রাজস্ব ঘাটতি: টাকার জন্য মরিয়া সরকার

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯: ১৯
Thumbnail image

ডলার-সংকটে অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি চলছে। এ সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক একের পর এক পদক্ষেপ নিলেও কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ডলারের তীব্র সংকটের মধ্যেই এবার টাকার অভাবে পড়েছে সরকার। রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ক্রমে বাড়তে থাকায় ব্যয় মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সমানে ধার করছে। এতে বাড়ছে ঋণের বোঝা।

চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকারের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ হওয়ায় রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়েছে। আয়ে টান পড়লেও ব্যয় কিন্তু থেমে নেই। এতে টান পড়েছে কোষাগারে। খরচ মেটাতে গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের এক দিনেই সাড়ে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ৬ হাজার কোটি টাকা ধার করেছে সরকার। এসব ধার-দেনা চলছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে। এতে ট্রেজারি বিলের সুদহারও বাড়ছে।

গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেওয়া পুঞ্জীভূত ঋণ ৮ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। পরিস্থিতি যা, তাতে বোঝা যাচ্ছে, সামনে সরকার এ পদ্ধতিতে আরও বেশি টাকা তুলবে।

সরকার নিজের খরচে লাগাম না টানতে পারলেও ঠিকই বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ কমানোর কৌশল নিয়েছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখার নামে বেসরকারি খাতের ঋণের সুদের হার দফায় দফায় বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে আমানতের সুদের হারও স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এতে করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কয়েক দিন আগে রপ্তানি খাতের ৪৩ পণ্যের প্রণোদনা কমিয়ে দিয়েছে সরকার। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অংশ হিসেবে এ কাটছাঁট করা হচ্ছে জানানো হলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকার মূলত তহবিল-সংকটে পড়ে প্রণোদনার টাকা কমিয়েছে। প্রণোদনা কাটছাঁট করায় একটি বড় অঙ্কের টাকা সরকারের সাশ্রয় হবে বলেই মনে করছেন তাঁরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্য, সেটা অর্জন হচ্ছে না। ঘাটতি বরাবরই আছে। সামনে সরকারের তহবিলে চাপ বাড়বে। বিশেষ করে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় সামনের দিনে বাস্তবায়নের চাপ বাড়বে। তখন টাকার প্রয়োজন আরও বাড়বে। 

ডলার বাড়াতে যত পদক্ষেপ
ডলার-সংকট কাটাতে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েই যাচ্ছে। ফলপ্রসূ হচ্ছে না কোনোটাই। ২০২২ সালের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে দেশে কোনো ডলার-সংকট থাকবে না। অথচ এখন ২০২৪ সালের জানুয়ারি শেষ হয়ে ফেব্রুয়ারি চলছে। কিন্তু ডলার-সংকটের বৃত্ত ভাঙতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভুলনীতির কারণে সরকার কাঙ্ক্ষিত হারে ডলার পাচ্ছে না।

ডলার বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতিগুলোর একটি হলো ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দর। রেমিট্যান্সের জন্য এক দর, আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ অন্য সবার জন্য আরেক দর। রপ্তানির জন্য এক দর, আবার আমদানির ঋণপত্রের জন্য বেশি খরচে আরেক দর। এক দেশে ডলারের বৈষম্যমূলক ৪-৫টি দর চালু রাখায়, কোনোটি ঠিকমতো কাজ করছে না। এ কারণে বিপুলসংখ্যক কর্মী প্রবাসে যাওয়ার পরও রেমিট্যান্সের প্রবাহ কাঙ্ক্ষিত নয়। রেমিট্যান্সের বড় অংশই হুন্ডির মাধ্যমে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ডলার-সংকট ও টাকার চাহিদার বিষয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষক ও পিডব্লিউসির কান্ট্রি পার্টনার মামুন রশীদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডলার ইস্যুতে সম্পূর্ণ ভুল পথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চার-পাঁচটা ডলারের রেটে এফডিআই তো আসবেই না। প্রবাসীরাও ডলারপ্রতি ১০-১২টার কমে ব্যাংকে টাকা পাঠাবে না। এফডিআই এনে ডলার বাড়াতে চাইলে উচিত ছিল ডলার অ্যাকাউন্টে ডলারটা রাখার সুযোগ দেওয়া।

এফডিআই বাড়ানো 
সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান করছে ডলার নিয়ে আসতে। অথচ তারা পাবে ১১০ টাকা। যেখানে খোলাবাজারে ১২২ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, অর্থবছরের তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ আগের চেয়ে ৪০ শতাংশ কমেছে। বিদায়ী ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নিট এফডিআই এসেছে ৬৭০ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার। 

প্রকল্পের অর্থছাড়ে গতি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের সভায় বিদেশি ঋণের অর্থছাড় বাড়াতে বলা হয়েছে। এর বাইরেও বিদেশি ঋণের প্রকল্প নেওয়ারও হিড়িক পড়েছে বলে জানা গেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) ঋণ পেতে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় বেশ কিছু প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এসব প্রকল্পের সম্ভাব্য মোট ব্যয় সর্বোচ্চ ২৩ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। 

সুদহারের সীমা সংশোধন 
ডলারের মজুত বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বৈদেশিক ঋণের বার্ষিক সব সুদহারের সীমা সংশোধন করেছে। এখন থেকে সুদহারের সঙ্গে ৪ শতাংশ পর্যন্ত মার্কআপ বা মার্জিন যুক্ত করে গ্রাহককে ঋণ দিতে পারবে, যা আগে ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলছেন, এর ফলে স্থানীয় ব্যাংক বিদেশ থেকে আগের চেয়ে বেশি সুদ দিয়ে তহবিল আনতে পারবে।

এর বাইরেও দেশে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে ডলার বন্ডের সুদহারও সর্বোচ্চ ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। এ বন্ডে প্রবাসী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকেরা বিনিয়োগ করে থাকেন। মোটকথা, নানাভাবে সরকার মরিয়া হয়ে ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত