চলন্ত ট্রেনের কোচ হয়ে গেল ‘অস্ত্রোপচার’ কক্ষ

শাহীন রহমান, পাবনা 
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭: ২৯

তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ট্রেনটি ঢাকা থেকে নীলফামারীর চিলাহাটির পথে ছুটছে। হঠাৎ ট্রেনে থাকা অন্তঃসত্ত্বা এক নারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। রক্তপাত হচ্ছিল তাঁর। ট্রেনের লাউড স্পিকারে ঘোষণা দিয়ে চিকিৎসকের খোঁজ শুরু হয়। ছুটে আসেন একজন চিকিৎসক।

একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, দুজন নার্সও ছুটে এলেন। একজন নার্সিং ইনস্ট্রাক্টরসহ আরও কয়েকজন এগিয়ে আসেন। মুহূর্তে ট্রেনের তিন চেয়ারের একটি আসন ‘অস্ত্রোপচার’ কক্ষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ওই নারীর সন্তানকে বাঁচানো না গেলেও প্রাণে বেঁচেছেন তিনি। 
ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা থেকে চিলাহাটিগামী আন্তনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে গত রোববার রাতে। ট্রেনেই ওই নারীর মৃত বাচ্চা প্রসব করান চিকিৎসক ও নার্সরা।

ওই ট্রেনে দায়িত্ব পালনকারী পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টার্সের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ট্রেনটি ঢাকা থেকে চিলাহাটি যাচ্ছিল। বরাবরের মতো ট্রেনের পেছনের কোচ থেকে টিকিট চেকিং শুরু করেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন আরেক টিটিই বেলাল হোসেন। রাত ৮টার দিতে ট্রেনটি গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। টিকিট চেক করতে করতে ট্রেনের ‘জ’ নম্বর কোচে যাওয়ার পর হঠাৎ শাহিন আলম নামের এক যাত্রী জানান, ‘ঘ’ নম্বর কোচে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

টিটিই আমিরুল হক বলেন, ‘সঙ্গে সঙ্গে আমার পেছনে থাকা গার্ড সিফাত হোসেনকে বলি, দ্রুত পিএ অপারেটরকে ট্রেনের মাইকে ঘোষণা করতে যে ট্রেনের মধ্যে যদি কোনো ডাক্তার থাকেন, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে যেন “ঘ” কোচে আসেন তিনি। মাইকিং করার পর একজন ডাক্তার (রাজধানীর ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানাউল্লাহ) “জ” কোচ থেকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। এরপর “চ” কোচ থেকে একজন শিক্ষানবিশ নারী ডাক্তারও (রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ডা. আফসানা ইসলাম রোজা) এলেন। দুজন নার্সও দ্রুত “ঘ” কোচে ছুটে গেলেন। আরও কয়েকজন এগিয়ে এলেন।’

টিটিই জানান, চিকিৎসক ওই নারীর রক্তপাত দেখে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে জরুরি সেবার হটলাইন নম্বর ৯৯৯-এ কল দিলেন এক যাত্রী। সিদ্ধান্ত হলো, টাঙ্গাইল স্টেশনে ট্রেন থামানো হবে। চিলাহাটি এক্সপ্রেসের ক্রসিং পড়েছে সেখানে। ৯৯৯ থেকে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর দেওয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সঙ্গে কথা হলো, তাঁরাও রেডি। এদিকে ওই নারীর রক্তপাত থামছেই না। গর্ভে থাকা চার মাসের বাচ্চাটা গর্ভেই মারা গেল। ‘ঘ’ কোচের নারী যাত্রীরা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন পুরো জায়গাটা। তিন আসনের চেয়ারের সারিটা যেন অস্ত্রোপচার কক্ষ হয়ে উঠেছিল।

টিটিই আমিরুল বলেন, ওই নারীর মৃত বাচ্চাটিকে ডাক্তার-নার্সরা বের করে আনেন। ডা. সানাউল্লাহ সবাইকে আশ্বস্ত করেন, রোগী অনেকটা শঙ্কামুক্ত। কিন্তু রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। ট্রেনের নারী যাত্রীরা কাপড় ও অন্যান্য যাবতীয় জিনিসপত্র দিয়ে সহযোগিতা করলেন। রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সেই স্যালাইন, হেক্সিসল, ডেটল, যাত্রীরা যার কাছে, যা ছিল তা দিয়ে সাহায্য করলেন।

এরপর দুশ্চিন্তা শুরু হলো, জরুরি ভিত্তিতে কিছু ওষুধ প্রয়োজন। চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিলেন। ঈশ্বরদীর টিটিই আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠুকে ফোন করে বিস্তারিত জানানো হলো। ঈশ্বরদীতে তখন মুষলধারে বৃষ্টি। তবু তিনি মোবাইলে প্রেসক্রিপশন পেয়ে ওষুধের দোকানে চলে গেলেন। সব ওষুধ কিনে রিকশাওয়ালাকে দিয়ে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনের মাস্টারকে পাঠালেন। ট্রেন স্টেশনে থামলে সেই ওষুধ নেওয়া হয়।

আমিরুল হক আরও জানান, রাত সাড়ে ৩টা নাগাদ ওই নারী ও তাঁর স্বামী দিনাজপুরের ফুলবাড়ী স্টেশনে নামেন। চিকিৎসক সানাউল্লাহ সারাটা রাত, সারাটা পথ ওই রোগীর পাশে বসে ছিলেন। শিক্ষানবিশ চিকিৎসক আফসানা ইসলাম রোজা, নার্স ফারজানা আক্তার ও মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইনস্ট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন নিশা, রুমি ইসলামসহ একদল মানবিক মানুষের সহযোগিতায় একজনের প্রাণ বেঁচে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার চাকরিজীবনে ট্রেনে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। স্যালুট জানাই ওই মানুষদের।’

ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমার বাড়ি দিনাজপুরে। গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলাম। ট্রেনে মাইকে ঘোষণা শুনে বসে থাকতে পারিনি। যদিও ট্রেনের মধ্যে কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঢাল-তলোয়ার কিছু ছিল না। তারপরও সবার সহযোগিতায় ওই নারীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত