির রূপরেখা এবং ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ডালপালা মেলা ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

অন্যপ্রকাশ এনেছে সাংবাদিক ও লেখক মোস্তফা মামুনের নির্বাচিত গল্পের সংকলন ‘সেরা দশ গল্প’। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। লেখকের ভাষ্যমতে, গল্প শোনানো তাঁর জন্য এক দারুণ আনন্দময় অভিজ্ঞতা। তারই কিছু নমুনা রয়েছে ‘সেরা দশ গল্প’ বইটিতে।

ভারতের জনপ্রিয় লেখক খুশবন্ত সিং মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে লিখেছিলেন আত্মজীবনীমূলক বই ‘খুশবন্তনামা–দ্য লেসনস অব মাই লাইফ’। ‘খুশবন্তনামা: জীবন থেকে যা শিখেছি’ নামে ঐতিহ্য থেকে এটির অনুবাদ বের হয়েছে। ভাষান্তর করেছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু। খুশবন্ত সিংয়ের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনেরনানা অভিজ্ঞতা তাঁর স্বভাবসুলভ সরস বর্ণনায় উঠে এসেছে এতে।

প্রসিদ্ধ পাবলিশার্স বের করেছে ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক উপন্যাস ‘অতৃপ্ত’। এক সিরিয়াল কিলারের অন্ধকার জগতের খোঁজ দেবে বইটি। বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, গতকাল নতুন বই এসেছে ৩০৭টি। মোট বই এসেছে ২২১২টি।

আয়োজন

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা ৩০ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। সকাল ৮টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। দেড় শতাধিক কবি কবিতা পাঠ করেন। সভাপতি ছিলেন কবি হাসান হাফিজ।

বিকেল ৪টায় ছিল অমর একুশে বক্তৃতা-২০২৫। স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, একুশের চেতনা আমাদের মাঝে সতেজ রূপে বহমান। একুশ অতীত নয়, এটি প্রকৃতপক্ষেই বর্তমান। বাংলাদেশের ইতিহাসে ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, এর পরবর্তী ন্যায্যতা ও পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট—এই তিন ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।

‘ভাষার লড়াই, গণ-অভ্যুত্থান ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি এতে বলেন, ১৯৪৮ সালে শুরু হয়ে মাতৃভাষার অধিকার এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাই ছিল পরবর্তী ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি। ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা আজ প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে পারি, মাতৃভাষার অধিকার এবং নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে বৈষম্যের উৎস নির্মূল করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ইতিহাস কেবল অতীতের বিষয়ই নয়। এটি পরিবর্তনের রহস্য উদ্ঘাটনের বিদ্যা। জাতীয় সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদের এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।

‘লেখক বলছি’ মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি মোহন রায়হান এবং কবি আবিদ আজম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি রুম্মানা জান্নাত, নিলয় রফিক ও কাজিম রেজা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী শাহিন পারভীন, অধরা সরকার রিয়া, এ কে এম সাইদ হোসেন, তাহরিমা বতুল রিভা, লায়েকা বশীর, বিটু কুমার শীল, শেখ জেরিন শবনম, সৈয়দা সনজিদা জোহরা বীথিকা, শ্রাবণী পাইক, আরিফা নিশাত, বিভাস রঞ্জন মৈত্র, প্রেমা দাস।

আজ শনিবার বইমেলা শুরু হবে বেলা ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জীবন ও কর্ম: কায়কোবাদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইমরান কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হাবিব আর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন আবু দায়েন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত