Ajker Patrika

বাল্যবিবাহ ও ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারের কারণে বাংলাদেশে নারীরা ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন

রংপুর প্রতিনিধি
বাল্যবিবাহ ও ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারের কারণে বাংলাদেশে নারীরা ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন

বিশ্বে এখন প্রায় ১০ লাখ নারী ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশে ভুগছেন প্রায় ২০ হাজার নারী। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার নতুন রোগী যোগ হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যোগ হন প্রায় দুই হাজার নতুন রোগী। এ পরিস্থিতিতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাল্যবিবাহ রোধ ও কম বয়সে গর্ভধারণে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি নিরাপদ প্রসবের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। 

আজ সোমবার দুপুরে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি সভাকক্ষে আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল দিবস’ উপলক্ষে মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশ ও ল্যাম্ব হাসপাতালের এফআরআরইআই প্রজেক্টের কারিগরি সহায়তায় এ সভার আয়োজন করা হয়। 

সভায় এফআরআরইআই প্রজেক্ট (ল্যাম্ব) ম্যানেজার মাহাতাব উদ্দিন লিটন বলেন, ফিস্টুলা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। বিলম্বিত প্রসব বা বাধাগ্রস্ত প্রসব, বাল্যবিবাহ ও কম বয়সে গর্ভধারণ, জরায়ুতে অস্ত্রোপচার, অদক্ষ ধাত্রী বা প্রতিবেশীর মাধ্যমে ডেলিভারি করানোসহ সচেতনতার অভাবে ফিস্টুলা রোগ বাড়ছে। 

মাহাতাব উদ্দিন আরও বলেন, নারী জননাঙ্গের ফিস্টুলা প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিকভাবে ফিস্টুলা শনাক্ত হলে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে হবে। রংপুর বিভাগে এ রোগ নিরাময়ে ল্যাম্ব হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ফিস্টুলা রোগীর চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রয়েছে ল্যাম্ব হাসপাতালে। পাশাপাশি সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ফিস্টুলা রোগীর চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। 

গর্ভকালীন ন্যূনতম চারবার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, মিডওয়াইফের কাছ থেকে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ এবং যেকোনো জটিলতায় তৎক্ষণাৎ নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে। গর্ভবতী মায়েদের প্রসব যাতে সহজ ও নিরাপদে হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি। কীভাবে নিরাপদ প্রসব সম্ভব, এর জন্য যেমন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি গর্ভবতী মায়েদের পরিবারের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন রয়েছে বলেও আলোচনায় তুলে ধরেন তিনি। 

ফিস্টুলা রোগ কী, আক্রান্তের কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি, শনাক্তের উপায়, চিকিৎসাসেবা ও প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে আলোচনা করেন ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. তাহমিনা খাতুন। আরও বক্তব্য রাখেন এফআরআরইআই প্রজেক্টের (ল্যাম্ব) মনিটরিং অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন কো-অর্ডিনেটর কামরুজ্জামান, জেলা সমন্বয়কারী মঞ্জু আরা বেগম, সিনিয়র সাংবাদিক মেরিনা লাভলী, প্রেসক্লাব রংপুরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বাপ্পী প্রমুখ। 

২০২২ সালে ল্যাম্ব ইউএনএফপি ফিস্টুলা প্রকল্পের অধীনে রংপুর বিভাগের আট জেলার ৯০ জন ফিস্টুলা রোগীকে শনাক্ত করে। এদের মধ্যে ৬৭ জন অপারেশনের মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে পরিবারে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল করার লক্ষে প্রসবজনিত ফিস্টুলা সম্পর্কিত দ্বিতীয় জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করেছে। সরকারিভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ফিস্টুলা মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা। 

বক্তারা আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশে এখনো ৫০ শতাংশ ডেলিভারি অদক্ষ ধাত্রী বা আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা হয়। মাতৃমৃত্যুর মধ্যে ৩ ভাগ মারা যাচ্ছে এখনো বাধাগ্রস্ত/দীর্ঘস্থায়ী প্রসবের কারণে। বাড়িতে ডেলিভারি করানোর ফলে মারা না গেলেও কিছু ক্ষেত্রে অনেক নারী নিজের অজান্তেই ফিস্টুলার শিকার হন। দীর্ঘস্থায়ী এবং বাধাগ্রস্ত প্রসবই প্রসবজনিত ফিস্টুলার প্রধান কারণ। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা, পরিবার পরিকল্পনার অভাব এবং জরুরি প্রসূতি যন্ত্রের অভাবেও এই রোগ হতে পারে। 

আলোচনায় অংশ নেন ২৫ বছর পর ফিস্টুলামুক্ত হওয়া পেয়ারি বেগম। দীর্ঘ সময়ের কষ্ট আর লাঞ্ছনার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। শাড়ির আঁচলে চোখের কোণে জমাট বাধা টলমলে জল মুছতে মুছতে পেয়ারি বেগম বলেছেন তার যন্ত্রণার কথা। 

চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী এ নারী বলেন, বিয়ের এক বছর পর নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে আমার বাচ্চা প্রসব হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার ছেলে সন্তানটি মৃত ছিল। সন্তান প্রসবের পর থেকে আমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হতো। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। বরং দিনে দিনে আমার থেকে মানুষ দূরে সরে যেতে থাকে। সংসারে বিভিন্নভাবে যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা ও কষ্ট করেছি। অর্থাভাবে চিকিৎসাও করাতে পারিনি। দীর্ঘ দুই যুগ পর জানতে পারি আমি ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত। এরপর ল্যাম্ব হাসপাতালে আমি চিকিৎসা নিয়ে এখন আমি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি।

প্রসঙ্গত, নারী জননাঙ্গের ফিস্টুলার লক্ষণ—সহজ উপায় হচ্ছে রোগীর সব সময় প্রস্রাব বা পায়খানা অথবা উভয়ই ঝরতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে প্রস্রাব বা পায়খানার সময় রোগীর কোনো চাপ বা বেগ অনুভব হবে না। সব সময় কাপড় ভেজা থাকবে। এ সমস্যা শুরু হবে সন্তান প্রসবের পর কিংবা তলপেট বা জরায়ুতে কোনো অপারেশনের পর। অর্থাৎ ফিস্টুলা হচ্ছে মাসিকের রাস্তার সঙ্গে মূত্রথলি অথবা মলাশয়ের এ বা একাধিক অস্বাভাবিক ছিদ্র হয়ে যুক্ত হওয়া। ফলে মাসিকের রাস্তা দিয়ে সব সময় প্রস্রাব বা পায়খানা অথবা উভয়ই ঝরতে থাকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত