ড. ম. তামিম
আজকের পত্রিকা: সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য দাবি করার পরেও বর্তমানে বিপর্যয়ের কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?
ম. তামিম: আমরা তো বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক কারণে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মূল সমস্যা আমাদের জ্বালানি। জ্বালানি খাতকে যদি আমরা উন্নয়ন না করি, তাহলে বিদ্যুৎ আসবে কোথা থেকে? বিদ্যুৎকেন্দ্র তো আমাদের বসে আছে। প্রাথমিক জ্বালানি যদি আমরা সরবরাহ করতে না পারি, তাহলে হাজার হাজার বিদ্যুৎকেন্দ্র করে কোনো লাভ নেই।
আবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব ছিল। সেটার জন্য কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখার দরকার ছিল। এখন আমরা বলছি, আমাদের ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাদ দিলে
সেটা ২২ হাজার মেগাওয়াটে পরিণত হয়। এর মধ্যে আবার ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এসব অকেজো
মেশিন থেকে আর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে না। কিন্তু সেই উৎপাদনের বিষয়টি কাগজে-কলমে দেখিয়ে সক্ষমতার মধ্যে ধরা হচ্ছে। আমার মতে, এ বিষয়ে স্বচ্ছতা তৈরি করা উচিত। আমাদের প্রকৃত সক্ষমতাকে সামনে এনে পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।
দ্বিতীয়ত, আগামী ১০ বছরে আমাদের শিল্প ও আবাসিক খাতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগবে, সেই হিসাবটা বের করতে হবে। এই পরিকল্পনায় হিসাব কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। তবে অতি উৎপাদন কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম উৎপাদন নানা বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
তৃতীয়ত, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সরবরাহ সক্ষমতা বাড়াতে হবে; বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে।
রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যখন স্থাপন করা হয়েছে, তখন দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য সেগুলো দরকার ছিল। রামপালের মতো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চালু হয়ে গেলে এখন বিদ্যুতের সংকট সৃষ্টি হতো না।
আজকের পত্রিকা: সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাহী ক্ষমতাবলে সরকার সম্প্রতি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
ম. তামিম: সব দেশের সব সরকারেরই নিজের আইন ভঙ্গ করার একটা প্রবণতা থাকে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার শুরু হয়। এই সংস্কারের মধ্যেই ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করা। সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করাই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাজ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রচণ্ড চাপেই ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে এটি কার্যকর হতে শুরু করে। এখন যা করা হচ্ছে, এটা পরিষ্কারভাবে পেছনের দিকে যাওয়া। এতে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহি কমে যাবে।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স নেয়। তবে মূল কাজটা হচ্ছে দাম নির্ধারণ। শুধু বিশেষ সময়ে দাম নির্ধারণ করবে সরকার। কিন্তু এবার পুরোপুরি বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।
বিইআরসির কাছ থেকে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের হাতে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। নিয়মিত দাম সমন্বয়ের জন্য বিষয়টি করা হয়েছে। কিন্তু এ কাজটি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ক্ষেত্রে প্রতি মাসে করে দেখিয়েছে বিইআরসি। সুতরাং বিদ্যুৎ খাতেও এটি চাইলে বিইআরসি করতে পারত। আবার বিইআরসির হাত থেকে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে নিলে জনগণের কাছে জবাবদিহির প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তখন বিদ্যুৎ খাতের ইউটিলিটি কোম্পানিগুলো আরও অদক্ষ হয়ে পড়বে। কোম্পানিগুলো স্বেচ্ছাচারীও হয়ে উঠবে।
সরকার এবার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কাজটি মূলত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি করে থাকে। এখন আমি জানি না, এই দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি কি সমান্তরালভাবে চলতে থাকবে? অর্থাৎ সরকারও দাম বাড়াবে, আবার বিইআরসিও দাম বাড়াবে। নাকি সরকার একবার বাড়াবে, আরেকবার বিইআরসি বাড়াবে? আমি এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নই। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, মূল্য নির্ধারণে বিইআরসির আর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
কোনো দেশেই এসব সংস্থা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে না। তবে গণশুনানির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করলে শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করা যেত। এবার সরকার যা করেছে, তাতে এ সংস্থাটির ভবিষ্যতে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা না-ও থাকতে পারে। প্রতিষ্ঠার পর দাম সমন্বয় ছাড়াও দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নজরদারি, বিনিয়োগ ও সামর্থ্য বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে বিইআরসি। যদিও জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে সংস্থাটির দাম সমন্বয়ের ক্ষমতা থাকলেও কয়েক বছর ধরে তা করে আসছিল মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে একরকম পঙ্গু করে ফেলা হলো বিইআরসিকে।
আজকের পত্রিকা: বিদ্যুতের দাম যখন বাড়ে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দাম বাড়ানো হচ্ছে না, আর্থিক ঘাটতি সমন্বয় করা হচ্ছে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার বক্তব্য কী?
ম. তামিম: সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় নানান যুক্তি দিয়ে থাকে। আমরা জানি যে তেলের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম খুব দ্রুত ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম সেই তুলনায় বেশ সময় নিয়ে ওঠানামা করে। এমনকি মাসিক ভিত্তিতেও দামের ওঠানামার সুযোগ কম। একমাত্র বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হয়।
বিদ্যুৎ খাতে কখনোই পরিস্থিতি এমন হয় না যে তিন দিনের মধ্যে দাম বাড়াতে হবে। সরকার চাইলে তিন দিন পর বিইআরসির মাধ্যমেই দাম বাড়াতে পারত। এতে সরকারের প্রতিও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ত। নির্বাহী আদেশে করার কোনো দরকার ছিল না। এতে কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না। এখন কমিশনের কিছু করার থাকল না। তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হলো। কিছুদিন আগে সরকার আইন সংশোধন করে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নেওয়ার পর বিইআরসি গণশুনানি করেছে। এতে আশাবাদী হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সরকার জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া তাদের মূল্য সমন্বয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করবে না। কিন্তু এখন দেখলাম, জরুরি পরিস্থিতি ছাড়াই ক্ষমতা ব্যবহার করল সরকার। এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় না।
আজকের পত্রিকা: সামনে ইরি-বোরো মৌসুম এবং জিনিসপত্রের দাম আগে থেকেই আকাশচুম্বী। এখন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে এর প্রভাব তো কৃষি এবং সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
ম. তামিম: এমনিতেই হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোয় বাজারে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। মূলত তেলের দাম বৃদ্ধি হলে বাজারের সবকিছুতে এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশ তো সব সম্ভবের দেশ। আর ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক কিছুই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আমরা খুবই কঠিন একটি সময় পার করছি। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। শক্ত হাতে সরকারকে দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ক্যাপটিভ (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) থাকায় রপ্তানিমুখী শিল্পে (তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত) হয়তো বড় প্রভাব পড়বে না। তবে দেশীয় উৎপাদন শিল্পে খরচ বেড়ে যাবে। তেল, চিনির প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি। এর আগে সাবানের দাম এক লাফে অনেক বেড়ে গেছে। এ ধরনের সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকবে। এতে নিত্যপণ্যের বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এটা জ্বালানি তেলের মতো সঙ্গে সঙ্গে হবে না, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ধীরে ধীরে পড়তে পারে।
আজকের পত্রিকা: সরকার তো নতুন বছরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার কথা বলেছিল, সম্প্রতি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর কারণ কী?
ম. তামিম: মূলত বিদ্যুৎ খাতের জন্য যে জ্বালানি দরকার, তার সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে যেসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তারা সংকটে পড়েছে। বিষয়টি এমন নয় যে বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও দাম বেড়েছে। মূল কারণটি হলো ডলার সংকট। এই ডলার সংকটের কারণেই ফার্নেস তেল দ্বারা পরিচালিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ঠিকমতো চালু রাখা যাচ্ছে না। ডলার সংকটের কারণে ফার্নেস তেল আমদানি বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এখন রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহে সংকট দেখা গেছে ওই ডলার সংকটের কারণেই। সেই সংকট দূর করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আজকের পত্রিকা: এবার গ্যাসের দাম বাড়ল ৮২ শতাংশ। এর প্রভাব তো সাধারণ জনগণের ওপরই ব্যাপকভাবে পড়বে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
ম. তামিম: মাঝারি ও ছোট শিল্পের সঙ্গে রপ্তানি শিল্পও সমস্যার সম্মুখীন হবে। দেশীয় উৎপাদন ব্যাহত হবে। গ্যাসচালিত সব পণ্য উৎপাদনের দাম বাড়বে, যাতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যাবে। ১১ টাকা ৬৪ পয়সার গড় গ্যাসের দাম এক লাফে ২১ টাকা ২৭ পয়সা বাড়ানো হলো; অর্থাৎ পেট্রোবাংলা এখন প্রচুর লাভ করবে। এই দুর্যোগে যেখানে বিশ্বের ধনী দেশগুলো ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষকে আরও একটা গহ্বরে ফেলা হলো।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ম. তামিম: আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য দাবি করার পরেও বর্তমানে বিপর্যয়ের কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?
ম. তামিম: আমরা তো বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক কারণে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মূল সমস্যা আমাদের জ্বালানি। জ্বালানি খাতকে যদি আমরা উন্নয়ন না করি, তাহলে বিদ্যুৎ আসবে কোথা থেকে? বিদ্যুৎকেন্দ্র তো আমাদের বসে আছে। প্রাথমিক জ্বালানি যদি আমরা সরবরাহ করতে না পারি, তাহলে হাজার হাজার বিদ্যুৎকেন্দ্র করে কোনো লাভ নেই।
আবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব ছিল। সেটার জন্য কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখার দরকার ছিল। এখন আমরা বলছি, আমাদের ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাদ দিলে
সেটা ২২ হাজার মেগাওয়াটে পরিণত হয়। এর মধ্যে আবার ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এসব অকেজো
মেশিন থেকে আর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে না। কিন্তু সেই উৎপাদনের বিষয়টি কাগজে-কলমে দেখিয়ে সক্ষমতার মধ্যে ধরা হচ্ছে। আমার মতে, এ বিষয়ে স্বচ্ছতা তৈরি করা উচিত। আমাদের প্রকৃত সক্ষমতাকে সামনে এনে পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।
দ্বিতীয়ত, আগামী ১০ বছরে আমাদের শিল্প ও আবাসিক খাতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগবে, সেই হিসাবটা বের করতে হবে। এই পরিকল্পনায় হিসাব কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। তবে অতি উৎপাদন কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম উৎপাদন নানা বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
তৃতীয়ত, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সরবরাহ সক্ষমতা বাড়াতে হবে; বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে।
রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যখন স্থাপন করা হয়েছে, তখন দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য সেগুলো দরকার ছিল। রামপালের মতো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চালু হয়ে গেলে এখন বিদ্যুতের সংকট সৃষ্টি হতো না।
আজকের পত্রিকা: সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাহী ক্ষমতাবলে সরকার সম্প্রতি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
ম. তামিম: সব দেশের সব সরকারেরই নিজের আইন ভঙ্গ করার একটা প্রবণতা থাকে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার শুরু হয়। এই সংস্কারের মধ্যেই ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করা। সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করাই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাজ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রচণ্ড চাপেই ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে এটি কার্যকর হতে শুরু করে। এখন যা করা হচ্ছে, এটা পরিষ্কারভাবে পেছনের দিকে যাওয়া। এতে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহি কমে যাবে।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স নেয়। তবে মূল কাজটা হচ্ছে দাম নির্ধারণ। শুধু বিশেষ সময়ে দাম নির্ধারণ করবে সরকার। কিন্তু এবার পুরোপুরি বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।
বিইআরসির কাছ থেকে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের হাতে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। নিয়মিত দাম সমন্বয়ের জন্য বিষয়টি করা হয়েছে। কিন্তু এ কাজটি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ক্ষেত্রে প্রতি মাসে করে দেখিয়েছে বিইআরসি। সুতরাং বিদ্যুৎ খাতেও এটি চাইলে বিইআরসি করতে পারত। আবার বিইআরসির হাত থেকে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে নিলে জনগণের কাছে জবাবদিহির প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তখন বিদ্যুৎ খাতের ইউটিলিটি কোম্পানিগুলো আরও অদক্ষ হয়ে পড়বে। কোম্পানিগুলো স্বেচ্ছাচারীও হয়ে উঠবে।
সরকার এবার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কাজটি মূলত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি করে থাকে। এখন আমি জানি না, এই দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি কি সমান্তরালভাবে চলতে থাকবে? অর্থাৎ সরকারও দাম বাড়াবে, আবার বিইআরসিও দাম বাড়াবে। নাকি সরকার একবার বাড়াবে, আরেকবার বিইআরসি বাড়াবে? আমি এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নই। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, মূল্য নির্ধারণে বিইআরসির আর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
কোনো দেশেই এসব সংস্থা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে না। তবে গণশুনানির মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করলে শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করা যেত। এবার সরকার যা করেছে, তাতে এ সংস্থাটির ভবিষ্যতে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা না-ও থাকতে পারে। প্রতিষ্ঠার পর দাম সমন্বয় ছাড়াও দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নজরদারি, বিনিয়োগ ও সামর্থ্য বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে বিইআরসি। যদিও জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে সংস্থাটির দাম সমন্বয়ের ক্ষমতা থাকলেও কয়েক বছর ধরে তা করে আসছিল মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে একরকম পঙ্গু করে ফেলা হলো বিইআরসিকে।
আজকের পত্রিকা: বিদ্যুতের দাম যখন বাড়ে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দাম বাড়ানো হচ্ছে না, আর্থিক ঘাটতি সমন্বয় করা হচ্ছে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার বক্তব্য কী?
ম. তামিম: সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় নানান যুক্তি দিয়ে থাকে। আমরা জানি যে তেলের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম খুব দ্রুত ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম সেই তুলনায় বেশ সময় নিয়ে ওঠানামা করে। এমনকি মাসিক ভিত্তিতেও দামের ওঠানামার সুযোগ কম। একমাত্র বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হয়।
বিদ্যুৎ খাতে কখনোই পরিস্থিতি এমন হয় না যে তিন দিনের মধ্যে দাম বাড়াতে হবে। সরকার চাইলে তিন দিন পর বিইআরসির মাধ্যমেই দাম বাড়াতে পারত। এতে সরকারের প্রতিও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ত। নির্বাহী আদেশে করার কোনো দরকার ছিল না। এতে কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না। এখন কমিশনের কিছু করার থাকল না। তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হলো। কিছুদিন আগে সরকার আইন সংশোধন করে দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নেওয়ার পর বিইআরসি গণশুনানি করেছে। এতে আশাবাদী হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সরকার জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া তাদের মূল্য সমন্বয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করবে না। কিন্তু এখন দেখলাম, জরুরি পরিস্থিতি ছাড়াই ক্ষমতা ব্যবহার করল সরকার। এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় না।
আজকের পত্রিকা: সামনে ইরি-বোরো মৌসুম এবং জিনিসপত্রের দাম আগে থেকেই আকাশচুম্বী। এখন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে এর প্রভাব তো কৃষি এবং সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
ম. তামিম: এমনিতেই হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোয় বাজারে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। মূলত তেলের দাম বৃদ্ধি হলে বাজারের সবকিছুতে এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশ তো সব সম্ভবের দেশ। আর ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক কিছুই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আমরা খুবই কঠিন একটি সময় পার করছি। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। শক্ত হাতে সরকারকে দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ক্যাপটিভ (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) থাকায় রপ্তানিমুখী শিল্পে (তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত) হয়তো বড় প্রভাব পড়বে না। তবে দেশীয় উৎপাদন শিল্পে খরচ বেড়ে যাবে। তেল, চিনির প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি। এর আগে সাবানের দাম এক লাফে অনেক বেড়ে গেছে। এ ধরনের সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকবে। এতে নিত্যপণ্যের বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এটা জ্বালানি তেলের মতো সঙ্গে সঙ্গে হবে না, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ধীরে ধীরে পড়তে পারে।
আজকের পত্রিকা: সরকার তো নতুন বছরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার কথা বলেছিল, সম্প্রতি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর কারণ কী?
ম. তামিম: মূলত বিদ্যুৎ খাতের জন্য যে জ্বালানি দরকার, তার সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে যেসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তারা সংকটে পড়েছে। বিষয়টি এমন নয় যে বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও দাম বেড়েছে। মূল কারণটি হলো ডলার সংকট। এই ডলার সংকটের কারণেই ফার্নেস তেল দ্বারা পরিচালিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ঠিকমতো চালু রাখা যাচ্ছে না। ডলার সংকটের কারণে ফার্নেস তেল আমদানি বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এখন রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহে সংকট দেখা গেছে ওই ডলার সংকটের কারণেই। সেই সংকট দূর করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আজকের পত্রিকা: এবার গ্যাসের দাম বাড়ল ৮২ শতাংশ। এর প্রভাব তো সাধারণ জনগণের ওপরই ব্যাপকভাবে পড়বে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
ম. তামিম: মাঝারি ও ছোট শিল্পের সঙ্গে রপ্তানি শিল্পও সমস্যার সম্মুখীন হবে। দেশীয় উৎপাদন ব্যাহত হবে। গ্যাসচালিত সব পণ্য উৎপাদনের দাম বাড়বে, যাতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যাবে। ১১ টাকা ৬৪ পয়সার গড় গ্যাসের দাম এক লাফে ২১ টাকা ২৭ পয়সা বাড়ানো হলো; অর্থাৎ পেট্রোবাংলা এখন প্রচুর লাভ করবে। এই দুর্যোগে যেখানে বিশ্বের ধনী দেশগুলো ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষকে আরও একটা গহ্বরে ফেলা হলো।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ম. তামিম: আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে