টানা ১২ বছর পদে থাকতে পারবেন ব্যাংক পরিচালকরা, সংসদে বিল পাস

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩, ২১: ৫১

বর্তমান আইনে একাদিক্রমে ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকা যাবে। কিন্তু নতুন আইনে ১২ বছর পর্যন্ত থাকতে পারবেন তাঁরা। তবে মেয়াদ বাড়ানোর সংশোধনী প্রস্তাবের প্রবল আপত্তি তুলেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা।

তাঁরা বলেছেন, ব্যাংক লুটপাটের মূল হোতা পরিচালকেরা। তাঁদের সুবিধা দেওয়ার জন্য আইন সংশোধন করা হচ্ছে। এর চেয়ে পরিচালকদের মেয়াদ আজীবন করে দেওয়া হোক। পরে পরিচালক পদের মেয়াদ ১২ বছর করে বিল পাসের প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা।

গত ৮ জুন ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল–২০২৩ জাতীয় সংসদে তুলেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংশোধনীর মূল প্রস্তাবে পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানো–কমানোর বিষয়ে কোনো প্রস্তাব ছিল না। পরে সেটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কমিটিও পরিচালক পদের মেয়াদ নিয়ে কোনো সংশোধনী আনেনি।

আজ বুধবার বিলটি পাসের আগে সংশোধনীর প্রস্তাব দেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি পরিচালক পদের মেয়াদ একাদিক্রমে ১২ বছর করার প্রস্তাব করেন। তবে এ প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া দেখায় জাতীয় পার্টি। বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন এভাবে বিলে সংশোধনী আনা যায় কিনা। এ বিষয়ে তারা স্পিকারের ব্যাখ্যা দাবি করেন।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, পরিচালক পদের মেয়াদ ১২ বছর করার জন্য সরকারি দলের একজন সদস্য সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা বিল উত্থাপনের সময় ছিল না। যেহেতু সরকারি দলের সংসদ সদস্য এই প্রস্তাব দিয়েছেন তাই মনে হচ্ছে এটা গ্রহণ করা হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, যে বিষয়টি সংসদে উত্থাপনই হয়নি সেটা চাওয়া হয় কী করে?

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ব্যাংক মালিকদের অনুদান দেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে দলটির আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, তাঁরা এই টাকা দিয়ে একমাত্র পর্যন্ত প্রথম ও শেষ পাতায় বড় বড় ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন-প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিচ্ছেন। আরও তাঁরাতো এক বস্তা খালেদা জিয়ার হাতে দিয়েছেন। সেটাতো প্রকাশ করেন না। এদের চরিত্র একই। এরা আপনার হাতের কলকি খেয়ে চলে যাচ্ছে। আপনাদের হাতে গন্ধটা থেকে যাচ্ছে। এখনো সাবধান হন। এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসেন।

ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনটি আনা হয়েছে বলে সংসদে অভিযোগ করেন ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, তাঁরা জনগণের টাকা অপব্যবহার করে। সর্দিকাশি হলেই তাঁরা ব্যাংকের টাকায় সিঙ্গাপুর চলে যান।

স্বতন্ত্র পরিচালক কারা এই প্রশ্ন রেখে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমরা তার লিস্ট চাই। আমরা এই ভাগ্যবানদের সংসদে দেখতে চাই। সমস্ত দলীয় কর্মী ও আত্মীয়স্বজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়। তারা ব্যাংকে যায় শুধু লোন দেওয়ার জন্য। ১০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দুই কোটি নিজে নিয়ে নিল। একদিনে ধনী হয়ে গেল। যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। এখানে হরিলুট চলছে। আমরা কমানোর প্রস্তাব করছি না। এদের মেয়াদ আজীবন করে দেন। আমি এখন প্রস্তাব আনলাম। এই পরিচালকরা আজীবন থাকবে। আল্লাহ যত দিন হায়াত রাখছেন আপনারা খাইতে থাকেন। আমরা দেখতে থাকি।’

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, এই আইনে সংশোধন আনা হচ্ছে শুধুমাত্র ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর খবরদারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কে হবেন, ডেপুটি গভর্নর কে হবেন—এগুলো তাঁরা নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকারদের কাছে সরকার জিম্মি হয়ে গেছে।

দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, পরিচালকরা হচ্ছেন ব্যাংক লুটপাটের মূল হোতা। কোনো পরিচালক সুপারিশ না করলে আমার মতো লোক গেলে ব্যাংক ঋণ মিলবে না। চেয়ারম্যান-পরিচালকের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক শেষ। যে আইনের কোন ধারা অর্থমন্ত্রী সংশোধনীতে আনেননি। যে সেকশন সংশোধনের জন্য সংশোধনী কমিটি কোন সুপারিশ করেনি, সেখানে একজন সরকারি দলের সদস্য কোন আইনে এই সংশোধনী আনলেন। তিনি এটা পারেন কিনা? এটা জানা খুবই দরকার। অভিভাবক হিসেবে স্পিকার এটা বলবেন বলে আশা করি।

তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে কনভিন্স করে সরকারি দল করেন এমন অনেক ব্যাংকের পরিচালকদের সুপারিশে এটা আনা হয়েছে। পাস করার জন্য। সেটা হলে আমরা আমাদের সব সংশোধনী প্রত্যাহার করলাম। কারণ এর থেকে বড় অন্যায় আর হতে পারে না। যেখানে ব্যাংক লুটপাট করা হচ্ছে। বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বসে বসে তামাক খায়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যায়। আপনারা দেখছেন না। আপনারা আছেন কাউকে ফেবার করার জন্য। পরিচালকের মেয়াদ ১২ বছর করার এই প্রস্তাবকে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’

সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব তুলতে গেলে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা হইচই করেন। তখন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আগে সংসদ সদস্যকে সংশোধনী প্রস্তাব তুলতে দেন। এরপর বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।

আহসানুল ইসলাম সংশোধনী প্রস্তাব তোলার পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এ বিষয়ে রুলিং দেন। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সংশ্লিষ্ট বিধি উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, মূল সংশোধনীতে বিলের ১০ দফায় সংশোধনীর প্রস্তাব ছিল। আর আহসানুল ইসলাম যে সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন সেটিও এই দফার একটি উপদফা। এখানে বিলে কোন নতুন ধারা যুক্ত করা হয়নি। বা এমন কোন নতুন দফাও যুক্ত করা হয়নি। এটি অপ্রাসঙ্গিক নয়।

স্পিকারের বক্তব্যের পর বিরোধী দলের সদস্য ফখরুল ইমাম কথা বলতে চাইলে স্পিকার মাইক না দিয়ে বলেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য এটা আমার রুলিং। আপনি এ বিষয়ে আর আপনার কিছু বলার নেই।’

স্পিকারের রুলিংয়ের পর অর্থমন্ত্রীকে ফ্লোর দেন। এ সময় মাইক ছাড়াই বিরোধী দলের সদস্য চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। পরে স্পিকার অর্থমন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বিরোধী দলের সদস্যদের বলেন, ‘আমরা বিধির বাইরে কিছু করব না।’

তবে বিরোধী দলের চিৎকার চেঁচামেচি অব্যাহত থাকে। বিরোধী দলের চেঁচামেচির সময় ফ্লোর নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি আহসানুল ইসলামের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করছেন।

এটি বলার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা হইচই শুরু করেন। মাইক ছাড়াই কথা বলতে থাকেন মুজিবুল হক। তার পাশাপাশি কাজী ফিরোজ রশীদও দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ফিরোজ রশীদকে মাইক দেওয়া হয়। তিনি অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা যে আজীবনের কথা বললাম আপনি কী সেটা গ্রহণ করলেন? এই একজন পরিচালক আমৃত্যু থাকবে। সেটা গ্রহণ করছেন? না ১২ বছর করছেন? কোনটা সেটা আমাদের স্পষ্ট বলতে হবে।’

পরে স্পিকার অর্থমন্ত্রীকে আবারও মাইক দেন। তবে তিনি কথা বলেননি। এ পর্যায় স্পিকার সংশোধনী ভোটে দেন। দফা ভিত্তিক সব সংশোধনী ভোটে দেওয়া হয়। এ সময় জাতীয় পার্টি ওয়াকআউট করে সংসদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। মাগরিবের নামাজের বিরতির পরে তাঁরা আবারও সংসদে যোগ দেয়।

ওয়াকআউটের বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর থেকে ১২ বছর করার প্রতিবাদে আমরা ওয়াকআউট করেছি।’

এদিকে পরে বিলটি পাসের জন্য স্পিকার ভোটে দিলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত