১৯৫২ সালে মায়ের ভাষা, মুখের ভাষার মর্যাদার দাবিতে, রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে যে দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের শোকে পুরো জাতি তেজোদীপ্ত হয়েছে। সেই শোক শক্তিতে পরিণত হওয়ায় বিশ্বের বুকে বাংলা আজ প্রতিষ্ঠিত। ২১ ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। গতকাল সোমবার দিবস পালনে নগরবাসীর মধ্যে একদিকে যেমন ছিল শোক, গৌরব। অন্যদিকে তেমনি ছিল উৎসবের আমেজ।

কারও মুখে শহীদ মিনারের আলপনা, কপালে একুশে ফেব্রুয়ারির ব্যাজ। মেয়েদের মাথায় ফুলের রিং। আর বাচ্চাদের হাতে কাগজের পতাকা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এমনটাই ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদে ছিল ভাষাশহীদদের স্মরণ। মাথা উঁচু করে তাঁরা জানান দেন মাতৃভাষা বাংলার জয়গান। কবি আল মাহমুদ যেমন বলেছেন, ‘প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী, আমায় নেবে সঙ্গে, বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) বিভিন্ন এলাকায় মাইকে বাজানো হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’—এ গান। ঢাবির টিএসসি এলাকায় দুই সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে আসেন কামাল উদ্দিন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ছুটির অভাবে তাঁর ছেলে সাইফ ও মেয়ে মিমকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। তাই ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটিতে বেড়াতে আসেন। কামাল উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছেলে ও মেয়ের আবদারে শহীদ মিনার ও বইমেলা দেখাতে নিয়ে এসেছি, টিএসসিতে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়েছি।’

বর্ণমালা আঁকা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে দুই বোনকে নিয়ে শাহবাগে এসেছেন শাহরিয়ার সুমন। তিনি বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি শোকের দিন। এই দিনে ১৯৫২ সালে আমরা ভাষাশহীদদের হারিয়েছি। তাই আজকে ভাষাশহীদদের ত্যাগের কথা উপলব্ধি করার দিন।’

এদিকে একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে রিকশাভাড়া, একুশের ব্যাজ ও সাজের উপকরণের মূল্য বেড়েছে। দাম বেড়েছে ফুলেরও। প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাবি এলাকায় ফুল বিক্রি করেন পারভিন বেগম। তিনি জানান, ফেব্রুয়ারিতে তুলনামূলক বেশি ফুল বিক্রি হয়।

এদিন বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল ও লালবাগ কেল্লায় অন্য সময়ের তুলনায় দর্শনার্থী বেড়েছে। মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দর্শনার্থীর চাপ ছিল। উত্তরার দিয়াবাড়ি ও ৩০০ ফুট এলাকায়ও মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। বিকেলে ভিড় বাড়ে হাতিরঝিল ও সংসদ ভবন এলাকায়।

সার্বিক বিষয়ে বাংলা একাডেমির সভাপতি ও প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ভাষাশহীদেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই শুধু উৎসব করলে হবে না, একুশের চেতনাকে উপলব্ধি করতে হবে। এটা বাঙালি জাতির অস্তিত্বের অংশ। যারা আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে, সেই তরুণদের অবশ্যই একুশের চেতনাকে ধারণ করতে হবে।’