রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি বেবি স্কেলার (বাচ্চাদের ওজন মাপার নিক্তি) সরবরাহ করেছিল একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দাম ছিল সাকল্যে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। সেই নিক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট হয়ে যায়। এবার মেরামতের পালা। তার বিল কত জানেন? ৪ লাখ ১১ হাজার ৯০০ টাকা। অর্থাৎ নিক্তিটি কেনার চেয়ে মেরামতের খরচই ৫৪ গুণ বেশি।
আরও আছে। রংপুর সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকে সে জেলার সাতটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যন্ত্রগুলো আনতে হবে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপান থেকে। যথারীতি সেগুলো আনাও হয়। কিন্তু সবকিছু ঘটে যায় জাদুর কাঠির ছোঁয়ার মতো। মাত্র এক দিনের মধ্যে এই আটটি দেশ থেকে যন্ত্রপাতি এনে হাজির করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কী করে তা সম্ভব? কিন্তু সে প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে ঠিকই বিল তুলে নিয়ে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এতটুকু পড়ে পাঠক নিশ্চয় এই মহাক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন। তাঁর নাম মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ঢাকায় তাঁর পরিচয় স্বাস্থ্যের মাফিয়া বা মিঠু সিন্ডিকেট নামে। মূল প্রতিষ্ঠানের নাম লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ, তার লেজে আছে নামে-বেনামে আরও ৬০ প্রতিষ্ঠান। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ করে’ বাজেট তৈরি করা থেকে শুরু করে কেনাকাটার যাবতীয় পরিকল্পনা করেন। এরপর সেই তালিকা ধরে সিএমএসডিকে দিয়ে জিনিসপত্র কেনাতে বাধ্য করেন। আর ঘুরেফিরে তার প্রতিষ্ঠানগুলোই দরপত্রে অংশ নেয়। এভাবে ২০ বছরের বেশি সময় তিনি জিম্মি করে রাখেন দেশের স্বাস্থ্য খাত।
কিন্তু কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। মিঠুর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক শহীদউল্লাহ ২০২০ সালে করোনায় মারা যাওয়ার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়ে মিঠুর ফিরিস্তি জানান। এরপর তদন্ত শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সব প্রতিষ্ঠান নড়েচড়ে বসে। খবর পেয়ে মিঠু চক্রের প্রধান মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু বিদেশে পাড়ি জমান। এখন তিনি নিউইয়র্কের কাছে ব্রংসভিল নামের একটি অভিজাত এলাকায় বাস করেন। আর রোলস রয়েস গাড়ি হাঁকান।
মিঠুর আদিবাস রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রাম। যদিও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তাঁর বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ঢাকার গুলশান, বনানী, এলিফ্যান্ট রোড, মালিবাগ, ডিওএইচএস এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সাতটি বাসার তথ্য আছে।
কিন্তু মিঠু দেশ ছাড়লেও তাঁর সহযোগীরা দিব্যি আছেন। মিঠুর দেখানো পথেই তাঁরা এখন চালাচ্ছেন স্বাস্থ্যের কেনাকাটা আর দূরে বসে সব নিয়ন্ত্রণ করছেন মিঠু। তাঁর নামে আরব-বাংলাদেশ ব্যাংকেই দেড় হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু প্রভাবের কারণে এক বছরেও সে সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
মিঠু চক্রের অপতৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, এসব অনিয়ম-দুর্নীতি আগের। তিনি তখন অধিদপ্তরের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে চেষ্টা করছেন।
মেরামতের আরও ব্যয়
প্রতিবেদনের শুরুতে বাচ্চাদের নিক্তি মেরামতের যে খরচের কথা বলা হলো, তার সঙ্গে ছিল একটি কার্ডিয়াক মনিটর মেরামতের খরচও। এই যন্ত্রটি কেনা হয়েছিল ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকায়। অথচ সেটি মেরামতে খরচ দেখানো হয় ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে ৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকায় ফটোথেরাপি যন্ত্র সরবরাহ করে মেরামত বাবদ নেওয়া হয় ৬ লাখ ৪০০ টাকা।
দেশি যন্ত্রে বিদেশি ট্যাগ
রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে সাতটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ২০১৬ সালের ২৯ মে কার্যাদেশ পায় কিউ সোর্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার স্বত্বাধিকারী মিঠুর ভাই মুকুল ইসলাম। পরদিন ৩০ মে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপানের তৈরি ২৪ কোটি ৮৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯০ টাকার সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়।
১ কোটি ৮ লাখ টাকায় পাঁচটি রেডিয়েন্ট ওয়ার্নার সরবরাহ করা হয়েছিল ডেভিড ব্র্যান্ডের, তাতে উৎপাদনকারী দেশের নাম ছিল জার্মানি। কিন্তু ওয়েবসাইটে এই নামের কোনো প্রতিষ্ঠানই খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, মিঠু সিন্ডিকেট এখনো সমানভাবে সক্রিয়। তাদের তৎপরতায় ২৬ কোটি টাকার প্রকল্প ১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
৬১ প্রতিষ্ঠান খুলে লুটপাট
একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মিঠু ৬১টি আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট বানিয়ে সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করেন। মিঠুর নিজ নামে আছে আটটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো মেক্সিকোর মার্চেন্ডাইজার, টেকনো ট্রেড, মেক্সিকোর আইটি পার্ক লিমিটেড, মেসার্স টেকনো ট্রেড, মেসার্স টেকনো ফিশিং, মেসার্স প্রি-এক্সর, সিআর মার্চেন্ডাইজ, লেক্সিকোন হসপিটালাইট, নর্থ এগ লিমিটেড, নর্থ বেঙ্গল পোলট্রি ফার্ম, অ্যাপল সিরামিক লি., মেড ইকুইপ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনভেনচার, টেকনোক্রেট ও এম গেটওয়ে করপোরেশন (যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত)। মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানার নামে তিনটি এবং বড় ভাই মো. মোকছেদুল ইসলামের নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া মিঠু অন্যান্য ভাই, ভাবি, ভাগনেসহ বন্ধু ও স্বজনদের নামে প্রতিষ্ঠান খুলে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত কয়েক বছরে মিঠুর স্ত্রীর ফিউচার ট্রেড ৮৬ কোটি টাকার বেশি কার্যাদেশ থেকে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ভাগনে মো. ফাহাদ মাহমুদের অরডেন্ট সিস্টেম ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আত্মসাৎ করে ৪ কোটি টাকা। মিঠুর ভাবি সাবিহাতুল জান্নাতের জিএসই অ্যান্ড ট্রেডিং কয়েক বছরে ৩২ কোটি ৬১ লাখ টাকার কার্যাদেশ থেকে আত্মসাৎ করে প্রায় ২০ কোটি টাকা। রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে মোকছেদুলের কিউ সোর্স ২০১৩-১৪ থেকে তিন অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চক্রটি সিএমএসডি থেকে ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার কার্যাদেশ পায়, তাতে ৪২ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এই সময়ে চক্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে আরও ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে গত বুধবার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। বাসার ফোনে কল করা হলে সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। অফিসের নম্বরে ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
দুদকের নিষ্ফল অনুসন্ধান
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিঠুর অন্যতম সহযোগী তাঁর ভাই মোকছেদুল ইসলাম ও ভাগনে বেনজীর আহমেদ। স্বাস্থ্য খাতে মিঠু চক্রের দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দুদক অনুসন্ধানে নামে। ২০১২ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় দুদক একটি মামলাও করে।
মামলায় ১৭টি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে মালপত্র সরবরাহ না করে বিল নেওয়া, বাজারদরের চেয়ে বহুগুণ বেশি দরে সরবরাহ এবং বিদেশি সামগ্রীর নামে স্থানীয় নিম্নমানের সামগ্রী সরবরাহ করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ ছিল। এগুলো অনুসন্ধান ও তদন্ত করেন দুদকের উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারি ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক। মিঠু চক্রের অন্যান্য কোম্পানির দুর্নীতির বিষয়েও ১০-১২টি নথি খোলা হয় দুদকে। সেগুলোর দায়িত্ব একাধিক কর্মকর্তাকে দেওয়া হলেও পরে সব একত্র করে সিরাজুল হক এক প্রতিবেদনের মাধ্যমেই তা নিষ্পত্তি করেন।
তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান শাখার মহাপরিচালক জয়নুল আবেদিন শিবলী জানান, মায়ের অসুস্থতার কারণে তিনি হাসপাতালে আছেন। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে পারছেন না।
দুদকের সাবেক এক মহাপরিচালক বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়ে থাকলে আদালতে পুনঃ তদন্ত চাওয়া যায়, আবার দুদক চাইলেও পুনঃ তদন্ত করতে পারে। কিন্তু মিঠুর প্রভাবের কারণে সবাই রহস্যজনকভাবে নীরব আছেন।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঘটনাগুলো নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে। যে করেই হোক দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে। তা না হলে আইনের শাসন কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি বেবি স্কেলার (বাচ্চাদের ওজন মাপার নিক্তি) সরবরাহ করেছিল একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দাম ছিল সাকল্যে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। সেই নিক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট হয়ে যায়। এবার মেরামতের পালা। তার বিল কত জানেন? ৪ লাখ ১১ হাজার ৯০০ টাকা। অর্থাৎ নিক্তিটি কেনার চেয়ে মেরামতের খরচই ৫৪ গুণ বেশি।
আরও আছে। রংপুর সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকে সে জেলার সাতটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যন্ত্রগুলো আনতে হবে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপান থেকে। যথারীতি সেগুলো আনাও হয়। কিন্তু সবকিছু ঘটে যায় জাদুর কাঠির ছোঁয়ার মতো। মাত্র এক দিনের মধ্যে এই আটটি দেশ থেকে যন্ত্রপাতি এনে হাজির করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কী করে তা সম্ভব? কিন্তু সে প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে ঠিকই বিল তুলে নিয়ে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এতটুকু পড়ে পাঠক নিশ্চয় এই মহাক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন। তাঁর নাম মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ঢাকায় তাঁর পরিচয় স্বাস্থ্যের মাফিয়া বা মিঠু সিন্ডিকেট নামে। মূল প্রতিষ্ঠানের নাম লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ, তার লেজে আছে নামে-বেনামে আরও ৬০ প্রতিষ্ঠান। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ করে’ বাজেট তৈরি করা থেকে শুরু করে কেনাকাটার যাবতীয় পরিকল্পনা করেন। এরপর সেই তালিকা ধরে সিএমএসডিকে দিয়ে জিনিসপত্র কেনাতে বাধ্য করেন। আর ঘুরেফিরে তার প্রতিষ্ঠানগুলোই দরপত্রে অংশ নেয়। এভাবে ২০ বছরের বেশি সময় তিনি জিম্মি করে রাখেন দেশের স্বাস্থ্য খাত।
কিন্তু কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। মিঠুর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক শহীদউল্লাহ ২০২০ সালে করোনায় মারা যাওয়ার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়ে মিঠুর ফিরিস্তি জানান। এরপর তদন্ত শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সব প্রতিষ্ঠান নড়েচড়ে বসে। খবর পেয়ে মিঠু চক্রের প্রধান মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু বিদেশে পাড়ি জমান। এখন তিনি নিউইয়র্কের কাছে ব্রংসভিল নামের একটি অভিজাত এলাকায় বাস করেন। আর রোলস রয়েস গাড়ি হাঁকান।
মিঠুর আদিবাস রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রাম। যদিও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তাঁর বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ঢাকার গুলশান, বনানী, এলিফ্যান্ট রোড, মালিবাগ, ডিওএইচএস এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সাতটি বাসার তথ্য আছে।
কিন্তু মিঠু দেশ ছাড়লেও তাঁর সহযোগীরা দিব্যি আছেন। মিঠুর দেখানো পথেই তাঁরা এখন চালাচ্ছেন স্বাস্থ্যের কেনাকাটা আর দূরে বসে সব নিয়ন্ত্রণ করছেন মিঠু। তাঁর নামে আরব-বাংলাদেশ ব্যাংকেই দেড় হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু প্রভাবের কারণে এক বছরেও সে সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
মিঠু চক্রের অপতৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, এসব অনিয়ম-দুর্নীতি আগের। তিনি তখন অধিদপ্তরের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে চেষ্টা করছেন।
মেরামতের আরও ব্যয়
প্রতিবেদনের শুরুতে বাচ্চাদের নিক্তি মেরামতের যে খরচের কথা বলা হলো, তার সঙ্গে ছিল একটি কার্ডিয়াক মনিটর মেরামতের খরচও। এই যন্ত্রটি কেনা হয়েছিল ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকায়। অথচ সেটি মেরামতে খরচ দেখানো হয় ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে ৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকায় ফটোথেরাপি যন্ত্র সরবরাহ করে মেরামত বাবদ নেওয়া হয় ৬ লাখ ৪০০ টাকা।
দেশি যন্ত্রে বিদেশি ট্যাগ
রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে সাতটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ২০১৬ সালের ২৯ মে কার্যাদেশ পায় কিউ সোর্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার স্বত্বাধিকারী মিঠুর ভাই মুকুল ইসলাম। পরদিন ৩০ মে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপানের তৈরি ২৪ কোটি ৮৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯০ টাকার সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়।
১ কোটি ৮ লাখ টাকায় পাঁচটি রেডিয়েন্ট ওয়ার্নার সরবরাহ করা হয়েছিল ডেভিড ব্র্যান্ডের, তাতে উৎপাদনকারী দেশের নাম ছিল জার্মানি। কিন্তু ওয়েবসাইটে এই নামের কোনো প্রতিষ্ঠানই খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, মিঠু সিন্ডিকেট এখনো সমানভাবে সক্রিয়। তাদের তৎপরতায় ২৬ কোটি টাকার প্রকল্প ১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
৬১ প্রতিষ্ঠান খুলে লুটপাট
একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মিঠু ৬১টি আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট বানিয়ে সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করেন। মিঠুর নিজ নামে আছে আটটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো মেক্সিকোর মার্চেন্ডাইজার, টেকনো ট্রেড, মেক্সিকোর আইটি পার্ক লিমিটেড, মেসার্স টেকনো ট্রেড, মেসার্স টেকনো ফিশিং, মেসার্স প্রি-এক্সর, সিআর মার্চেন্ডাইজ, লেক্সিকোন হসপিটালাইট, নর্থ এগ লিমিটেড, নর্থ বেঙ্গল পোলট্রি ফার্ম, অ্যাপল সিরামিক লি., মেড ইকুইপ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনভেনচার, টেকনোক্রেট ও এম গেটওয়ে করপোরেশন (যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত)। মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানার নামে তিনটি এবং বড় ভাই মো. মোকছেদুল ইসলামের নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া মিঠু অন্যান্য ভাই, ভাবি, ভাগনেসহ বন্ধু ও স্বজনদের নামে প্রতিষ্ঠান খুলে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত কয়েক বছরে মিঠুর স্ত্রীর ফিউচার ট্রেড ৮৬ কোটি টাকার বেশি কার্যাদেশ থেকে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ভাগনে মো. ফাহাদ মাহমুদের অরডেন্ট সিস্টেম ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আত্মসাৎ করে ৪ কোটি টাকা। মিঠুর ভাবি সাবিহাতুল জান্নাতের জিএসই অ্যান্ড ট্রেডিং কয়েক বছরে ৩২ কোটি ৬১ লাখ টাকার কার্যাদেশ থেকে আত্মসাৎ করে প্রায় ২০ কোটি টাকা। রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে মোকছেদুলের কিউ সোর্স ২০১৩-১৪ থেকে তিন অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চক্রটি সিএমএসডি থেকে ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার কার্যাদেশ পায়, তাতে ৪২ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এই সময়ে চক্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে আরও ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে গত বুধবার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। বাসার ফোনে কল করা হলে সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। অফিসের নম্বরে ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
দুদকের নিষ্ফল অনুসন্ধান
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিঠুর অন্যতম সহযোগী তাঁর ভাই মোকছেদুল ইসলাম ও ভাগনে বেনজীর আহমেদ। স্বাস্থ্য খাতে মিঠু চক্রের দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দুদক অনুসন্ধানে নামে। ২০১২ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় দুদক একটি মামলাও করে।
মামলায় ১৭টি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে মালপত্র সরবরাহ না করে বিল নেওয়া, বাজারদরের চেয়ে বহুগুণ বেশি দরে সরবরাহ এবং বিদেশি সামগ্রীর নামে স্থানীয় নিম্নমানের সামগ্রী সরবরাহ করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ ছিল। এগুলো অনুসন্ধান ও তদন্ত করেন দুদকের উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারি ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক। মিঠু চক্রের অন্যান্য কোম্পানির দুর্নীতির বিষয়েও ১০-১২টি নথি খোলা হয় দুদকে। সেগুলোর দায়িত্ব একাধিক কর্মকর্তাকে দেওয়া হলেও পরে সব একত্র করে সিরাজুল হক এক প্রতিবেদনের মাধ্যমেই তা নিষ্পত্তি করেন।
তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান শাখার মহাপরিচালক জয়নুল আবেদিন শিবলী জানান, মায়ের অসুস্থতার কারণে তিনি হাসপাতালে আছেন। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে পারছেন না।
দুদকের সাবেক এক মহাপরিচালক বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়ে থাকলে আদালতে পুনঃ তদন্ত চাওয়া যায়, আবার দুদক চাইলেও পুনঃ তদন্ত করতে পারে। কিন্তু মিঠুর প্রভাবের কারণে সবাই রহস্যজনকভাবে নীরব আছেন।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঘটনাগুলো নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে। যে করেই হোক দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে। তা না হলে আইনের শাসন কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
০৭ নভেম্বর ২০২৪