মেগার ম্যাজিক ও পদ্মা সেতু

এম এম আকাশ
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২২, ০৭: ১১
আপডেট : ২৩ জুন ২০২২, ১৮: ৩৬

পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু ১০ হাজার কোটি টাকা খরচের প্রাথমিক বাজেট শেষ পর্যন্ত তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পদ্মার ব্যতিক্রমী গভীরতা, রেললাইনের অতিরিক্ত প্রকল্প যোগ করা এবং অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের জন্য প্রাথমিক বাজেটের তিন গুণের বেশি ব্যয় হয়েছে। হয়তো সময় বেশি লাগার জন্য সব উপকরণের দামও বেশি লেগেছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, সব মেগা প্রকল্পেই এই সাধারণ সমস্যাটি রয়েছে। চলতি বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মেগা প্রকল্পের এ ধরনের ত্রুটির কথা নিজেই স্বীকার করেছেন।

ব্যয়বৃদ্ধি সেতুর দুই পাশের রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে অস্বাভাবিক হারে হওয়ার কারণে, এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও আনা হয়েছে। বিরোধী দলের একজন সংসদ সদস্য তা সংসদে তুলনামূলক পরিসংখ্যান দিয়ে উত্থাপনও করেছেন। এ কারণে এই প্রকল্প থেকে উচ্চ রিটার্ন বা ফল না পেলে পরে এই প্রকল্প লোকসানি প্রকল্পে পরিণত হতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

আবার সেতু পারাপারের ভাড়া বেশি বাড়িয়ে প্রকল্পকে লাভবান করতে গেলে আর্থিক লাভ নিশ্চিত হলেও অনেক গরিব লোকের পক্ষেই তখন এই সেতুর সেবা গ্রহণ সম্ভব নাও হতে পারে। এই কূটাভাষের কারণে বর্তমানে পদ্মা সেতু নিয়ে বাজারে যেমন প্রচুর উচ্ছ্বাস আছে, তেমনি নানা নেতিবাচক কথার চালাচালিও আছে। আমাদের দেশের মানুষ কোনো বিষয়েই অতিরিক্ত জাঁকজমক পছন্দ করেন না, বিশেষত দেশে যখন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছে, তখন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে যে উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে, তাতে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ নিয়েও অনেককে তির্যক মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে। সবকিছু নিয়েই আমাদের জাতি যেমন বিভক্ত হয়ে যায়, পদ্মা সেতু নিয়েও তা-ই হচ্ছে!

কিন্তু এতসব পাল্টাপাল্টি বিতর্কের পরও আমি বলব, পদ্মা সেতু আমাদের একটি জাতীয় সাফল্যের প্রতীক। আমরা যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর অভিজ্ঞতা থেকে জানি, দুই দশকে এ সেতু থেকে টোল আদায়ের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। যদি পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে এই হার দেড় গুণ বেশি অর্থাৎ ১০ হাজার কোটি টাকা হয়, তাহলে পদ্মা সেতুর আয়ুষ্কালে (ধরা যাক ১০০ বছর, যেমনটি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে) মোট টোল আদায় হতে পারে ৫০ হাজার কোটি টাকা! এর সঙ্গে আমাদের যোগ করতে হবে নানা অপ্রত্যক্ষ উপকার। ২০১০ সালে যখন এই প্রকল্প প্রথম সরকারিভাবে গৃহীত হয়েছিল, তখন নানা ধরনের অপ্রত্যক্ষ উপকারের কথা পদ্মা সেতুর কস্ট-বেনিফিট বিশ্লেষকেরা প্রাক্কলন করেছিলেন। প্রথমত দক্ষিণের ২১টি জেলা থেকে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব জেলাগুলোর সংযোগ স্থাপন সহজ এবং দ্রুত অভিগম্যতার একটা বিশেষ মূল্যায়ন করা হয়। দ্বিতীয়ত, সেতুর দুই পাশেই নানা অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, বিশেষত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বর্ধিত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাব্য মূল্য নির্ণয় করা হয়, তৃতীয়ত এসবের ফলে বর্ধিত হারে প্রবৃদ্ধি, কর্ম-নিয়োজন এবং দারিদ্র্য হ্রাসের হিসাবও তাঁরা প্রাক্কলন করেছিলেন। সর্বোপরি আমাদের দেশে এখন যে আঞ্চলিক বৈষম্য বিরাজমান, এই প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি ফল হিসেবে তা কমে আসবে। এগুলো সাধারণ জ্ঞান দিয়ে গ্রহণ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা পরিমাপ করা সম্ভব। তবে পরিমাপগুলো সবই হচ্ছে অনেক টেকনিক্যাল ও আনুমানিক হিসাব। তাতে অবশ্যই দেখা যায় যে নিশ্চিতভাবেই এটি একটি লাভজনক প্রকল্প হতে পারে।

এসব বিষয় পর্যালোচনা করে অনেক নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ, যেমন জামিলুর রেজা চৌধুরীও তেমন মতই দিয়েছিলেন। সুতরাং সামগ্রিক বিচারে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে তা লোকসানি প্রকল্প হওয়ার হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ আসলেই এর অনেক উচ্চ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইতিবাচক ফল আছে এবং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ফলপ্রসূ জাতীয় প্রকল্প বলে ধরা যেতে পারে। সুতরাং একটি যুক্তিযুক্ত টোল নির্ধারণ করে ব্যাপক মানুষের তা ব্যবহারের সুযোগ দিলে এই প্রকল্পের খরচ সহজেই উঠে আসবে। তাই ইতিহাস টেনে এনে এই প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক বাদানুবাদ সৃষ্টি করা সম্ভবত ঠিক হবে না।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু সম্পর্কে সবশেষ খবর পেতে - এখানে ক্লিক করুন 

বরং এটি বিদেশি গোষ্ঠীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশি প্রচেষ্টায় সরকারি সম্পদ দ্বারা (ঋণ ও জনগণের প্রদেয় কর) সম্পন্ন হয়েছে। আর সরকার দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে এই প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। সেই কারণে এটি শুধু আওয়ামী লীগের বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৌরব নয়, আমাদের জাতীয় গৌরবও বটে। সেভাবে সবাই এটা দেখলেই ভালো হতো এবং ভুলত্রুটি বা ঐতিহাসিক ভ্রান্তিগুলো নিয়ে বাদানুবাদ কম হলে এই গৌরব আরও উজ্জ্বল ও প্রশ্নাতীত হতো।

পদ্মা সেতু সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত