৩ হাজার বছরের পুরোনো টানেলের নকশা যেভাবে ২১ শতকের রাস্তাকে শীতল করছে

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

গত গ্রীষ্মে দক্ষিণ স্পেনের শহর সেভিয়ার তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য শহরগুলোর মতো সেভিয়ার নকশাও এমন তাপমাত্রা বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়নি। এ অবস্থায় সেভিয়ার একটি গবেষণা দল মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন একটি সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে—যারা বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগে এমন ভয়াবহ তাপের হাত থেকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছিল।

মজিদ লাব্বাফ খানেইকি মুষ্টিমেয় সেই বিশেষজ্ঞদের অন্যতম যারা ৩ হাজার বছরের পুরোনো কানাত নামের ভূগর্ভস্থ পানির প্রযুক্তিকে আধুনিক বিশ্বে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছেন।

শুরুর দিকে কানাত নামের এই টানেল তৈরি হতো কুড়াল ও বেলচা দিয়ে। চীন, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আফগানিস্তানে এ ধরনের টানেল তৈরি হতো। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে পারস্যে তৈরি হয়েছিল প্রথম কানাত এবং তারপর ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে শুষ্ক অঞ্চলে।

প্রাচীন এই ব্যবস্থাটি মরুভূমি পৃষ্ঠের ২০ থেকে ২০০ মিটার নিচে ভূগর্ভস্থ বেশ কয়েকটি খালের একটি নেটওয়ার্ক দিয়ে গঠিত—যা উঁচু থেকে নিচে পানি পরিবহন করে। সামান্য ঢালে নির্মিত খালগুলো থেকে পানি পরিবহনের জন্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহার করা হয়। ওপর থেকে পুরো ব্যবস্থাটিকে মরুভূমির মধ্য দিয়ে ঘুরতে থাকা হাজার হাজার সারিবদ্ধ পিঁপড়ের ঢিবির মতো দেখায়।

ওমানের নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওহাইড্রোলজির ৪৯ বছর বয়সী অধ্যাপক খানেইকি তার পুরো কর্মজীবন শুষ্ক এবং আধা-শুষ্ক পরিবেশের ভূগর্ভস্থ পানি বহনকারী প্রাচীন টানেলগুলো নিয়ে গবেষণা করতে ব্যয় করেছেন। তিনি জানান, প্রাচীন কানাত ব্যবস্থা মরুভূমির পরিবেশে সেচ এবং কৃষির বিকাশকে সম্ভব করে তোলে। এই ব্যবস্থাকে ইরানে বিকেন্দ্রীকৃত পানি ব্যবস্থাপনার ভিত্তি এবং আধুনিক পাম্পিং ও বাঁধের আরও টেকসই সমাধান হিসেবে দেখা হয়।

পারস্যের কানাতের মডেল। ছবি: ইরান দুস্তানমধ্যপ্রাচ্যের শুষ্ক অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে, এমনকি চীন থেকেও দূরে, বিজ্ঞানী হোসে সানচেজ রামোস এবং সার্ভান্দো আলভারেজ স্পেনের সেভিয়া শহরে ব্যবহার করেছেন কানাতের এই ধারণা।

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার হাত থেকে শহরকে বাঁচানোর অংশ হিসেবে টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে রামোস এবং আলভারেজকে শক্তি-ঘনিষ্ঠ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর না করে বাইরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনার পরীক্ষা করার জন্য একটি স্থান বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে একটি জায়গা ছিল শহরের কেন্দ্রের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এলাকা লা ইসলা দে লা কার্তুজা। ঝোপঝাড়ে পূর্ণ পরিত্যক্ত এই জরাজীর্ণ মনোরেল স্টেশন এবং অ্যাম্ফিথিয়েটারকেই গবেষণা ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সের জায়গা হিসেবে নির্বাচন করা হয় যেখানে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ হাজার কর্মীকে। এটিই হয়ে ওঠে রামোস এবং আলভারেজের কাজের কেন্দ্র।

কার্তুজাকানাত নামের এই প্রকল্পটি ফারসি কানাত সিস্টেমের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে। লা ইসলা দে লা কার্তুজার মধ্যে দুটি ফুটবল মাঠের আকারের একটি স্থানের স্থল তাপমাত্রাকে ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানোর লক্ষ্যে শুরু হয় কাজ।

সেভিয়ার কারতুজাকানাত। ছবি: সংগৃহীতআংশিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরবান ইনোভেটিভ অ্যাকশনের (ইউআইএ) অর্থায়নে এই ৫০ লাখ ইউরোর প্রকল্পটিতে পানি বহনের জন্য ২০ মিটার গভীর একটি ভূগর্ভস্থ খাল তৈরি করা হয়েছে। তবে খালটির কাজ পানি পরিবহন নয়। রামোস বলেন, খাল বরাবর লম্বালম্বি বেশ কয়েকটি জানালা রাখা হয়েছে যেগুলো পানির শীতলতাকে ওপরের দিকে পাঠাবে। এতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমবে। জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলোর চাবিকাঠি হল দিন-রাতের চক্র।

রাতের বেলায় স্বাভাবিকভাবে কম তাপমাত্রায় ভূগর্ভস্থ প্রায় ১৪০ কিউবিক মিটার পানি (৩৬ হাজার ৯৮৪ কিউবিক গ্যালন) ঠান্ডা হয়ে যায়। কিছু পানি পাম্প করে অ্যাম্ফিথিয়েটারের ছাদে পাঠানো হয়। ছাদটি আবৃত সোলার প্যানেলে। নজল ফ্যান দিয়ে প্যানেলের ওপরের পানি বের করা হয়। পানির গভীরতা কমিয়ে এবং ভেতরের কম তাপমাত্রায় পানিকে দ্রুত শীতল করে এই প্রক্রিয়া।

দিনের বেলা সৌর-চালিত পাম্পগুলো ঠান্ডা পানিকে মাটির ওপরে ঠেলে দেয় যেখানে ছোট ছোট পাইপগুলো ফানেলের মতো কাজ করে। এতে ঠান্ডা পানিকে ফ্যানের সামনে ঠেলে দেওয়া হয় আর সেই ফ্যান অ্যাম্ফিথিয়েটারের নিচতলায় শীতল বাতাস ছড়িয়ে দেয়। বাইরে জলাধারে থাকে পৃথক এক সেট পাইপ—যা বাতাসে স্প্রে করে ঠান্ডা বাষ্প।

অন্যান্য আরও কয়েকটি উপাদান তাপমাত্রা কম রাখতে সাহায্য করে। ভেতরের দেয়ালে লাগানো গাছপালা বাষ্পের মাধ্যমে শীতল হয়, গাছগুলো বাইরে ছায়া দেয়। এ ছাড়া, ছাদকে সাদা রং করা হয় যাতে তা তাপ প্রতিফলিত করতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত