মামুনুর রশীদ
অভাবনীয় একটা চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষ। এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে যে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। করোনা মহামারিকালে এবং ডেঙ্গুর প্রকোপে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলো একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশে রোগবালাই ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। একদিকে মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক অজ্ঞতা, অন্যদিকে খাদ্যে ভেজাল—দুটো মিলিয়ে এক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা জনপদ।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্য এমন এক পর্যায়ে পড়েছে যে সাধারণ মানুষের সামান্য সবজি কেনারও সামর্থ্য হচ্ছে না। বাজারে শাকসবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম কোনো কিছুর অভাব নেই। প্রোটিনজাতীয় খাদ্যেরও কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সব সময় ঘাটতি দেখিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়েই চলেছেন, যার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে দেশের মানুষ নানা ধরনের রোগে বিপর্যস্ত। সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি এবং সুব্যবস্থার অভাবে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিক অথবা বেসরকারি হাসপাতালে। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো যেন একটা খড়্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো রোগী এলেই বিপুল অর্থ আদায় করে ছাড়ছে।
এর সঙ্গে আছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর উপদ্রব। যেকোনো সামান্য চিকিৎসার জন্য গেলেও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে পরীক্ষার পর সদাসয় চিকিৎসক মহোদয় একটা বড় প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন। সেইসব ওষুধের মূল্য অস্বাভাবিক। রোগীর সঙ্গের মানুষের তুলনায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের উপস্থিতিও কম নয়। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
এসব করেও রোগীকে ক্লিনিক বা হাসপাতালে থাকতে হয়; যেখানে প্রতিদিনের সিট বা কেবিন ভাড়া সেটা কল্পনার অতীত। ভালো প্রাইভেট হাসপাতালে বেড ও কেবিন ভাড়া যেকোনো ফাইভ স্টার হোটেলের সমান। সেখানকার সেবা উন্নতমানের হলেও অর্থটাও তেমনি উন্নতমানের। সুচিকিৎসা করতে গিয়ে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জমিজমা, ভিটেবাড়ি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এই ব্যবসাটি এত লাভজনক যে আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রথমে দু-তিনটি রুম নিয়ে একটি ক্লিনিকের ব্যবসা শুরু এবং কয়েক বছরের মধ্যে তা একটি বিশাল ফ্ল্যাটে রূপান্তর হয়। পরে নিজস্ব অট্টালিকা, একাধিক অট্টালিকা এবং দেশব্যাপী তাদের শাখা গড়ে ওঠে। হাজার কোটি টাকা প্রতিদিন এখানে লেনদেন হচ্ছে। এখন আবার চিকিৎসকেরা নিজেরাই হাসপাতাল তৈরি করে থাকেন এবং অতিদ্রুতই এই হাসপাতালগুলো সম্প্রসারিত হতে থাকে। তাতে চিকিৎসকদের নানান সুযোগ-সুবিধা। প্রথম সুবিধাই হচ্ছে তাঁদের সরকারি চাকরিটি আছে এবং তা বেলা ২টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। সরকারি অফিসগুলো যেখানে ৯টা থেকে ৫টা, সেখানে হাসপাতালের ডাক্তারদের কাজের সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। ২টার পর কেউ কেউ বাসায় যান সামান্য বিশ্রামের জন্য। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক ছোটেন প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতাল ও প্রাইভেট চেম্বারের দিকে।
একবার দেখা গেছে, কোনো এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এক মিনিটও একটি রোগী দেখেন না, ৫৯ সেকেন্ডের মধ্যে একজন রোগী দেখা শেষ করেন। ওই চিকিৎসক প্রতিদিন ১০০ রোগী দেখে থাকেন, কেউ কেউ রাত ১টা-২টা বা ৩টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। এটাও শুনেছি, কারও নাকি রোগী দেখতে দেখতে ভোর হয়ে যায়! স্বাস্থ্যগত কারণেও এত অল্প সময় বিশ্রামের পর ওই চিকিৎসক কী করে রোগী দেখায় মনোযোগী হবেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন।
এবার রোগীর কথা ভাবা যাক। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের ভিজিট, হাসপাতালে ভর্তি হলে তার সিট ভাড়া, ওষুধপত্র কেনা আর অপারেশন হলে তো কথাই নেই। বিপুল অর্থ খরচ করে নিঃস্ব হয়ে অনেকে বাড়িতেও ফিরতে পারেন না। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা নেই। যেখান থেকে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা যায়। দু-চারটে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হয়তো এই ব্যবস্থা আছে, কিন্তু অধিকাংশই এই ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে আছে দুর্নীতি। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে নানান ধরনের দুর্নীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। চিকিৎসা, অ্যাম্বুলেন্স, ভালো ডাক্তার দেখানো—সবকিছুর মধ্যে দুর্নীতি। প্রভাবশালী লোকদের জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থা কিছুটা সহনশীল হলেও সাধারণের জন্য তা একেবারেই অগম্য।
কিছু কিছু চিকিৎসক এসব বিষয়ে হয়তো ভাবনাচিন্তা করেন। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় এতই নগণ্য যে তাঁদের কথা অন্য চিকিৎসকেরা উপহাস করে উড়িয়ে দেন। মেডিকেল কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপককে আমি জানি, যিনি চাকরিজীবনের প্রথমেই পণ করেছেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন না এবং চিকিৎসাকে পণ্য হিসেবে দেখবেন না। আরও কয়েকজন অধ্যাপককে জানি, যাঁদের কেউ কেউ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না এবং করলেও দরিদ্র রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা করে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেক কষ্ট করে একটি আইন করা হয়েছে যে, সহকারী অধ্যাপক হওয়ার পর একজন চিকিৎসককে নির্ধারণ করতে হবে, তিনি সরকারি চাকরি করবেন নাকি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন। সরকারি চাকরি করলে তাঁকে একটা ভাতাও দেওয়া হয়ে থাকে। চিকিৎসকেরা সেই ভাতা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। বাংলাদেশে অবশ্য কোনো দিনই এই আইন কার্যকর করা যাবে না।
আবার ডাক্তারদের মধ্যে আছে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বিভাজন। সরকারি দলের ডাক্তাররা নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন কিন্তু বিরোধী দলের ডাক্তাররা যতই দক্ষ হোন না কেন, সরকারের সুবিবেচনার পাত্র হবেন না। কাজেই যাঁরা সুবিবেচনা পান না তাঁরা একধরনের ক্ষোভ নিয়ে তাঁদের দায়িত্বটি পালন করেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখতে হবে কেন? কারও মনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে সুযোগ-সুবিধার জন্য অন্য কোনো রাজনৈতিক আদর্শের বিশেষজ্ঞকে কেন বঞ্চিত করা হবে?
সম্প্রতি খুব নিম্ন আয়ের একজন কর্মচারীর শিশুপুত্রের একটি অপারেশন হয়েছে। অপারেশনটি বাধ্য হয়ে তাঁকে করতে হয়েছে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। যদিও যিনি অপারেশন করেছেন তিনি সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা। সরকারি হাসপাতালেই সেই ডাক্তার অপারেশন করতে পারতেন, কিন্তু জেনেশুনে একজন দরিদ্র লোককে অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে অপারেশনটা করালেন। বহু কষ্টে সেই পিতা তাঁর সন্তানকে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এখনো সেই চিকিৎসা শেষ হয়নি। এই রকম নির্দয়তার ইতিহাস বাংলাদেশে হাজারে হাজার। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যান। সেখানে অবশ্যই খরচ প্রচুর। পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তরিকতা বিস্ময়কর। তাই একটু অর্থ থাকলে এই রোগীদের গন্তব্য হয় ভারত, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর।
দাঁতের চিকিৎসা পৃথিবীর সব জায়গাতেই ব্যয়বহুল। কিন্তু আমাদের দেশে এটি একটি সহনশীল পর্যায়ে ছিল, সেটিও এখন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার কন্যাসম একজন দাঁতের ব্যথায় আক্রান্ত রোগী গুলশান-বনানীর একটি ক্লিনিকে দাঁতের চিকিৎসা নিতে যান এবং দুটি দাঁত ফেলার জন্য চিকিৎসক তাঁর কাছ থেকে প্রায় ৮০ হাজার টাকা আদায় করেন! কিন্তু দাঁত দুটি ফেলার পর তাঁর অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়। ওই যন্ত্রণা নিয়েই সেই মেয়ে আমেরিকায় চলে যান। পরিস্থিতি এমন হলো যে তাঁকে পরের দিন ইমার্জেন্সি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বিদেশের চিকিৎসক জানালেন ওই দাঁত ফেলতে গিয়ে চোয়ালের একটা অংশ ভেঙে গেছে এবং সেখানে একটি ইস্পাতের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এই চিকিৎসা করতে গেলে আরও অনেক অর্থ লাগবে। দুটি দাঁত তোলার জন্য এত টাকা খরচ করেও মেয়েটি রেহাই পেলেন না। এখনো তাঁকে ব্যথা নিরাময় ওষুধ সেবন করে চলতে হচ্ছে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম না।
আমার গাড়িচালক তার পেটের সমস্যার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। চিকিৎসকের দায়িত্বহীনতার কারণে তাকে তিনবার অপারেশন করতে হয়েছে এবং বর্তমানে তার খাদ্যনালির সংক্রমণ নিয়েই জীবন কাটাতে হচ্ছে। চিকিৎসক মানুষ, তাঁর ভুল হতেই পারে। কিন্তু একটি রোগের জন্য তিনবার অপারেশন কেন করতে হবে, এটা একটা প্রশ্ন! উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকের অবহেলায় কোনো রোগীর সমস্যা হলে মামলা করার বিধান আছে। সেই বিধান হয়তো আমাদের দেশেও আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ করতে হলে যে বিপুল অর্থ ও তদবির লাগবে, তার যোগ্যতা আমরা কিনে নিই।
এরপরেও বলব, দেশে অনেক চিকিৎসক আছেন যাঁরা দেশের চিকিৎসা নিয়ে ভাবেন এবং স্বভাবেও মানবিক, শিক্ষায় যথেষ্ট জ্ঞানী। তাঁদের কাছে অনুরোধ থাকবে—চিকিৎসাব্যবস্থাটাকে নিয়ে একটি গুরুতর ভাবনা ভাবুন এবং আগামী দিনের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, যেন মানুষের স্বাস্থ্যসেবার পথটি প্রশস্ত হয়।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
অভাবনীয় একটা চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষ। এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে যে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। করোনা মহামারিকালে এবং ডেঙ্গুর প্রকোপে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলো একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশে রোগবালাই ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। একদিকে মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক অজ্ঞতা, অন্যদিকে খাদ্যে ভেজাল—দুটো মিলিয়ে এক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা জনপদ।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্য এমন এক পর্যায়ে পড়েছে যে সাধারণ মানুষের সামান্য সবজি কেনারও সামর্থ্য হচ্ছে না। বাজারে শাকসবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম কোনো কিছুর অভাব নেই। প্রোটিনজাতীয় খাদ্যেরও কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সব সময় ঘাটতি দেখিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়েই চলেছেন, যার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে দেশের মানুষ নানা ধরনের রোগে বিপর্যস্ত। সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি এবং সুব্যবস্থার অভাবে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিক অথবা বেসরকারি হাসপাতালে। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো যেন একটা খড়্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো রোগী এলেই বিপুল অর্থ আদায় করে ছাড়ছে।
এর সঙ্গে আছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর উপদ্রব। যেকোনো সামান্য চিকিৎসার জন্য গেলেও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে পরীক্ষার পর সদাসয় চিকিৎসক মহোদয় একটা বড় প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন। সেইসব ওষুধের মূল্য অস্বাভাবিক। রোগীর সঙ্গের মানুষের তুলনায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের উপস্থিতিও কম নয়। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
এসব করেও রোগীকে ক্লিনিক বা হাসপাতালে থাকতে হয়; যেখানে প্রতিদিনের সিট বা কেবিন ভাড়া সেটা কল্পনার অতীত। ভালো প্রাইভেট হাসপাতালে বেড ও কেবিন ভাড়া যেকোনো ফাইভ স্টার হোটেলের সমান। সেখানকার সেবা উন্নতমানের হলেও অর্থটাও তেমনি উন্নতমানের। সুচিকিৎসা করতে গিয়ে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জমিজমা, ভিটেবাড়ি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এই ব্যবসাটি এত লাভজনক যে আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রথমে দু-তিনটি রুম নিয়ে একটি ক্লিনিকের ব্যবসা শুরু এবং কয়েক বছরের মধ্যে তা একটি বিশাল ফ্ল্যাটে রূপান্তর হয়। পরে নিজস্ব অট্টালিকা, একাধিক অট্টালিকা এবং দেশব্যাপী তাদের শাখা গড়ে ওঠে। হাজার কোটি টাকা প্রতিদিন এখানে লেনদেন হচ্ছে। এখন আবার চিকিৎসকেরা নিজেরাই হাসপাতাল তৈরি করে থাকেন এবং অতিদ্রুতই এই হাসপাতালগুলো সম্প্রসারিত হতে থাকে। তাতে চিকিৎসকদের নানান সুযোগ-সুবিধা। প্রথম সুবিধাই হচ্ছে তাঁদের সরকারি চাকরিটি আছে এবং তা বেলা ২টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। সরকারি অফিসগুলো যেখানে ৯টা থেকে ৫টা, সেখানে হাসপাতালের ডাক্তারদের কাজের সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। ২টার পর কেউ কেউ বাসায় যান সামান্য বিশ্রামের জন্য। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক ছোটেন প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতাল ও প্রাইভেট চেম্বারের দিকে।
একবার দেখা গেছে, কোনো এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এক মিনিটও একটি রোগী দেখেন না, ৫৯ সেকেন্ডের মধ্যে একজন রোগী দেখা শেষ করেন। ওই চিকিৎসক প্রতিদিন ১০০ রোগী দেখে থাকেন, কেউ কেউ রাত ১টা-২টা বা ৩টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। এটাও শুনেছি, কারও নাকি রোগী দেখতে দেখতে ভোর হয়ে যায়! স্বাস্থ্যগত কারণেও এত অল্প সময় বিশ্রামের পর ওই চিকিৎসক কী করে রোগী দেখায় মনোযোগী হবেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন।
এবার রোগীর কথা ভাবা যাক। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের ভিজিট, হাসপাতালে ভর্তি হলে তার সিট ভাড়া, ওষুধপত্র কেনা আর অপারেশন হলে তো কথাই নেই। বিপুল অর্থ খরচ করে নিঃস্ব হয়ে অনেকে বাড়িতেও ফিরতে পারেন না। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা নেই। যেখান থেকে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা যায়। দু-চারটে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হয়তো এই ব্যবস্থা আছে, কিন্তু অধিকাংশই এই ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে আছে দুর্নীতি। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে নানান ধরনের দুর্নীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। চিকিৎসা, অ্যাম্বুলেন্স, ভালো ডাক্তার দেখানো—সবকিছুর মধ্যে দুর্নীতি। প্রভাবশালী লোকদের জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থা কিছুটা সহনশীল হলেও সাধারণের জন্য তা একেবারেই অগম্য।
কিছু কিছু চিকিৎসক এসব বিষয়ে হয়তো ভাবনাচিন্তা করেন। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় এতই নগণ্য যে তাঁদের কথা অন্য চিকিৎসকেরা উপহাস করে উড়িয়ে দেন। মেডিকেল কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপককে আমি জানি, যিনি চাকরিজীবনের প্রথমেই পণ করেছেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন না এবং চিকিৎসাকে পণ্য হিসেবে দেখবেন না। আরও কয়েকজন অধ্যাপককে জানি, যাঁদের কেউ কেউ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না এবং করলেও দরিদ্র রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা করে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেক কষ্ট করে একটি আইন করা হয়েছে যে, সহকারী অধ্যাপক হওয়ার পর একজন চিকিৎসককে নির্ধারণ করতে হবে, তিনি সরকারি চাকরি করবেন নাকি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন। সরকারি চাকরি করলে তাঁকে একটা ভাতাও দেওয়া হয়ে থাকে। চিকিৎসকেরা সেই ভাতা পেয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। বাংলাদেশে অবশ্য কোনো দিনই এই আইন কার্যকর করা যাবে না।
আবার ডাক্তারদের মধ্যে আছে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বিভাজন। সরকারি দলের ডাক্তাররা নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন কিন্তু বিরোধী দলের ডাক্তাররা যতই দক্ষ হোন না কেন, সরকারের সুবিবেচনার পাত্র হবেন না। কাজেই যাঁরা সুবিবেচনা পান না তাঁরা একধরনের ক্ষোভ নিয়ে তাঁদের দায়িত্বটি পালন করেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখতে হবে কেন? কারও মনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে সুযোগ-সুবিধার জন্য অন্য কোনো রাজনৈতিক আদর্শের বিশেষজ্ঞকে কেন বঞ্চিত করা হবে?
সম্প্রতি খুব নিম্ন আয়ের একজন কর্মচারীর শিশুপুত্রের একটি অপারেশন হয়েছে। অপারেশনটি বাধ্য হয়ে তাঁকে করতে হয়েছে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। যদিও যিনি অপারেশন করেছেন তিনি সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা। সরকারি হাসপাতালেই সেই ডাক্তার অপারেশন করতে পারতেন, কিন্তু জেনেশুনে একজন দরিদ্র লোককে অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে অপারেশনটা করালেন। বহু কষ্টে সেই পিতা তাঁর সন্তানকে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এখনো সেই চিকিৎসা শেষ হয়নি। এই রকম নির্দয়তার ইতিহাস বাংলাদেশে হাজারে হাজার। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যান। সেখানে অবশ্যই খরচ প্রচুর। পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তরিকতা বিস্ময়কর। তাই একটু অর্থ থাকলে এই রোগীদের গন্তব্য হয় ভারত, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর।
দাঁতের চিকিৎসা পৃথিবীর সব জায়গাতেই ব্যয়বহুল। কিন্তু আমাদের দেশে এটি একটি সহনশীল পর্যায়ে ছিল, সেটিও এখন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার কন্যাসম একজন দাঁতের ব্যথায় আক্রান্ত রোগী গুলশান-বনানীর একটি ক্লিনিকে দাঁতের চিকিৎসা নিতে যান এবং দুটি দাঁত ফেলার জন্য চিকিৎসক তাঁর কাছ থেকে প্রায় ৮০ হাজার টাকা আদায় করেন! কিন্তু দাঁত দুটি ফেলার পর তাঁর অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়। ওই যন্ত্রণা নিয়েই সেই মেয়ে আমেরিকায় চলে যান। পরিস্থিতি এমন হলো যে তাঁকে পরের দিন ইমার্জেন্সি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বিদেশের চিকিৎসক জানালেন ওই দাঁত ফেলতে গিয়ে চোয়ালের একটা অংশ ভেঙে গেছে এবং সেখানে একটি ইস্পাতের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এই চিকিৎসা করতে গেলে আরও অনেক অর্থ লাগবে। দুটি দাঁত তোলার জন্য এত টাকা খরচ করেও মেয়েটি রেহাই পেলেন না। এখনো তাঁকে ব্যথা নিরাময় ওষুধ সেবন করে চলতে হচ্ছে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম না।
আমার গাড়িচালক তার পেটের সমস্যার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। চিকিৎসকের দায়িত্বহীনতার কারণে তাকে তিনবার অপারেশন করতে হয়েছে এবং বর্তমানে তার খাদ্যনালির সংক্রমণ নিয়েই জীবন কাটাতে হচ্ছে। চিকিৎসক মানুষ, তাঁর ভুল হতেই পারে। কিন্তু একটি রোগের জন্য তিনবার অপারেশন কেন করতে হবে, এটা একটা প্রশ্ন! উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকের অবহেলায় কোনো রোগীর সমস্যা হলে মামলা করার বিধান আছে। সেই বিধান হয়তো আমাদের দেশেও আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ করতে হলে যে বিপুল অর্থ ও তদবির লাগবে, তার যোগ্যতা আমরা কিনে নিই।
এরপরেও বলব, দেশে অনেক চিকিৎসক আছেন যাঁরা দেশের চিকিৎসা নিয়ে ভাবেন এবং স্বভাবেও মানবিক, শিক্ষায় যথেষ্ট জ্ঞানী। তাঁদের কাছে অনুরোধ থাকবে—চিকিৎসাব্যবস্থাটাকে নিয়ে একটি গুরুতর ভাবনা ভাবুন এবং আগামী দিনের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, যেন মানুষের স্বাস্থ্যসেবার পথটি প্রশস্ত হয়।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে