স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য বাড়ছে, দরকার আমূল পরিবর্তন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২২, ১৫: ০৪
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২২, ১৫: ৫২

চলমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসা খরচের ৬৭ শতাংশের বেশি ব্যক্তির পকেট থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য বাড়ছে, যা খুবই দুঃখজনক। তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনেই চলমান স্বাস্থ্যের ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করছেন চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

তাঁরা বলছেন, অন্য অনেক দেশে যেখানে বিনা মূল্য ও অতি সহজ উপায়ে জনগণকে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। স্বাস্থ্যনীতি থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। এ ছাড়া অন্যান্য দেশে জিডিপির বড় একটা অংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করলেও বাংলাদেশ সেখানে ১ শতাংশেরও কম। ফলে বিনিয়োগ না বাড়ায় অনেক কিছু অগ্রগতি হলেও পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আজ শনিবার এসব কথা বলেন তাঁরা।

সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সির (সিডা) স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. জহিরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর একটি বড় মাইলফলক। আর বইটি স্বাস্থ্য খাতে একটি দলিল। আমাদের মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যে যে বৈষম্য বাড়ছে, সেটি খুবই দুঃখজনক। এ জন্য এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অনেক মানুষ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। গড় আয়ু বাড়লেও স্বাস্থ্যসেবা ভালো না হওয়ায় শেষ সময়ে গিয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বয়স্করা। এ জন্য একটি স্বাস্থ্য কমিশন জরুরি।

জহিরুল ইসলাম বলেন, সরকার যদি না-ও করে, ব্যক্তি উদ্যোগে হলেও এটি হওয়া দরকার। তবে স্বাস্থ্য খাতে একটা পরিবর্তন হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ৫০ বছরের স্বাস্থ্য খাত কেমন হবে, সেটিও এখন থেকে ভাবতে হবে। 

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. মালেকা বানু বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আমাদের সংবিধানেও এটি ভালোভাবে বলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে যে নারী আন্দোলন হয়েছে, এর মধ্যে নারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, নিরাপদ গর্ভপাত রক্ষা করাসহ অনেক কাজ করেছে নারীরা। নারীর ক্ষমতায়নে নারীর অধিকার নিয়ে, পুরুষদের সচেতনতা নিয়ে কাজ করেছে মহিলা পরিষদ।

মালেকা বানু বলেন, ‘দেশে কোনো কার্যকর স্বাস্থ্যনীতি নেই। এ জন্য এমন একটি নীতিমালা আমরা চেয়েছি, যেখানে লিঙ্গভিত্তিক কোনো বৈষম্য থাকবে না। আমাদের স্বাস্থ্য বাজেট অপ্রতুল, অব্যবস্থাপনা আরও বেশি। করোনা মহামারিতে সেটা আমরা দেখেছি। এমডিজিতে আমাদের সাফল্য কেবল সংখ্যায় হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেটি তেমনটা প্রভাব ফেলেনি।’

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, ‘স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে পরিবর্তন হয়েছে, আমরা সবাই জানি। বিশ্বে আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে ইতিবাচক ধারণা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাস্থ্যব্যবস্থা কী ছিল, আর এখন কী অবস্থা, সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেই সঙ্গে ২০০৯ সালের পর বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতে কী পরিবর্তন করেছে, সেগুলোও আলাদাভাবে এলে আরও ভালো হতো।’

রুহুল হক বলেন, ‘অনেক দেশ জিডিপির ২-৩ শতাংশ খরচ ব্যয় করে, আমাদের ১ শতাংশেরও কম। তার পরও আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এগিয়েছে, যেটি ইতিবাচক। তবে অনেক অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। আমাদের পুষ্টির এখনো ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। এটির পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমাদের ব্যক্তি খরচ অনেক বেশি। অভ্যন্তরীণ রোগীরা বিনা মূল্যে ওষুধ পেলেও বহির্বিভাগে এখনো এটি সেভাবে করা যায়নি। ফলে এই ব্যয় বেড়েই চলেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য, জেলা সদর হাসপাতালসহ চিকিৎসার প্রতিটি স্তরে যে জনবলের সংকট, সেটিরও সমাধান দরকার।’

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যে মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশ হওয়া দরকার, কিন্তু সেটিতে আমরা একেবারে পিছিয়ে। ফলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আবার হাসপাতালগুলোতে নানা অব্যবস্থাপনা। অনেক দামি দামি জিনিসপত্র কেনা হয়, কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। আছে নিয়োগে অনিয়ম। তার পরও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে দেশের স্বাস্থ্যখাত অনেক এগিয়েছে।’

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. রওনক জাহান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে দেশে তেমন লেখালেখি নেই। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি, অর্জনের সঙ্গে কোথায়, কেন আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতি সেগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে বইটিতে। বাংলাদেশের যে অর্জন সেটি আমরা কেবল দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করি। পাশের দেশ নেপালও আমাদের অনেক ছোট মনে করে। থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আমরা কতটা এগোতে পেরেছি, সেটি দেখা উচিত। থাইল্যান্ড গত ৬০ বছরে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে। কীভাবে পেরেছে, সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের সঙ্গে কেন তুলনা করি না আমরা?’

রওনক জাহান বলেন, ‘আমরা সবাই বলছি অর্থায়ন বাড়াতে হবে। অপর পক্ষে যতটুকু বরাদ্দ হচ্ছে সেগুলো ব্যয় করতে পারছি না। এ ছাড়া সুশাসনের ঘাটতির বিষয়টা ২৫ বছর ধরে বলা হচ্ছে, তার পরও তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না।’

রওনক জাহান আরও বলেন, ‘করোনাকালীন সরকারের যে অব্যবস্থাপনাগুলো ছিল, সেগুলো নিয়ে আমাদের লেখায় অনেকে বিব্রত হোন, কেন আমরা সরকারের প্রশংসা না করে শুধু ঘাটতি ও সংকটের কথা বলি। আমরা মনে করি, সরকারের প্রশংসা করার মতো সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, আমরা সংকটগুলো ধরিয়ে দিই, যাতে সেগুলো পূরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত