মঙ্গলপাড়ার চতুর সালাম আর সরল সাব্বিরের গল্প

এস এম নূর মোহাম্মদ
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২২, ০৮: ৩৬
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২২, ০৮: ৪৬

রাজশাহীর পুঠিয়ার মঙ্গলপাড়া গ্রামে বাড়ি আব্দুস সালাম ও সাব্বিরের। মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও সালাম এলাকায় চতুর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, সাব্বির এমবিএ শেষ করেছেন, কিন্তু সহজ-সরল হিসেবেই মানুষ তাঁকে জানে। সাব্বিরের অভিযোগ, সালাম চাতুরী করে তাঁকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। কোনো অপরাধ না করেও সাজার দণ্ড মাথায় নিয়ে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন।

সাব্বিরের অভিযোগ আর আদালত-পুলিশের বয়ানে সাব্বির-সালামের গল্পটা এ রকম—সালাম একসময় স্থানীয় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আহমদ উল্লাহর দোকানে কাজ করতেন। সেই সুবাদে ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তাঁর। পুঠিয়ার কিছু লোকজনকে বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে পশুপালন ও চিকিৎসার বিষয়ে প্রশিক্ষণের চিঠি আসে ভাইস চেয়ারম্যানের কাছে। সেই প্রশিক্ষণ নিতে সাব্বিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সালাম। সাব্বির প্রশিক্ষণ নিতে রাজি হলে তাঁর কাছ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাসের সনদ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নেন সালাম। ২০১১ সালে প্রশিক্ষণ শেষে সাব্বির এলাকায় পশু চিকিৎসা শুরু করেন।

এদিকে ভাইস চেয়ারম্যানের ফিডের দোকানে কাজের সুবাদে বিভিন্ন ডিলারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে সালামের। একসময় তিনি নিজেই ডিলারদের কাছ থেকে পণ্য কিনে সরবরাহের পরিকল্পনা শুরু করেন। এরপর টাঙ্গাইলের অপূর্ব পোলট্রি অ্যান্ড ফিড লিমিটেডের ডিলার রফিকুল ইসলাম খানের কাছ থেকে পণ্য ক্রয়ের প্রস্তাব দেন। আর ব্যবসার জন্য ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট রাজশাহীর বানেশ্বর শাখায় পূবালী ব্যাংকে হিসাব খোলেন সালাম। সেখানে নিজেকে সাব্বির হিসেবে উপস্থাপন করেন। হিসাব খুলতে ব্যবহার করেন প্রশিক্ষণের জন্য দেওয়া সাব্বিরের সেই এনআইডি। সেখানে ফটোশপ করে সাব্বিরের ছবির স্থলে নিজের ছবি ও স্বাক্ষরের স্থানে নিজের সাক্ষর বসান সালাম। অর্থাৎ সাব্বিরের নাম, বাবা-মায়ের নাম-ঠিকানা সবই ঠিক থাকে। আর নমিনি করেন নিজের আপন বোন খাদিজা খাতুন ওরফে কেয়াকে। তাঁকে নিজের স্ত্রী হিসেবে দেখান সালাম।

ব্যবসা শুরু করেন সালাম, তবে নিজের নামে নয় সাব্বিরের নামে। বাকিতে পণ্য কেনা শুরু করেন টাঙ্গাইলের সেই রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে। একসময় অনেক টাকা বাকি পড়ে যায়। পাওনা চাইলে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল রফিকুলকে ১০ লাখ টাকার চেক দেন সালাম। রফিকুল চেকটি ব্যাংকে জমা দিলে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর টাকা দিতে নোটিশ পাঠান রফিকুল। ২০১৮ সালের ৬ মে ওই নোটিশ যায় প্রকৃত সাব্বিরের কাছে (কারণ, রফিকুল সালামকে সাব্বির নামেই জানেন, ব্যাংকের লেনদেনের তথ্যেও সালাম সেখানে সাব্বির)। এরপর প্রকৃত সাব্বির ব্যাংকে গিয়ে তাঁর এনআইডি ব্যবহার করে প্রতারণার বিষয়টি অবগত হন। ওই বছরের ৭ জুন আইনি নোটিশের জবাবও দেন তিনি। যাতে প্রতারণার বিষয়টি তুলে ধরেন।

তবে জবাব দেওয়ার পরও চেক দেওয়া সাব্বিরের (সালাম) বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্টে (চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত) ২০১৮ সালের ২ জুলাই মামলা করেন রফিকুল ইসলাম। ওই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন প্রতারক সালাম। এর পর থেকে তিনি পলাতক। পরবর্তী সময়ে প্রকৃত সাব্বির বাদী হয়ে প্রতারক সালামের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেন গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ওই মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। সিআইডি তদন্ত শেষে গত বছরের মার্চে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। এতে আব্দুস সালাম সাব্বিরের এনআইডি জালিয়াতি করে ব্যাংক হিসাব খোলে বলে মতামত দেওয়া হয়।

এদিকে সাব্বিরের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্টে ২০১৮ সালে রফিকুল ইসলামের করা মামলায় গত বছরের ৮ নভেম্বর রায় দেন আদালত। রায়ে সাব্বিরকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং ১০ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পলাতক থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এনআই অ্যাক্টের মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে জরিমানার অর্ধেক টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সাব্বিরের ওই টাকা পরিশোধের সামর্থ্য নেই। তা ছাড়া, তিনি কেন টাকা পরিশোধ করবেন? তাই উচ্চ আদালতে ওই মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেছেন সাব্বির। তিনি এখন ওই মামলা থেকে অব্যাহতি চান।

সাব্বিরের আসল পরিচয়পত্র ও সালামের তৈরি নকল পরিচয়পত্রসাব্বির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি খুবই গরিব মানুষ। কোনোরকমে একটি দোকান চালিয়ে সংসার চালাই। মামলায় সাজা হওয়ার পর পুলিশ আমাকে খুঁজছে। কয়েক মাস আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার চার বছরের ছেলে ও স্ত্রী বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়িতে আছে। আমি দ্রুত মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই।’ তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযুক্ত আব্দুস সালাম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি অল্প লেখাপড়া করেছি। এসব করব কীভাবে?’ সাব্বিরের এনআইডিতে নিজের ছবি ব্যবহার এবং ছোট বোনকে নিজের স্ত্রী সাজানোর বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া এনআই অ্যাক্টের ওই মামলায় আদালতে জামিন নিতে যাননি বলেও দাবি সালামের।

সালামের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আহমদ উল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সালাম আমার কয়েক লাখ টাকা তছরুপ করেছিল। সব বাদ দিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। সেটাও দেয়নি এখনো। বাজারের সমিতির টাকা তছরুপের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মালামাল কিনে ডিলারদের টাকা পরিশোধ না করা এবং টাকা নিয়ে মাল না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।’

সাব্বিরের আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির আজকের পত্রিকাকে বলেন, অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রকৃত দোষী যিনি বিচারে তিনি ছাড়া পেয়ে গেছেন। আর নির্দোষ ব্যক্তি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। নির্দোষ ব্যক্তি হয়রানির শিকার হলে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থাকবে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত