Ajker Patrika

নামডাকওয়ালা ফুটবলার থেকে হানিফের চরমপন্থী নেতা হয়ে ওঠা

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ঝিনাইদহ 
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) নেতা হানিফ আলী। ছবি: সংগৃহীত
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) নেতা হানিফ আলী। ছবি: সংগৃহীত

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের কৃষক রাহাজ উদ্দিনের ছয় ছেলে, দুই মেয়ে। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলে হানিফ আলী ছোটবেলা থেকে ছিলেন নম্র-ভদ্র। লেখাপড়ায় তেমন পারদর্শী না হলেও ফুটবলে ছিল তাঁর ব্যাপক নামডাক। নিজ গ্রাম এবং আশপাশের বিভিন্ন মাঠে খেলা হলেই ডাক পড়ত। ভালো ফুটবলার হিসেবে চারদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এসব নব্বইয়ের দশকের কথা।

তখন হানিফের ওপর নজর পড়ে স্থানীয় দুই চরমপন্থী নেতা টিপু ও মোয়াজ্জেমের। তাঁরা নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁকে নিজেদের দলে টানেন। তিনি হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে হয় ১৪টি হত্যা মামলা। একটি মামলায় ফাঁসির দণ্ডও পান।

দুই সহযোগীসহ খুন হওয়া হানিফ (৫৬) সম্পর্কে এমনটাই জানিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর ত্রিবেণি শ্মশান খাল এলাকায় তাঁকে গুলিতে হত্যা করা হয়। নিহত বাকি দুজন হলেন হানিফের শ্যালক শ্রীরামপুর গ্রামের উম্মাদ হোসেনের ছেলে লিটন হোসেন (৩৫) ও কুষ্টিয়ার ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের আরজান আলীর ছেলে রাইসুল ইসলাম রাজু (২৮)। সবাইকে মাথা ও বুকে গুলি করা হয়। রাতেই হত্যার দায় স্বীকার করে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু পরিচয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে মেসেজ পাঠানো হয়। যদিও এ বার্তা নিয়ে পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ধোঁয়াশা রয়েছে।

গতকাল রোববার দুপুরে আহাদনগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, হানিফের বাড়ির বাইরে একটি খাটিয়া কালো পলিথিনে ঢাকা অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন নারী কথা বলছেন। তাঁরা জানালেন, হানিফ মারা যাওয়ার শোকে তাঁর স্ত্রী শান্তি খাতুন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাড়িতে কেউ নেই।

বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসতেই হানিফের চাচাতো ভাই আব্দুল গনির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। হানিফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছোট থেকেই খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। এভাবে যে অন্ধকার জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে, আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি। তবে জেল খেটে সরকারের ক্ষমায় বেরিয়ে এসে ভালো হয়ে গিয়েছিল। তাদের (অন্ধকার জগৎ) সঙ্গে আর চলাফেরা করত না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কৃষিকাজ ও মাছ চাষ করত। তবে কে বা কারা কী কারণে তাকে হত্যা করল, আমরা জানি না।’

আব্দুল গনির সঙ্গে কথা চলাকালে এগিয়ে আসেন হানিফের বড় ভাবি সুজাতারা। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলে তিনি বলেন, ‘হানিফ তো এমন ছিল না। সে খুবই ভালো ছেলে ছিল। ছোট থেকে গ্রামে ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে হানিফের নামডাক ছিল। শুধু ফুটবল না, সব খেলাধুলায় সে পারদর্শী ছিল। গায়ে অনেক শক্তি ছিল। আমাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে খেলা হলে হানিফের ডাক আসত।’

চরমপন্থী দলে হানিফের জড়িয়ে যাওয়া নিয়ে সুজাতারা বলেন, ‘একদিন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পার্শ্ববর্তী রিষখালি গ্রামের টিপু ও ভায়না গ্রামের মোয়াজ্জেম আমাদের বাড়িতে আসে। হানিফকে ফুসলাতে থাকে তাদের দলে যোগ দিতে। রাজি না হলে একদিন ওরা হানিফের বাড়ির বাইরে একটি মাচার নিচে কাফনের তিন টুকরা কাপড় ও সাবান রেখে যায়। এরপর কথা না শুনলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কিছুদিন পর টিপু ও মোয়াজ্জেম বাড়িতে এসে হানিফের হাতে একটি অস্ত্র দিয়ে বলে, আজ থেকে তুমি আমাদের দলে কাজ করবে। এ বলে চলে যায়। সেদিনই হানিফ অস্ত্রটি স্থানীয় থানায় জমা দিয়ে দেয়। এ ঘটনার পরে হানিফকে আরও ভয় দেখায় তারা। একদিন রাতে হঠাৎ তারা এক ধামা মুড়ি-বাতাসা আর একটি কোরআন শরিফ নিয়ে হাজির হয়। হানিফকে কোরআন শপথ করিয়ে তাদের দলে যুক্ত করে। আর মুড়ি-বাতাসা খেয়ে আনন্দ করে চলে যায়। এরপর থেকে বাঁচার জন্য হানিফ ওদের সঙ্গে কাজ শুরু করে। আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে চরমপন্থী দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক নেতা।’

সুজাতারা জানান, অনেক বছর আগে টিপুকে সন্ত্রাসীরা মেরে মাঠে পুঁতে রেখেছিল। আর মোয়াজ্জেম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যান।

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে হানিফের বাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে হানিফের বাড়ি। ছবি: আজকের পত্রিকা

এলাকার আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হানিফ নব্বইয়ের দশকে চরমপন্থী দলে যুক্ত হন। তিনি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার কিছু অংশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাঁর চলার পথে কোনো বাধা রাখতেন না। একে একে ১৪টি হত্যা মামলায় আসামি হন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, বোমা হামলাসহ একাধিক মামলা হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হয়।

এলাকাবাসীর তথ্য অনুযায়ী, হানিফ ১৫ বছর কারাভোগের পর ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। পরের বছর নারানকান্দি বাঁওড়ে খুনের ঘটনা ঘটে। বাঁওড় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন। পরে এই বাঁওড়ের কর্তৃত্ব নেন হানিফ। শুরু করেন মাছের চাষ। নাম লেখান প্রকাশ্য রাজনীতিতে। যোগদান করেন হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগে। অল্পদিনে পেয়ে যান সহসভাপতির দায়িত্ব। এ ছাড়া তাঁর ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম এশা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট করলে তিনি পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গোটা এলাকায় গণসংযোগ করেন।

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া বলেন, ‘হানিফ ছিল এলাকার ত্রাস। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধের মামলা রয়েছে। সে সাধারণ ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে বের হয়। হোয়াটসঅ্যাপে যে বার্তাটি ছড়ানো হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে বলা যাবে, কে বা কারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, আর কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত