Ajker Patrika

সাহসী ও একত্র হওয়ার আহ্বান

তাপস মজুমদার
সাহসী ও একত্র হওয়ার আহ্বান

রবীন্দ্র কবিতার মূল সুর, যাঁরা তাঁর কাব্য পড়েছেন, তাঁরা হয়তো অনেকেই ধরতে পারেন। প্রকৃতি, প্রেম, আন্তর্জাতিকতা আর প্রধানত মানুষ এবং জীবনজিজ্ঞাসা সেখানে ভীষণভাবে প্রশ্রয় পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধান করা হয়তো বোকামি। সঞ্চয়িতা প্রকাশের সময় তিনি পরোক্ষভাবে বলেছেন, তাঁর সব কবিতাকে তিনি কবিতা বলে স্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁর অজস্র কবিতা যে কবিতা হয়ে উঠেছে এবং বাংলা সাহিত্যের সভায় যে তা মহামূল্যবান, তিনি নিজে না বললেও বিদ্বজ্জনের কাছে সে কথা আজ অবধি অনিবার্যভাবে স্বীকৃতি লাভ করে আসছে। তাঁরই একটি কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’। চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। আমার দৃষ্টিতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতাটি রাজশাহীতে লেখা। ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানোর তাগিদ।

‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতাটি শুরু হয়েছে এ রকম বক্তব্য নিয়ে—সংসারে অন্য সবাই যখন সারাক্ষণ তাদের নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, তখন ‘তুই’ পলাতক বালকের মতো, মাঝদুপুরে মাঠের মাঝে, তরুর বিষণ্ন ছায়ায়, ক্লান্ত উত্তপ্ত বাতাসে, যে বাতাস আবার দূরের বনের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসছে—সারা দিন বাঁশি বাজিয়ে কাটিয়ে দিলি! কেন, তুই কি কোনো আর্তনাদ শুনতে পাস না! দূরে কোথাও আগুন জ্বলছে, তুই কি তা দেখতে পাস না! অন্ধত্বের মধ্যে মা অথবা মাতৃভূমি আটকে পড়েছে বুঝতে পারিস না! অক্ষমের বুক থেকে রক্ত শুষে নিচ্ছে সক্ষমেরা, তুই কি তা অনুভব করতে পারিস না! হীন স্বার্থের কাছে অসহায়ের বেদনা যে পরিহাসে পরিণত হচ্ছে, দুর্বল দীন মানুষগুলো যে ভয়ে সংকুচিত হয়ে লুকিয়ে পড়ছে, সে ঘটনা কি লক্ষ করতে পারিস না!

অতঃপর আহ্বান—তুই উঠে পড়! শোন কোন মহা আহ্বানধ্বনি তোকে উচ্চকণ্ঠে ডেকে চলেছে জনতাকে জাগানোর জন্য। যার উদ্দেশ্যে বলা সেই জনই প্রকৃতপক্ষে অন্তরের গভীর থেকে এই ডাক শুনতে পাচ্ছে।

এর পরবর্তী অংশে রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র ও অসহায় মানুষের একটি চিত্র এঁকেছেন: শত শতাব্দীর অত্যাচার, নিপীড়ন, অনাহার, আর অসহায়ত্ব নিয়ে করুণ-মূর্তি মানুষগুলো কেমন বোবা ও বোকা হয়ে আছে। তারা কোনো প্রতিবাদ করতে জানে না (হয়তো বলার মতো উপযুক্ত জায়গাও তাদের নেই)। সৃষ্টিকর্তা বা মানুষকে দোষও দেয় না। জীবনটাকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখে। এই দারিদ্র্য ও অসহায়ত্ব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে। এমন অবস্থায় কেউ যদি তার মুখের সামান্য অন্নটুকুও কেড়ে নেয়, তবু তারা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দিয়ে তাঁর ওপরেই ভার ছেড়ে দেয়।

এই সব বোবা, অবুঝ ও অসহায় মানুষের দল তো রয়েছেই চারদিকে। কিন্তু করণীয় কী?

খুব সহজ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তার জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা/এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা!’

কী করে দিতে হবে এই ভাষা, কী করে জাগিয়ে তুলতে হবে এই আশা! এ জায়গাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং খুব পরিষ্কার; যেকোনো সমস্যার সমাধানে মানুষের একত্র হওয়া অত্যাবশ্যক। আমাদের সমস্যাগুলো সমস্যাই থেকে যায়, যদি আমরা পরস্পরের মধ্যে আন্তযোগাযোগ প্রসারিত না করি। বিচ্ছিন্নতা কখনো সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখে না। একত্র হওয়ার শক্তিই প্রখর। অপ্রতিরোধ্য। আমরা তখনই পরাজিত হই, যখন সম্মিলিত শক্তির ক্ষমতাকে অস্বীকার করি এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।

কবির ভাষায়: 
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে/ যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে/ যখনই জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে।’

কবি জানাচ্ছেন, অশুভ শক্তি তার হীনতা জানে বলেই মানুষ যখন একত্র হয় এবং সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ায়, তখন সে পথের কুকুরের মতো ভয় পেয়ে পালায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঠিক এ বিষয়টিই আমরা লক্ষ করেছি। আপাতদৃষ্টিতে তাদের, অর্থাৎ পাকিস্তানিদের শক্তির প্রচণ্ডতা প্রকাণ্ড মনে হলেও বাঙালির সম্মিলিত শক্তির কাছে পাকিস্তানি অপশক্তি পরাভূত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’ কথাটি সফল করে তুলেছিল গ্রামের কোটি মানুষ। রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় যে আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘যদি থাকে প্রাণ/তবে তাই লহ সাথে, তবে তাই করো আজি দান’ এই ধ্বনির প্রতিফলনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঘটে গিয়েছিল। একতার শক্তির আর কিছুর আবশ্যক নেই। শুধু দেহে প্রাণ থাকলেই চলবে।

পরেই আছে—
‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু/ সাহসবিস্তৃত বক্ষপট।’

কবিতার এই পঙ্‌ক্তিতেই কবি সম্পূর্ণ জীবনের কথা বলে দিয়েছেন। মানুষের সম্পূর্ণতা অর্জনে যেমন খাদ্য চাই, তেমনি একইভাবে চাই আলো-বাতাস-বল-আয়ু-আনন্দ। আর চাই সাহসী বুকের পাটা। সাহস ছাড়া কোনো কাজই করা সম্ভব নয়।

রবীন্দ্রনাথ সংসারসীমা ছাড়িয়ে দূরে চলে যাওয়াকে প্রশ্রয় দেন না। কল্পনাবিলাস বর্জন করে নিত্যদিনের বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলাই তাঁর চাওয়া। কল্পনার কুঞ্জ থেকে কর্মচঞ্চল মানুষের কাছে ফিরতে হবে। সেখানে বাধা আছে, ঝড় আছে, নিরন্তর দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে, আছে মায়া। এসবকে অতিক্রম করে, আপনার নিজের সুখ, নিজের দুঃখকে মিথ্যা জ্ঞান করে চলতে পারলে সত্যিকারের বাঁচা হয় বলে তিনি জানান। কবিতার ভাষায়, ‘এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে/ হে কল্পনে, রঙ্গময়ী! দুলায়ো না সমীরে সমীরে/ তরঙ্গে তরঙ্গে আর, ভুলায়োনা মোহিনী মায়ায়।...স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে/ সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।’ বৃহৎ জগতের বৃহৎ মানুষ হয়ে উঠতে হলে মানুষের নিজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে যেতে হয়। এই অনিবার্যতার কথাই এখানে ধ্বনিত হয়েছে।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতবর্ষের মুক্তির প্রতীকী বার্তাও এখানে আমরা পেয়ে যাই। পাশাপাশি জনগণের কল্যাণের বার্তাও।

আদর্শ হারিয়ে যাচ্ছে। অস্থিরতা প্রতিক্ষণে অনিবার্য হয়ে উঠছে। প্রাণচঞ্চলতা অপসৃত হতে চলেছে। কেন এমন হবে! জীবন তো চলমান! সেখানে আনন্দ চাই। মুক্ত বায়ু চাই। কলহ নয়, নেতিবাচকতা নয়, জগদ্দল অচলায়তনকে ভেঙে ফেলে সামনে চলা প্রয়োজন। নতুন পথের সন্ধান করা প্রয়োজন। পরাধীনতা বা নৈরাজ্য নয়, সতর্কতার সঙ্গে ইতিবাচকতার চর্চা করা প্রয়োজন।

এই কবিতায় কবি সত্য ও সুন্দরকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ব মানবতার বাণী শুনিয়েছেন। বাস্তবধর্মিতাকে আলিঙ্গন করতে বলেছেন। চেয়েছেন আমাদের জীবন চলা ছন্দময় হোক। জ্ঞানের পরিচর্যা প্রধান হয়ে উঠুক। গানহীন, প্রাণহীন, ছন্দহীন জীবন কোনো জীবন নয়।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি কর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। এ দেশে কর্মঠ মানুষ আছে, কর্মহীন বা বেকার মানুষও আছে। পাশাপাশি স্বার্থপর, কর্মবিমুখ এমনকি জনস্বার্থপরিপন্থী মানুষেরও অভাব নেই। আপন স্বার্থকে ক্ষুদ্র করে দেখে সৎ সাহস নিয়ে বৃহৎ পরিসরের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কবির এই আহ্বান অনুধাবন করা আজ বিশেষ প্রয়োজন। আর সেই অনুধাবনকে কার্যে রূপ দিতে পারলে তা দেশ তথা বিশ্বকে ভীষণভাবে বদলে দিতে পারে।

কোনো মহৎ শিল্প কালের ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে থাকে না। এ কবিতাটিও তাই সর্বকালের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত