ড. মইনুল ইসলাম
দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়েকটি বড় সংকটে রয়েছে সেগুলো হলো: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা, ডলার-সংকটের কারণে আমদানির এলসি খুলতে জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ১১৮ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশি টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ৪৭ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডিপদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচার সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি পরিস্থিতি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া। আরেকটু বিস্তৃতভাবে কয়েকটি সংকটের বর্তমান ভয়াবহতা দেখুন:
১. আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ বিলিয়ন ডলারে এবং নিট রিজার্ভ (ব্যয়যোগ্য) ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ ২০২১ সালের আগস্টে সরকারের দাবি অনুযায়ী, গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। (আইএমএফ সরকারের এই দাবি মানেনি)। দৈনিক বণিক বার্তা গত ১৯ মে হেডলাইন করেছে যে দুই বছরে আমদানি ব্যয় ৪০ বিলিয়ন ডলার কমিয়েও রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি।
২. ২০২১ সালের আগস্টে দেশে ১ ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। দুই বছরে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসারে দাঁড়িয়েছে ১১৮ টাকায়। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ৪৭ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। টাকার এহেন অবচয়নের কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ডলারের অঙ্কে গত বছরের ২ হাজার ৭৬৫ ডলার থেকে সামান্য বেড়ে ২ হাজার ৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে, অথচ টাকার অঙ্কে মাথাপিছু জিএনআই বেড়েছে ১২ শতাংশ।
৩. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। অবশ্য, এটা আশাপ্রদ যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স ২৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।
৪. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকেরা এলসি খুলতে গিয়ে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১২৫ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশের মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতির শামিল।
৫. আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এ চারটি প্রধান অর্থ পাচার-প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে।
৬. আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯ দশমিক ৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি। ভারত ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে সফল হলেও আমাদের ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে ন্যক্কারজনক।
ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো বর্তমান শাসক মহলের ভুলের কারণেই সৃষ্ট; বিশেষ করে সাবেক অর্থমন্ত্রীর অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে বেশির ভাগ সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। অবশ্য আমাদের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে প্রধানমন্ত্রী ও জনাকয়েক ধনকুবের ব্যবসায়ীর ‘অলিগার্কি’ অভিহিত করলেও ভুল হবে না। উল্লিখিত সমস্যা সমাধানের অযোগ্য কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সমস্যাগুলো অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। বিগত দিনে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা-প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল, সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল-নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে এবং ২০২৪ সালের জুন মাসে ২ হাজার ৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে।
এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, তার পরিবর্তে অর্থনীতিতে সংকট জটিল আকার ধারণ করা অস্বাভাবিক হলেও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জো নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক প্রক্ষেপণ ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্কিং অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
অর্থনীতি বিপদে পড়ার আরেকটি বড় কারণ একের পর এক মেগা প্রজেক্ট গ্রহণের খামখেয়ালি বাতিক ও হিড়িক। বাংলাদেশে এক দশকে অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্প প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় বলা চলে। ভালো ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়াই এসব প্রকল্প গৃহীত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাজেটের আরেকটি বিষয়কে গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করতেই হবে সেটা হলো—ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের কাছাকাছি এসে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সংকুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা বাড়ছে। প্রত্যক্ষ করের অবদান কর-রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। এর মানে, দেশে করের মূল বোঝা বহন করে চলেছে সাধারণ জনগণ।
সবশেষে বর্তমান মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটের কথা বলতেই হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের গণতন্ত্র পুরোপুরি লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। ওই নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট জবরদখলের মোটেও প্রয়োজন ছিল না, মহাজোট এমনিতেই সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে আসত। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব জনগণের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে পারেননি। বিএনপিও বিলেতে পলাতক তারেক রহমানের নির্দেশে চাণক্য-চাল চালছে প্রতিটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। এ দেশে অদূর ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আসবে না। দেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য বড় সংকট। গণতন্ত্রের এই সংকট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে বড় বাধা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়েকটি বড় সংকটে রয়েছে সেগুলো হলো: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপজ্জনক পতনের ধারা, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বেলাগাম মূল্যস্ফীতির প্রকোপ, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসা হুন্ডি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা, ডলার-সংকটের কারণে আমদানির এলসি খুলতে জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হু হু করে ডলারের দাম বেড়ে ২০২১ সালের ৮৭ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ১১৮ টাকায় উল্লম্ফন, বাংলাদেশি টাকার বৈদেশিক মানের প্রায় ৪৭ শতাংশ অবচয়ন, আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং ও রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ব্যাপক পুঁজি পাচার, হুন্ডিপদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণ পাচার, খেলাপি ব্যাংকঋণ সমস্যার বিপজ্জনক অবনতি, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে সেগুলো দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ক্রয়, দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচার সম্পর্কে সরকারের অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা, দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি পরিস্থিতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি পরিস্থিতি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া। আরেকটু বিস্তৃতভাবে কয়েকটি সংকটের বর্তমান ভয়াবহতা দেখুন:
১. আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ বিলিয়ন ডলারে এবং নিট রিজার্ভ (ব্যয়যোগ্য) ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ ২০২১ সালের আগস্টে সরকারের দাবি অনুযায়ী, গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। (আইএমএফ সরকারের এই দাবি মানেনি)। দৈনিক বণিক বার্তা গত ১৯ মে হেডলাইন করেছে যে দুই বছরে আমদানি ব্যয় ৪০ বিলিয়ন ডলার কমিয়েও রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি।
২. ২০২১ সালের আগস্টে দেশে ১ ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। দুই বছরে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসারে দাঁড়িয়েছে ১১৮ টাকায়। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান কমপক্ষে ৪৭ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। টাকার এহেন অবচয়নের কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ডলারের অঙ্কে গত বছরের ২ হাজার ৭৬৫ ডলার থেকে সামান্য বেড়ে ২ হাজার ৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে, অথচ টাকার অঙ্কে মাথাপিছু জিএনআই বেড়েছে ১২ শতাংশ।
৩. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। অবশ্য, এটা আশাপ্রদ যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স ২৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।
৪. কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানিকারকেরা এলসি খুলতে গিয়ে এখনো হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক আমদানিকারক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ১২৫ টাকায় ডলার কিনে এলসি খুলছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশের মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতির শামিল।
৫. আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এ চারটি প্রধান অর্থ পাচার-প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের অবস্থান। তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে।
৬. আমাদের মূল্যস্ফীতির হার সরকারের দাবি মোতাবেকই এখনো ৯ দশমিক ৬ শতাংশে রয়ে গেছে! সাধারণ ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেবে যে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির হার আরও অনেক বেশি। ভারত ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে সফল হলেও আমাদের ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে ন্যক্কারজনক।
ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো বর্তমান শাসক মহলের ভুলের কারণেই সৃষ্ট; বিশেষ করে সাবেক অর্থমন্ত্রীর অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে বেশির ভাগ সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। অবশ্য আমাদের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে প্রধানমন্ত্রী ও জনাকয়েক ধনকুবের ব্যবসায়ীর ‘অলিগার্কি’ অভিহিত করলেও ভুল হবে না। উল্লিখিত সমস্যা সমাধানের অযোগ্য কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সমস্যাগুলো অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। বিগত দিনে সরকার খেলাপি ব্যাংকঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা-প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে চলেছিল, সেখান থেকে অবিলম্বে সরে আসতে হবে।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল-নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে এবং ২০২৪ সালের জুন মাসে ২ হাজার ৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে।
এহেন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, তার পরিবর্তে অর্থনীতিতে সংকট জটিল আকার ধারণ করা অস্বাভাবিক হলেও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জো নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক প্রক্ষেপণ ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্কিং অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।
অর্থনীতি বিপদে পড়ার আরেকটি বড় কারণ একের পর এক মেগা প্রজেক্ট গ্রহণের খামখেয়ালি বাতিক ও হিড়িক। বাংলাদেশে এক দশকে অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে, যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্প প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় বলা চলে। ভালো ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়াই এসব প্রকল্প গৃহীত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাজেটের আরেকটি বিষয়কে গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করতেই হবে সেটা হলো—ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের কাছাকাছি এসে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সংকুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা বাড়ছে। প্রত্যক্ষ করের অবদান কর-রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। এর মানে, দেশে করের মূল বোঝা বহন করে চলেছে সাধারণ জনগণ।
সবশেষে বর্তমান মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটের কথা বলতেই হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের গণতন্ত্র পুরোপুরি লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। ওই নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট জবরদখলের মোটেও প্রয়োজন ছিল না, মহাজোট এমনিতেই সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে আসত। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব জনগণের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে পারেননি। বিএনপিও বিলেতে পলাতক তারেক রহমানের নির্দেশে চাণক্য-চাল চালছে প্রতিটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। এ দেশে অদূর ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আসবে না। দেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য বড় সংকট। গণতন্ত্রের এই সংকট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে বড় বাধা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে