বগুড়ায় দখল-দূষণে ধুঁকছে ১৮ নদী

গনেশ দাস, বগুড়া
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪, ১২: ৪৩
Thumbnail image

তিন দশক আগেও নদীগুলোতে ছিল পানির প্রবাহ। ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছে ভরপুর। সেই নদীগুলো এখন মরা খাল। নদীর কোথাও চাষ হচ্ছে ফসল, আবার কোথাও সামান্য পানি থাকলেও তা ময়লা-আবর্জনা, কারখানার তরল বর্জ্যে দূষিত হয়ে কালো কুচকুচে রং ধারণ করেছে। এ দৃশ্য বগুড়ার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ১৮টি নদীর। 

নদী গবেষকেরা জানান, ১০০ বছর আগেও বগুড়ায় নদী ছিল ৩০টির মতো। এখন কাগজে-কলমে ১৮টি বলা হলেও বাস্তবে ১০-১২টি নদী আছে, সেগুলোও এখন মরা খাল। সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়ার প্রধান তিনটি নদী যমুনা, বাঙ্গালী ও করতোয়ার অবস্থা শোচনীয়। কোথাও সামান্য পানি থাকলেও বাঙ্গালী ও যমুনা নদীর বুকজুড়ে বিশাল বালুচর। 

সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনাপারের বাসিন্দা হাসেম আলী বলেন, ৩০ বছর আগেও যমুনা নদীতে ছিল প্রচুর মাছ। সারা বছরই নদীতে মিলত দেশি প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ। অসংখ্য পরিবারের পেশা ছিল নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করা। সেই নদী নামে থাকলেও এখন পানি নেই। ধু-ধু বালুচর। নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। 

একই অবস্থা বাঙ্গালী নদীর। তীরের বাসিন্দারা বলেন, বাঙ্গালী নদীতে পাওয়া যেত দেশি প্রজাতির ছোট ছোট মাছ। তাঁদের অনেকেই মাছ কিনে খেতেন না। এখন মাছ তো দূরের কথা, নদীতে গবাদিপশু গোসল করানোর মতো পানি নেই। বগুড়া শহরতলির বেজোড়া গ্রামের বাসিন্দা আবু বক্কর জানান, তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী দিয়ে পালতোলা নৌকা যেতে দেখেছেন একসময়। শীতকালে নদীর তীরসংলগ্ন অল্প পানিতে বিভিন্ন গাছের ডালপালা দিয়ে রাখতেন। চৈত্র মাসে ঘেরজাল দিয়ে ঘিরে ডালপালা সরিয়ে মাছ ধরতেন। শুষ্ক মৌসুমে গ্রামের শত শত মানুষ মাছ ধরতে নামতেন। এখন নদীতে সামান্য পানি থাকলেও তা এতটাই দূষিত, গোসল করালে গরুরও চর্মরোগ দেখা দেয়। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদী রয়েছে ১৮টি। নিরঞ্জন এবং বেহুলার খাড়ি নামক দুটি নদীর নাম কাগজে পাওয়া গেলেও বাস্তবে কোনো চিহ্ন নেই। যে ১৮টি নদী দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে যমুনা, বাঙ্গালী, করতোয়া, নাগর, ইছামতী, ভদ্রাবতী, চন্দ্রাবতী, হলহলিয়া, মহিষাবান, সুখদহ, ডাকুরিয়া, বেলাই, গাংনাই, গজারিয়া, মানাস, বানিয়াজান, ইরামতি ও ভোলকা। এর মধ্যে প্রধান তিনটি—যমুনা, বাঙ্গালী ও করতোয়া নদীর অবস্থা করুণ। যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে শুষ্ক মৌসুমে বিশাল চর জেগে ওঠে। পানি না থাকায় নৌযান চলে না শুষ্ক মৌসুমে।

করতোয়া নদী দখলদারদের কবলে পড়ে নালায় পরিণত হয়েছে। তবে তারা নদীগুলো রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ভদ্রাবতী, সুখদহ, বানিয়াজানসহ কয়েকটি নদী খনন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে নদীগুলো খনন করে নাব্যতা ফিরে আনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু নদীর পুরো অংশ খনন না করায় এই নদীগুলোতে বর্তমানে পানি নেই। 

নদী গবেষক ও বগুড়া সরকারি মজিবর রহমান মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ ড. বেলাল হোসেন জানান, ৫০০ বছর আগে বগুড়ায় ১০০টির বেশি নদী ছিল। আর ১০০ বছর আগেও নদী ছিল ৩০টি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন, দখল এবং উজানে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা কারণে নদীগুলো মরা খালে পরিণত হয়েছে। 

বেলাল হোসেন বলেন, ‘এই অঞ্চলের অধিকাংশ বড় নদীগুলোর উৎপত্তি ভারত থেকে। ভারত আমাদের উজানে থাকায় তারা বাঁধ দিয়ে নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ভাটির দিকে নদীগুলো মরে যাচ্ছে। সেই সুযোগে নদী দখল করে কলকারখানা স্থাপন, বাড়িঘর নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন করে নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।’ 

পাউবো বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, চলতি মৌসুমে করতোয়া নদী ছাড়া আরও দুটি খাল খননের প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। ৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে করতোয়া নদীর ১৭ কিলোমিটার ও দুটি খালের খননকাজ শুরু হয়েছে। নদীগুলোর পানির প্রবাহ ধরে রাখতে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত