অন্যথা হলে কী করব, সে বিষয়ে কর্মপন্থা স্থির করেছি

এম এস রানা
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮: ৫২
আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯: ১০

হোলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে ভারতে নির্মিত ‘ফারাজ’ মুক্তি পাচ্ছে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি। এদিকে একই ঘটনার ছায়া অবলম্বনে বাংলাদেশের নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বানানো ‘শনিবার বিকেল’ চার বছর যাবৎ আটকে আছে সেন্সর বোর্ডে। ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সিনেমাটির মুক্তি নিশ্চিত করতে আলটিমেটাম দিয়েছেন নির্মাতা। এসব নিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে কথা বলেছেন এম এস রানা

‘শনিবার বিকেল’ সিনেমায় কী এমন দৃশ্য বা সংলাপ আছে, যে কারণে সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়া যাচ্ছে না?
এমন কোনো দৃশ্য বা সংলাপ নেই। কারণ, সেন্সর বোর্ড ২০১৯-এর ৯ জানুয়ারি প্রথম যখন সিনেমা দেখল, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলল, ‘খুব ভালো সিনেমা হয়েছে, আমরা দ্রুতই এর সেন্সর ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছি।’ এরপর কার বা কাদের চাপে পড়ে তারা দ্বিতীয়বার সিনেমাটা দেখল এবং আমাদের অদ্ভুত একটি চিঠি দিল। সেই চিঠিতে ঢালাওভাবে কয়েকটা কারণ উল্লেখ করেছে—দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট, ধর্মীয় অনুভূতি এসব।’ 

গত বছর শিল্পী-নির্মাতাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, শিগগিরই ‘শনিবার বিকেল’-এর সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়া হবে। এরপরও এই বিলম্বের কারণ কিছু জেনেছেন?
তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন উনার কিছু অবজারভেশন আছে, যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুজন সদস্য মারা গেছেন, তাঁদের বিষয়টি এখানে আসেনি। এখন এ বিষয় তাঁরা আমাদের চিঠি দিয়ে জানাবেন। চিঠি দিলে আমাদের কী উত্তর আছে, সেটা আমরা বলব। কিন্তু সেই চিঠি না দিয়ে তাঁরা আবার আপিল কমিটির মিটিং ডাকলেন, যে মিটিং ৩ বছর আগে একবার হয়েছে।

সিনেমাটি বাংলাদেশের হোলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার অনুপ্রেরণায় নির্মিত। একই ঘটনা নিয়ে ভারতে ‘ফারাজ’ মুক্তি পাচ্ছে ৩ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের ঘটনা বলেই কি ভারতে সিনেমাটি মুক্তি পাচ্ছে? নাকি ওই দেশের সেন্সর বোর্ড উদার বা সাহসী?
ওই দেশের সেন্সর বোর্ড কী, সেটা আমি জানি না। তবে পৃথিবীর কোনো সেন্সর বোর্ডেই ‘শনিবার বিকেল’ আটকাবে না। বাংলাদেশে আমি সেন্সর বোর্ডকে দায়ী করতে চাই না, আমি মনে করি, এর পেছনে এক বা কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা কলকাঠি নেড়েছেন। যেখানে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার ছায়া অবলম্বনে সিনেমা করা যাচ্ছে না, সেখানে ভারতে সিনেমা তৈরি হয়ে অলরেডি মুক্তি পাচ্ছে। তারা তো সেই ঘটনার ছায়া অবলম্বন নয় বরং সরাসরি হোলি আর্টিজানের নাম বলছে, চরিত্রের নাম বলছে। আমাদের সিনেমায় তো ওসবের উল্লেখই নাই। তাই আমি মনে করি, যাঁরা কেবল বাংলাদেশের সিনেমাই না বরং দেশের মানুষকে অপমানের মুখে দাঁড় করিয়েছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

বাংলাদেশে সেন্সরশিপ প্রথা বাতিল করে সার্টিফিকেশন প্রথা চালু করার কথা হয়েছিল। সেটাই কি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত মনে করেন?
মনে করতাম যদি সেটা সার্টিফিকেশন বলতে যা বোঝায় তা করা হতো। তাঁরা যে সার্টিফিকেশন অ্যাক্টটা পাস করছেন, সেটা আগের সেন্সর নীতিমালা বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি নিয়ন্ত্রণবাদী ও কঠোর। ফলে এটায় শিল্পীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কোনো সুযোগ নাই। আমরা শিল্পী-নির্মাতারা এক হয়ে আইনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জানিয়েছি, যে নীতিমালাটা তাঁরা পাস করছেন, সেটা ক্রিয়েটিভ অ্যাটমসফেয়ারের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

কেমন ক্ষতিকর?
যেমন, তারা কিছু অস্পষ্ট ধারা রেখেছে। আমরা জানি অস্পষ্ট ধারা হচ্ছে অত্যাচারের হাতিয়ার। এই অস্পষ্ট ধারাগুলো ডিফাইন করতে হবে যে কী করলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, কী করলে ধর্মীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এসব পরিষ্কার করে দিতে হবে। তাহলে আমরা জানব কী করতে পারব, কী পারব না।

শুটিংয়ের আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হয়েছিল এবং সেখানকার লোকজন স্ক্রিপ্ট পড়ে প্রশংসা করেছেন, শুটিংয়ের জন্য বিদেশি শিল্পী-কুশলীদের বাংলাদেশে আসার অনুমতিও দিয়েছেন। এখন এই মত পরিবর্তনে কারও ব্যক্তিগত ইন্ধন আছে মনে করেন?
থাকতে পারে। আমি মনে করি, সরকারের এ বিষয়ে তদন্ত করা উচিত যে কারা বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের কাছে এমন একটা রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে চায়, যে রাষ্ট্রে শিল্পীর স্বাধীনতা নাই। 
 
সেন্সর বোর্ড কি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি?
আমি সেন্সর বোর্ড নিয়ে জানি না। আমি মনে করি, আমার সিনেমাটি নিয়ে বারবার বিধিবহির্ভূত কাজ হয়েছে। তাই এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত এবং তদন্তে যাঁরা দায়ী সাব্যস্ত হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

সিনেমাটি এরই মধ্যে কয়েকটি দেশে প্রদর্শিত হয়েছে। সেখানকার দর্শক বা কুশলীদের কাছে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?
কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমি পাই নাই। বহু কাগজে রিভিউ ছাপা হয়েছে, কেউ তো বিরূপ কিছু বলে নাই! এমনকি বাংলাদেশের বহু মানুষ টরন্টোর ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি দেখেছেন। তাঁরা পরে এসে পত্রিকায়, ফেসবুকে লিখেছেন। কেউ তো বিরূপ কিছু লেখেন নাই!

আলটিমেটাম দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির ২ তারিখের মধ্যে শনিবার বিকেল বাংলাদেশের মানুষের সামনে হাজির করতে দিতে হবে। যদি সেটা না হয়, পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে?
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ২১ জানুয়ারি সিনেমাটির ছাড়পত্র দেওয়া হবে এবং এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে প্রশ্নের মুখে পড়েছে, তা থেকে মুক্ত করবে। এর অন্যথা হলে কী করব সে বিষয়ে আমরা ফিল্মমেকাররা বৈঠক করেছি, আমাদের কর্মপন্থা স্থির করেছি। আমরা জানি আমরা কী করব। এবং সেই কাজটার মাধ্যমে ২ ফেব্রুয়ারির আগেই বাংলাদেশের মানুষ শনিবার বিকেল দেখতে পাবেন। শুধু সিনেমা দেখবেন তা না, যাঁরা যাঁরা এর পেছনে ষড়যন্ত্র করেছেন, তাঁদের মুখোশ আমরা উন্মোচন করব।  

এই সিদ্ধান্ত কবে জানা যাবে?
২১ তারিখ বিকেলের মধ্যেই। 

দেশের হলে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া না গেলে কি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন?
এখনই এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।

এ দেশে শিল্পচর্চায় বাধা নতুন নয়। ‘হাওয়া’ আর ‘শনিবার বিকেল’ তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। এমন অবস্থায় দেশের শিল্পচর্চার ভবিষ্যৎ কী?
শিল্পচর্চায় কোনো রকমের বাধাই থাকা উচিত নয়। সরকার বলছে যে তারা একটা আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে চায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চায়। কিন্তু আর্ট ও আর্টিস্ট বা ফিল্মের বিষয়টা যখন আসে, তখনই তথ্য মন্ত্রণালয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের ফসিলের মতো আচরণ করে। একটা ডিজিটাল রাষ্ট্রে আপনি যদি একটা ডিজিটাল সোসাইটি বানাতে চান, সেখানে একটা ফসিলের মতো সেন্সর বোর্ড, সেন্সর নীতিমালা থাকতে পারে না।

শেষ কথা কিছু বলবেন?
সরকারের ওপরের মহলে যাঁরা আছেন তাঁদের বলতে চাই, আপনাদের যারাই বোঝায়, আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, তা না হলে সরকারের সমালোচনা হবে, লক্ষ করেন, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে শিল্প রচনা করতে হয় না। মোবাইল ফোনেই কনটেন্ট বানিয়ে ইউটিউব, টিকটকে প্রকাশ করা যায়। চাইলেই সেই কনটেন্ট সরানো যায় না যদি সেটা দেশের বাইরে থেকে আপ করা হয়। তাহলে সমালোচনা রুখতে এই মান্ধাতা আমলের নিয়ম রাখার কী দরকার? কাজেই এই বিষয়ে সরকারের ভাবার সময় এসেছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত