সাদা সোনায় কালো থাবা

আনোয়ার সাদাৎ ইমরান, মধুপুর
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২২, ০৬: ২২
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২২, ১৯: ৫০

মধুপুরের সাদা সোনাখ্যাত রাবারশিল্পে কালো থাবা পড়ায় প্রকল্পটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। ঠিকাদার-টেপার দ্বন্দ্ব, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও রাবার পাচারের ফলে প্রতিমাসেই কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে সরকারকে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে মধুপুর গড় অঞ্চলের বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের দ্বিতীয় রাবার উন্নয়ন প্রকল্পে।

জানা গেছে, দেশের অন্যান্য রাবার বাগানে সিস্টেম লস ১৫ শতাংশ থাকলেও মধুপুরে ৪০ শতাংশের বেশি। গাছের হিসাবেও রয়েছে গরমিল। ১৯৯০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রতি একরে রাবারগাছ ১৯০টি দেখালেও ১৯৯৮ সালে দেখানো হয়েছে ২২০-৩২০টি। ২০১০ সালে পীরগাছা রাবার বাগানে উৎপাদনশীল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৪টিসহ ৩ লাখ ৮০ হাজার ২৭৬টি গাছ ছিল। গত কয়েক বছরে নতুন করে হাজার হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। বর্তমানে এসব গাছের সংখ্যা ৩ লাখের নিচে।

পীরগাছা রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক কে এম মাহবুব আলমের দেওয়া তথ্যমতে উৎপাদনশীল গাছের সংখ্যা ১ লাখ ৪৪ হাজার এবং অনুৎপাদনশীল গাছের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার। কিন্তু ঠিকাদার, টেপার, সুপারভাইজারদের দেওয়া তথ্যমতে বাগানে রাবারের কষ আহরণ করা হচ্ছে মাত্র ৮০ হাজার গাছ থেকে।

অভিযোগ উঠেছে, বাগানের ব্যবস্থাপক মাহবুব আলম ও ঠিকাদারেরা মিলে লাভজনক এই বাগানকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। বছরের পাঁচ মাস জে এন্টারপ্রাইজ রাবার কষ সংগ্রহ বন্ধ রাখলেও তিনি নিশ্চিন্তে সময় কাটাচ্ছেন সুবিধা নিয়ে। তাঁরা মিলেমিশে বাগানের পতিত জমি লিজ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

রাবার কষ সংগ্রহ করে কোয়াগুলেশন ট্যাংকে জমাট বাঁধার পর রোলিং করে শুকিয়ে ধূমায়িত করার পর এটি বিক্রয় উপযোগী হয়। এর জন্য ৪ শতাধিক টেপার এবং ২৬ জন কারখানা ও ১২ জন ধূমঘরের শ্রমিকসহ ৭৩ জন ব্যক্তি সারা বছর এ কাজে যুক্ত থাকেন। নিয়মিত এসব কাজের জন্য শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস, পোশাক ভাতাসহ কিছু টাকা পেয়ে থাকেন। কিন্তু ঠিকাদারেরা কৌশলে শুধু নিজেদের লাভের জন্য অফ পিক টাইমের ৫ মাস কষ আহরণ বন্ধ রেখে শ্রমিক ও সংস্থা উভয়কে ঠকাচ্ছেন।

আর অফ পিকে শ্রমিক মজুরি, ভ্যাট, ট্যাক্স দেওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই তাঁরা ওই সময়ে কষ আহরণ বন্ধ রাখেন। তাঁদের এই এক থেকে দুই টাকা রক্ষা করতে গিয়ে প্রতি কেজি শুকনো রাবারের মূল্য ১৫০ টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বশিউক)। চলতি বছরের শুধু মে মাসের হিসাবেই ১ লাখ ৭২ হাজার কেজি কষ আহরণ এবং ৩ হাজার ৭৫০ কেজি জমাটবদ্ধ কষ (টিএস) সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বশিউক। এর বাজারমূল্য হিসেবে শুধু মে মাসেই পীরগাছা রাবার বাগানে ক্ষতি হয়েছে ৯৫ লাখ টাকার বেশি। টানা তিন মাস ধরে এই ক্ষতি চলমান। শুধু তা-ই নয়, গত দুই বছরের হিসাবে প্রায় ১২ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বশিউক।

এদিকে রাবার উৎপাদন কমে যাওয়ায় বশিউকের মহাব্যবস্থাপক, পীরগাছা রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক ও ১৬ জন টেপিং সুপারভাইজারকে ৭৫ শতাংশ টেপারের উপস্থিতি নিশ্চিত এবং জনপ্রতি অন্তত ১০ কেজি কষ সংগ্রহের জন্য বাধ্যবাধকতার আদেশ জারি করা হয় গত ১৬ জুন। এই পত্র পাওয়ার পর বাগানের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, ৫ মাস কষ সংগ্রহ বন্ধ রেখে ঠিকাদার কোটি টাকার ক্ষতি করছেন।

কষ সংগ্রহকারী টেপারদের নেতা ছানোয়ার হোসেন সানু বলেন, জে এন্টারপ্রাইজ টেপারদের পোশাক ভাতা, উৎপাদন ভাতা, পিকনিক ও ঈদ বোনাস দিচ্ছে না, দুর্ব্যবহার করছে। ফলে ৪০০ টেপারের মধ্যে ৪০ জনও কাজে আসে না। এ ছাড়া রাবার বাগানের পতিত জমি বিভিন্নজনের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জামাল উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, টেপাররা চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে কাজ বন্ধ রেখেছেন। বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ জন টেপার কাজ করছেন।

রাবার শ্রমিকদের একাধিক নেতা জানান, টেপাররা রাবার চুরির সঙ্গে জড়িত নন, বরং ঠিকাদার ও বাগান ব্যবস্থাপক মিলে প্রায় ৩৫ টন রাবার পাচার করেছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। অফ পিক টাইমে ঠিকাদার ও টেপার কেউ বাগানে আসেন না। বাড়তি উপার্জনের জন্য তাঁরা অন্যত্র কাজ করেন।

তবে পীরগাছার রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক কে এম মাহবুব আলম বলেন, বর্তমানে পীরগাছা রাবার বাগানে ১ লাখ ৪৪ হাজার গাছ উৎপাদনশীল অবস্থায় রয়েছে। আগে টেপাররা কষে পানি মেশাতেন, বর্তমানে মেশাতে পারেন না ঠিকাদারের কারণে। তবে তিন মাস ধরে উৎপাদন প্রায় বন্ধ রয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত