আ.লীগের ঘাঁটিতে ‘নৌকাডুবি’ হওয়ার যে কারণ বলছেন ভোটাররা

হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ২১: ৩৪
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ২২: ২৮

ময়মনসিংহ-১ আসন হালুয়াঘাট উপজেলা ও ধোবাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। বিগত সংসদীয় নির্বাচনে একচেটিয়া আধিপত্য রেখেছে আওয়ামী লীগ। সাতবার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দুবার করে বিজয়ী হয়েছে। অষ্টম থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন ধরে রাখে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হারতে হয়েছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে। 

বিভিন্ন সময়ের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে, ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১ আসনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের সীমান্ত বন্ধু হিসেবে পরিচিত কুদরত উল্লাহ মণ্ডল, ১৯৭৯ সালে সাবেক বিচারপতি বিএনপির টি এইচ খান, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির এমদাদুল হক মুকুল, তবে আওয়ামী লীগ ১৯৮৮ সালে নির্বাচন বর্জন করলে পুনরায় এমপি হন জাতীয় পার্টির এমদাদুল হক মুকুল। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেতা প্রমোদ মানকিন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে এই আসনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিএনপির আফজল এইচ খান নির্বাচিত হয়। পরে ২০০১, ’০৮ ও ’১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে এমপি হন সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন। 

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে প্রমোদ মানকিনের মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে তাঁর ছেলে জুয়েল আরেংকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। পরে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে জুয়েল আরেং নির্বাচিত হয়ে বাবার অসমাপ্ত কাজ ও সীমান্তবর্তী এই উপজেলায় বিভিন্ন উন্নয়নকাজ দৃশ্যমান করেন। এ ছাড়া অনেক অসমাপ্ত উন্নয়নকাজ করে যাচ্ছেন। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জুয়েল আরেংকে পুনরায় নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে জয় হাতছাড়া হয় তাঁর। 

সাধারণ ভোটার এই হারের নেপথ্যে গোটা দেশের উন্নয়নের ধারায় সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া পিছিয়ে পড়াকেই এই অবস্থার জন্য মূলত দায়ী করলে দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান ভিন্ন কথা। 

আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগকে বিভক্ত, তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন, কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা, সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা না থাকা, দলীয় এবং প্রশাসনের প্রোগ্রাম ব্যতীত অন্য প্রোগ্রামগুলোতে উপস্থিত না হওয়া, শুধু এক উপজেলায় উন্নয়নকাজ করাসহ উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া, আওয়ামীপন্থী ইউপি চেয়ারম্যানদের প্রভাবকে অনেকে দায়ী করছেন। 

এ আসনটি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। দুই উপজেলায় মোট ভোটার রয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার ৮৫২ জন। এতে হালুয়াঘাট উপজেলায় মোট ভোটার রয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩১৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৮ জন, নারী ভোটার ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৫০ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের রয়েছেন ১ জন। এই উপজেলায় মোট বৈধ ভোট পড়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৬০৯ টি। অপর দিকে ধোবাউড়া উপজেলায় মোট ভোটার রয়েছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮৬ হাজার ৮২৮ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ৮৬ হাজার ৭০৩। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের রয়েছে ২ জন। এতে ভোট পড়েছে ৬১ হাজার ৪৪টি। এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৯৩ হাজার ৫৩১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন এবং নৌকার প্রার্থী পেয়েছেন ৭৩ হাজার ৮৫২ ভোট। 

সাবেক বিলডোরা ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি আশরাফ উল আলম (মাস্টার) বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর জুয়েল আরেংকে সংসদ সদস্য বানানো হয়, কিন্তু পরে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ওপর নির্ভর ছিলেন, তৃণমূলের কর্মীদের কোনো মূল্যায়ন করেন নাই। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জনপ্রিয় প্রার্থীদের নৌকার মনোনয়ন দেন নাই। সারা দেশে যে পরিমাণ উন্নয়ন হইছে তুলনামূলক ময়মনসিংহ-১ আসনে উন্নয়ন হয় নাই।’

আশরাফ উল আলম আরও বলেন, ‘সায়েম সাবেক এমপির ছেলে। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে মানুষের দোরগোড়ায় যেতেন, খোঁজখবর রাখতেন। সাধারণ মানুষের মূল্যায়ন করতেন। যাঁরা তাঁর কাছে যেতেন, সবার নাম ধরে ডাক দিয়ে কাছে নিতেন। যা আমাদের সাবেক এমপি জুয়েল আরেং বড়জোর একটি ইউনিয়নের চার-পাঁচজন মানুষের নাম জানতেন। যা মাহমুদুল হক সায়েম ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের নাম ধরে ডাক দিয়ে কাছে নিতেন। দল-মত নির্বিশেষে জনপ্রিয়তা থাকায় তাঁকে মানুষ ভোট দিছে।’ 

ধোবাউড়া দক্ষিণ মাইঝপাড়া এলাকার আজগর আলী বলেন, ‘জুয়েল আরেং হালুয়াঘাটে থাকতেন। ধোবাউড়া উপজেলা থেকে কেউ গেলে তাঁকে অবমূল্যায়ন, সময়মতো না পাওয়া, এলাকায় গণসংযোগে না থাকা এ ছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় তাঁর হারের নেপথ্যে থাকতে পারে।’ 

ধোবাউরা উপজেলার কৃষ্টপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব তছির উদ্দিন বলেন, ‘আমি তো কোনো দল করি না। এই বাজারে আইয়া চায়ের দোহানে বইয়া থাহি সময় কাটায়। মানকিন সাব মরার পরে তার পুলা এমপি অইছো। আইজ পর্যন্ত দেখিনাই এলাকায় বাজারঘাটে আইতে মানুষের সুখ দুখ দেখতে। কিন্তু সায়েম লোকবালা। মসজিদে দান করে। এলাকায় তার জনপ্রিয়তা প্রচুর। জনপ্রিয়তা থাকার কারণে এমপি অইছে।’ 

কথা হয় ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুলের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমরা তাঁর বাবার মৃত্যুর পর দুবার এমপি বানাইলাম, কিন্তু এমপি হবার পর ধোবাউড়া আওয়ামী লীগের দলের পুরোনো অফিস রেখে নতুন অফিস করে সে দলকে বিভাজিত করেছে। সে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করে নাই।’ 

তবে ধোবাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ডেবিট রানা চিসিম বলেন, ‘বিপক্ষ দল শুরু থেকে সাধারণ ভোটরদের সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে ভোটারদের তাদের পক্ষে নিয়েছে। আমরা সাম্প্রদায়িকতার কাছে হেরে গেছি।’ 

জানতে চাইলে সাবেক সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং বলেন, ‘ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ তাঁর বিপক্ষে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন করেছে। তা ছাড়া বিপক্ষ দল সাধারণ ভোটারদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে তাঁর অনেক ক্ষতি করেছে।’ 

স্বতন্ত্র থেকে এমপি হওয়া মাহমুদুল হক সায়েম বলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষের ভোটে জয়ী হয়েছে। আমি সাধারণ মানুষের হয়ে কাজ করে যেতে চাই।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত