তীব্র তাপে পুড়ছে দেশ, বৃষ্টির অপেক্ষা ১০ দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৮: ৩৭
Thumbnail image

কাঠফাটা রোদে তপ্ত চারপাশ। যেন বৈশাখের সূর্য আগুন ঝরাচ্ছে। অস্বস্তিকর গরমে ঘর ছেড়ে বেরোনোই দায়! বিপর্যস্ত জনজীবন। তাপমাত্রার এ পারদ প্রতিদিনই চড়ছে। পুড়ছে গোটা দেশ। এর প্রভাবে হিট স্ট্রোকে পাবনা ও চুয়াডাঙ্গায় দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গরমজনিত রোগে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ। অতিরিক্ত গরমে ফল-ফসলেরও ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এদিকে চলমান এই তীব্র গরম থেকে এখনই পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছে না আবহাওয়া অধিদপ্তর। তারা বলছে, এই তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন চলবে। উইন্ডি বলছে, আগামী ১০ দিন দেশে বৃষ্টির সম্ভাবনা কম।

৪০ ডিগ্রির ওপরে ১২ জেলা
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি মৌসুমে দেশে এটিই সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। এদিন চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায়ও গতকাল তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। এদিন এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

শুধু এই তিন জেলাই নয়, গতকাল দেশের ১২টি জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি ছিল। এর মধ্যে যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ তিন এলাকায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি বা তার বেশি ছিল। অপর এলাকাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী। এখানে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৪১ থেকে ৪২ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা ছিল রাজশাহী, খুলনা, বাগেরহাটের মোংলায় ও কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। আর ৪০ থেকে ৪১ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা ছিল ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও সাতক্ষীরায়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তা মাঝারি তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তা তীব্র তাপপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালে তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।

হিট স্ট্রোকে দুজনের মৃত্যু
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় ঠাকুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি জাকির হোসেন (৩৩) গতকাল সকালে ধানখেতে সেচ দিতে গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি হিট স্ট্রেক আক্রান্ত হন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হেলেনা আক্তার বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই জাকির হোসেনের মৃত্যু হয়। অতিরিক্ত গরমে তাঁর হিট স্ট্রোক হয়েছিল।

এদিকে দুপুরে পাবনা শহরের রূপকথা রোডে চা পানের সময় হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন শহরের শালগাড়িয়া জাকিরের মোড়ের বাসিন্দা সুকুমার দাস (৬০)। উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম।

এই অবস্থায় গরমে সুস্থ থাকতে বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, গরমে সুস্থ থাকতে বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। কারণ, তীব্র গরমে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। এ সময় পানি না খেলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।

যশোরে তাপে গলছে পিচ
এক সপ্তাহ ধরেই খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তিন দিন আগে ১৮ এপ্রিল যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এদিন তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যশোরে গতকাল আবারও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তীব্র গরমে যশোর-নড়াইল, যশোর-ঝিনাইদহ ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের কিছু কিছু স্থানে সড়কের পিচ গলে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে পিচ গলার কথা। কিন্তু তার অনেক আগেই পিচ গলে যাচ্ছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, যশোর-নড়াইল সড়কের যেসব স্থানে বিটুমিনের পরিমাণ বেশি পড়েছে, প্রচণ্ড গরমে সেসব জায়গা গলে যাচ্ছে। এ জন্য সড়কের গলে যাওয়া স্থানে বালু ও নুড়িপাথর দেওয়া হচ্ছে, যাতে গলে যাওয়া পিচ আগের অবস্থায় থাকে।

তাপপ্রবাহ চলবে আরও কয়েক দিন
চলমান তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন চলবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। একই সঙ্গে তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তাও (হিট অ্যালার্ট) আজ রোববার পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে। গতকাল ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে অধিদপ্তর বলেছে, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগের কিছু জেলা এবং বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ প্রবাহিত হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, চলমান তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। জারি করা হিট অ্যালার্টেও আপাতত কোনো পরিবর্তন আসছে না। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী চেক প্রজাতন্ত্রভিত্তিক ওয়েবসাইট উইন্ডির তথ্য বলছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তানের একাংশ, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের ওপর দিয়ে মাঝারি থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকবে। বঙ্গোপসাগর ও এর আশপাশের এলাকায় কোনো মেঘমালা গতকাল পর্যন্ত ছিল না। আগামী মঙ্গলবার থেকে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও আন্দামান সাগরে মেঘমালা তৈরি হতে শুরু করবে। ১০ দিন পর গিয়ে সেই মেঘমালা উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করবে। তার আগে ভারী বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই।

বিপর্যস্ত জনজীবন
এদিকে টানা তীব্র গরমে ও তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষতির ঝুঁকিতে ধানসহ মাঠের ফসল। কাজ কম থাকায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। চুয়াডাঙ্গা শহরের গৃহিণী তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘গরমে ট্যাংকের পানিও গরম হয়ে গেছে।’ মেহেরপুরের গাংনী শহরের অটোরিকশাচালক মো. আরেফিন ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত গরমে যাত্রী পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। মানুষ খুব একটা বের হচ্ছে না।

তীব্র গরমে ফল-ফসলের ক্ষতি থেকে বাঁচতে বিশেষ যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, যেসব অঞ্চলে (পাহাড়ি ও বরেন্দ্র) তীব্র পানির সংকট ও তাপপ্রবাহ, সেখানে গাছে সকালে অথবা বিকেলে পানি স্প্রে করা যেতে পারে। মাটির বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ফলন্ত গাছে ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। না হলে আম, লিচু, কাঁঠাল এ সময় তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঝরে পড়বে। প্রয়োজন অনুযায়ী সারও দিতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত