বন্ধ শ্যামপুর সুগার মিল, বাঁধাগ্রস্ত হাজারো কৃষকের স্বপ্ন

শিপুল ইসলাম, রংপুর
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০: ১৮

রংপুর জেলার একমাত্র ভারী শিল্প শ্যামপুর সুগার মিল। একসময় এ মিলের আওতায় ১০ হাজারের বেশি কৃষক আখ চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু সাড়ে তিন বছর ধরে আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ। অন্য ফসল চাষে তাঁরা তেমন লাভের মুখ দেখছেন না।

কৃষকদের দাবি, দ্রুত চিনিকলটি চালু করলে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। এদিকে কর্মচারীরা বলছেন, মাসের পর মাস বেতন-ভাতা না পেয়ে তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রপাতি, ঝোপঝাড়ে পরিণত হচ্ছে চিনিকলটি। 

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন চৌধুরী কায়সার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খুব শিগগির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পেয়ে যাবেন ইনশা আল্লাহ। বন্ধ চিনিকলগুলোর মধ্যে তিনটি খুব দ্রুত চালু করার প্ল্যান (পরিকল্পনা) আছে। আমরা ম্যানপাওয়ার (জনবল), আখ সরবরাহসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে সরকারের সাপোর্ট (সহযোগিতা), অনুমোদন, টাকাপয়সা লাগবে। সরকারের অনুমোদন পেলে শ্যামপুর চিনিকল চালু করা হবে।’

কৃষক এবং শ্যামপুর সুগার মিলের কর্মী সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৪ সালের রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর এলাকায় প্রায় ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমিতে কারখানাটি গড়ে ওঠে।

এটি ১৯৬৭ সালের দিকে চিনি উৎপাদন শুরু করে। আখমাড়াইয়ের সক্ষমতা ছিল দৈনিক ১ হাজার ১৬ টন। বার্ষিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ১৬১ টন। ২০২০ সাল পর্যন্ত এখানে স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন ৭৪৪ জন। বর্তমানে আছেন ৬১ জন।

এ কলের আওতায় প্রায় ১০ হাজার চাষি আখ চাষ করতেন। ২২৬ কোটি টাকা লোকসানের মুখে ২০২০ সালের ডিসেম্বর কারখানাটিতে আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে আখ চাষ কমে যায়। চিনিকলটির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫ মাস ধরে বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন না।

সরেজমিনে দেখা যায়, সবুজ গাছপালায় ভরা কারখানাটিতে নিরিবিলি পরিবেশ। নেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোলাহল। প্রধান ফটকের পাশে গাছের ছায়ায় বসে আছেন দুজন নিরাপত্তাপ্রহরী। তাঁদের নিয়ে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, কারখানার সামনে রাখা আখ পরিবহনের ট্রাক্টর-ট্রলিগুলো ঝোপঝাড় আর লতাপাতায় ঢেকে গেছে। কারখানার টিন উড়ে গেছে, মরিচা ধরেছে ভেতরে পড়ে থাকা যন্ত্রপাতিতে। যত্রতত্র পড়ে আছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ। দূর থেকে পুরো কারখানাটি দেখলে যে কারও জঙ্গল মনে হবে।

শ্যামপুর গ্রামের ফজলুল হক আগে দেড় একরে আখ চাষ করলেও এখন এক একরেও করেন না। তিনি বলেন, ‘আখ আমাদের এখানকার অর্থকরী ফসল। আগে আখ চাষ করে বছর শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পেতাম। এখন তা আর পাচ্ছি না। এতে আমরা চাষিরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। শ্যামপুর সুগার মিল চালু হলে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য, খেটে খাওয়া মানুষ, জেলে-তাঁতি, কুমার—সবাই উপকৃত হবে। আমরা উন্নত জীবন পাব।’

আরেক আখচাষি জয়নাল হোসেন বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় মিলটি চালুর জন্য আন্দোলন-সমাবেশ করেছি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের প্রাণের চাওয়া—মিলটি চালু করে এই অঞ্চলের মানুষকে অর্থনৈতিক দৈন্য থেকে মুক্তি দেবেন।’

অন্তত ১৫ জন কৃষক ও স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানাটি বন্ধ থাকার কারণে এখানে যারা আছে, তারা রাতের আঁধারে দামি মালপত্র চুরি করে বিক্রি করছে। কিছু দামি মালপত্র আছে, সেগুলো নিজেদের পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছে। গাছপালা কেটে লুট করা হচ্ছে।

কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মচারী মাহমুদ বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে মিলটি বন্ধ। এর কারণে যন্ত্রপাতি পড়ে থেকে মরিচা ধরছে। সব যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার পথে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিলটি চালু করা হোক। এটি চালু হলে যন্ত্রপাতি ঠিক থাকবে, এলাকার উন্নয়ন হবে। আমরা বকেয়া বেতন-ভাতাসহ নিয়মিত ভাতা পাব, পরিবার নিয়ে বাঁচব।’ 

বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘চিনিকল বন্ধ হওয়ায় আমাদের শ্যামপুর অঞ্চলের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই অঞ্চলে কোটি কোটি টাকা মানুষের হাতে ঘুরত। আমরা শহরের মতো জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতাম, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন যাপন করছি। অন্য ফসল চাষ করে কোনোরকম সংসার খরচ চালাচ্ছি।

আগে আখ চাষ করে যে অর্থ পেতাম, এখন অন্য ফসলে সেই পরিমাণ অর্থ পাই না। লাভও থাকে না। ফলে জীবন-জীবিকার মান নিম্নমুখী থেকে যাচ্ছে। আমরা চাই শ্যামপুর চিনিকল পুনরায় চালু করা হোক, আমাদের অঞ্চলের কৃষক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটুক।’ 

শ্যামপুর আখচাষি কল্যাণ কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আখ চাষ না থাকায় আমরা অন্য ফসল চাষে তেমন লাভবান হচ্ছি না। আর চিনিকল যখন চালু ছিল, তখন চিনির দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। চিনিকল বন্ধ হওয়ার কারণে এখন ১৫০ টাকায় চিনি খাচ্ছি।’ 

জানতে চাইলে শ্যামপুর সুগার মিলের ইনচার্জ মাসুদ সাদিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আমরা অনেক আগে মিলটি চালুর দাবি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু মিল চালু করা হচ্ছে না। বেতন-ভাতাও নিয়মিত পাচ্ছি না। বর্তমানে আমরা মানবেতর জীবন যাপন করছি। তবে এখন প্রতি সপ্তাহে মন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগ করে চিনিকলের নানা তথ্য নিচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত