সাজন আহম্মেদ পাপন, কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের (নিকলী-বাজিতপুর) সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মো. আফজাল হোসেন। ওই আসন থেকে টানা চারবার এমপি হন তিনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। এই ভাইয়ের হাত ধরেই রাজনীতিতে আগমন আফজালের। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে আফজাল হোসেনের আওয়ামী লীগের সদস্যপদ পর্যন্ত ছিল না। দলের একটা বড় অংশের বিরোধিতার মধ্যেই তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে, আফজাল সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ঘরের বাজার করে দিতেন। জুতাও এগিয়ে দিতেন। ধীরে ধীরে তিনি আবদুল হামিদের আস্থা অর্জন করেন। আর আবদুল হামিদও চেয়েছিলেন হাওর এলাকা বাজিতপুর ও নিকলী উপজেলার কর্তৃত্ব তাঁর বলয়ে থাকুক। তাই তিনি বেছে নিয়েছেন আফজালকে। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ‘ম্যানেজ’ করে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন আফজাল হোসেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সহযোগিতায় মনোনয়ন বাগিয়ে নেন তিনি।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আফজাল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১২ সালের জুন থেকে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন।
সূত্র জানায়, আবদুল হামিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আফজাল হোসেন জমি দখলসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে আফজাল গত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আফজালের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয়ে ওঠেন তাঁর ছোট ভাই আনোয়ারা হোসেন আশরাফ। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে পরের বছর পৌরসভা নির্বাচনে আফজাল হোসেন তাঁর ভাইকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। এলাকার অনেকের অভিযোগ, আনোয়ার হোসেন বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, খুন, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে খাসজমি, দোকানপাট, বাড়িঘর, জলমহাল, বালুমহাল দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। মানুষকে মামলায় হয়রানি ও মাদক কারবারের অভিযোগও রয়েছে।
পরিস্থিতি এতই ভীতিকর ছিল যে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাহস পেত না। যারা দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার হয়েছে।
দখলের থাবা সর্বত্র
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই ভাই মিলে বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ, বেঙ্গলা নদী দখল, নির্বাচনী এলাকার অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে দখল, বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে ৭০ শতাংশ দখল করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ, ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিসের পাশে ২৯ শতাংশ জমি, সিনেমা হল রোডে একটি দোকান, বসন্তপুর মৌজায় সিনেমা হলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনেমা হলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় প্রায় দুই একর জমি দখল এবং বসন্তপুর মৌজায় প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ পাশে প্রায় দুই একর জমি, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ২০ শতাংশ জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় প্রায় আট একর জমি, শশেরদীঘি মৌজায় প্রায় ১০ একর ধানি জমি, বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূর্ব পাশে ২০ শতাংশ জমি, দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করেছেন।
এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনের ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়ে মানহীন কাজ, বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহালের ইজারাদারের থেকে ৫০ শতাংশ হারে ভাগ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌরসভা এলাকায় ২০ শতাংশ জমি দখল করে সাততলা মার্কেট (আফজালের নিজের বাসভবন), বাজিতপুরে নিজের গ্রাম দিলালপুরে তিনতলার সুরম্য অট্টালিকা এবং বাজিতপুর পৌরসভা ডাকবাংলোর সামনে দুই মৌজায় ২৭৫ শতাংশ জমি দখল করেন।
২০১৭ সালের ১৩ মার্চ জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এমপি ও মেয়রের অনুসারীদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মিয়া নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে নিজ বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সামনে পিটিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার দুই হাত ও এক পা ভেঙে দেওয়া হয়। তাঁর ২৯ শতাংশ জমিও দখল করে নেন দুই ভাই। ভুক্তভোগী বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘আমার জায়গা দখল করছে। আমার জায়গায় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকার গাছ ছিল, ওইগুলোও নিয়ে গেছে। আমার জায়গার মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা।’
বাজিতপুর পৌর এলাকার সিনেমা হল সড়কে একটি দোকানের মালিক চঞ্চল। তাঁর দোকানও দখল করে নেন আফজাল ও তাঁর ভাই আশরাফ। ভুক্তভোগী চঞ্চল বলেন, ‘আমার দোকান প্রায় ৩ বছর তালা দিয়ে রাখে। কত চেষ্টা করলাম কিন্তু দোকানটা উদ্ধার করতে পারিনি তখন। ৫ আগস্টের পর দোকানটা দখলমুক্ত করি।’
নামে-বেনামে যত সম্পদ
অন্যদিকে ৬/৪, সেগুনবাগিচায় হাসিনুর গ্রিন হাউসে দুটি ফ্ল্যাট, ৯৫, আগামসিহ লেনে পাঁচতলা ভবন, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেডের পেছনে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি। দক্ষিণ বনশ্রীতে সাততলা বাড়ি, উত্তরায় সাত কাঠার প্লট, কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়ি, আফতাবনগরের সি ব্লকে, রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের ১৩/এ রোডে ও পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি করে প্লট, সিদ্দিকবাজারে ছয়তলার বাড়ি, দক্ষিণ বনশ্রীতে ছেলে সাঈদ হোসেনের নামে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন আফজাল হোসেন।
এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তিনি গড়েন হুন্ডির রমরমা ব্যবসা। এভাবে তিনি কত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, আফজাল ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আফজালের নামে সিঙ্গাপুরের অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি-গাড়ি ও মালয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি-গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, রাজধানী ঢাকায় ২০২৩ সালের ৯ মে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) কার্যালয়ে মো. কামাল হোসেন রিপন নামের এক ব্যবসায়ী সংবাদ সম্মেলন করে আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। আফজাল হোসেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টারে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দোকান বরাদ্দ দিয়ে এই টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ী।
দুদকে অভিযোগ
২০১৯ সালের শেষের দিকে ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে আফজালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের ক্যাসিনো-কাণ্ড ও বড় আকারের দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী দলকে।
আফজালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ও বেআইনি কার্যক্রম চালিয়ে শতকোটির বেশি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। জেলার বাজিতপুর-নিকলী আসনে টানা তিনবার এমপি হয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধভাবে নদীর বালু উত্তোলন, জমি দখলসহ নানাভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। নিজের এলাকার বাইরে রাজধানী ও বিদেশেও রয়েছে তাঁর সম্পদ।
ওই সময় দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সদস্যরা আফজালের সঙ্গে হোটেল রাজমণি ঈশা খাঁ, ফুয়াং ক্লাব, পুরান ঢাকার কয়েকটি বাড়িতে নিয়মিত আসর বসাতেন। আফজাল রাষ্ট্রের শীর্ষ কারও নাম ভাঙিয়ে অবাধে অপকর্ম চালিয়ে গেছেন। এ কারণে ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সদস্যরা একসময় মনে করতেন, আসরে আফজাল থাকলে ভয়ের কারণ নেই।
ওই অভিযোগে আরও বলা হয়, আফজালের ছোট ভাই এবং বাজিতপুর পৌর মেয়র আনোয়ার হোসেন আশরাফ হঠাৎ তাঁর ব্যবসা ছেড়ে ইয়াবা কারবারে ঢুকে পড়েন। ইয়াবা কারবারের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে তাকে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হতো, হয়রানিমূলক মামলাও করা হতো। অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের কাছে আফজাল শতকোটি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকসংক্রান্ত একটি নিউজ শেয়ার দেন। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাঁকে।
বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি এহসান বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে চিহ্নিত যে কটি উপজেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল, তার মধ্যে বাজিতপুর অন্যতম। তারা দুই ভাই এই রাজত্ব গড়ে তুলেছে। এমন কোনো অপকর্ম নেই যে তারা করেনি।’
এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক এমপি আফজাল হোসেনের মোবাইল ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায় এবং তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
দুদক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ইকবাল হোসাইন বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা দুদক কার্যালয়ে আফজাল হোসেনের ব্যাপারে কোনো ফাইল ওপেন হয়নি। এই বিষয়ে হেড অফিস বলতে পারবে। আর তাঁর ভাই আশরাফের দুটি ফাইল ছিল। একটা হলো তাঁর সম্পদের, আরেকটা ছিল অর্থ আত্মসাতের। আশরাফের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটিতে এখনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, আইনগত কাজ চলমান।
কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের (নিকলী-বাজিতপুর) সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মো. আফজাল হোসেন। ওই আসন থেকে টানা চারবার এমপি হন তিনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। এই ভাইয়ের হাত ধরেই রাজনীতিতে আগমন আফজালের। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে আফজাল হোসেনের আওয়ামী লীগের সদস্যপদ পর্যন্ত ছিল না। দলের একটা বড় অংশের বিরোধিতার মধ্যেই তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে, আফজাল সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ঘরের বাজার করে দিতেন। জুতাও এগিয়ে দিতেন। ধীরে ধীরে তিনি আবদুল হামিদের আস্থা অর্জন করেন। আর আবদুল হামিদও চেয়েছিলেন হাওর এলাকা বাজিতপুর ও নিকলী উপজেলার কর্তৃত্ব তাঁর বলয়ে থাকুক। তাই তিনি বেছে নিয়েছেন আফজালকে। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ‘ম্যানেজ’ করে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন আফজাল হোসেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সহযোগিতায় মনোনয়ন বাগিয়ে নেন তিনি।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আফজাল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১২ সালের জুন থেকে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন।
সূত্র জানায়, আবদুল হামিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আফজাল হোসেন জমি দখলসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে আফজাল গত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আফজালের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয়ে ওঠেন তাঁর ছোট ভাই আনোয়ারা হোসেন আশরাফ। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে পরের বছর পৌরসভা নির্বাচনে আফজাল হোসেন তাঁর ভাইকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। এলাকার অনেকের অভিযোগ, আনোয়ার হোসেন বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, খুন, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে খাসজমি, দোকানপাট, বাড়িঘর, জলমহাল, বালুমহাল দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। মানুষকে মামলায় হয়রানি ও মাদক কারবারের অভিযোগও রয়েছে।
পরিস্থিতি এতই ভীতিকর ছিল যে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাহস পেত না। যারা দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার হয়েছে।
দখলের থাবা সর্বত্র
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই ভাই মিলে বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ, বেঙ্গলা নদী দখল, নির্বাচনী এলাকার অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে দখল, বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে ৭০ শতাংশ দখল করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ, ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিসের পাশে ২৯ শতাংশ জমি, সিনেমা হল রোডে একটি দোকান, বসন্তপুর মৌজায় সিনেমা হলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনেমা হলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় প্রায় দুই একর জমি দখল এবং বসন্তপুর মৌজায় প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ পাশে প্রায় দুই একর জমি, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ২০ শতাংশ জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় প্রায় আট একর জমি, শশেরদীঘি মৌজায় প্রায় ১০ একর ধানি জমি, বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূর্ব পাশে ২০ শতাংশ জমি, দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করেছেন।
এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনের ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়ে মানহীন কাজ, বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহালের ইজারাদারের থেকে ৫০ শতাংশ হারে ভাগ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌরসভা এলাকায় ২০ শতাংশ জমি দখল করে সাততলা মার্কেট (আফজালের নিজের বাসভবন), বাজিতপুরে নিজের গ্রাম দিলালপুরে তিনতলার সুরম্য অট্টালিকা এবং বাজিতপুর পৌরসভা ডাকবাংলোর সামনে দুই মৌজায় ২৭৫ শতাংশ জমি দখল করেন।
২০১৭ সালের ১৩ মার্চ জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এমপি ও মেয়রের অনুসারীদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মিয়া নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে নিজ বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সামনে পিটিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার দুই হাত ও এক পা ভেঙে দেওয়া হয়। তাঁর ২৯ শতাংশ জমিও দখল করে নেন দুই ভাই। ভুক্তভোগী বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘আমার জায়গা দখল করছে। আমার জায়গায় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকার গাছ ছিল, ওইগুলোও নিয়ে গেছে। আমার জায়গার মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা।’
বাজিতপুর পৌর এলাকার সিনেমা হল সড়কে একটি দোকানের মালিক চঞ্চল। তাঁর দোকানও দখল করে নেন আফজাল ও তাঁর ভাই আশরাফ। ভুক্তভোগী চঞ্চল বলেন, ‘আমার দোকান প্রায় ৩ বছর তালা দিয়ে রাখে। কত চেষ্টা করলাম কিন্তু দোকানটা উদ্ধার করতে পারিনি তখন। ৫ আগস্টের পর দোকানটা দখলমুক্ত করি।’
নামে-বেনামে যত সম্পদ
অন্যদিকে ৬/৪, সেগুনবাগিচায় হাসিনুর গ্রিন হাউসে দুটি ফ্ল্যাট, ৯৫, আগামসিহ লেনে পাঁচতলা ভবন, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেডের পেছনে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি। দক্ষিণ বনশ্রীতে সাততলা বাড়ি, উত্তরায় সাত কাঠার প্লট, কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়ি, আফতাবনগরের সি ব্লকে, রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের ১৩/এ রোডে ও পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি করে প্লট, সিদ্দিকবাজারে ছয়তলার বাড়ি, দক্ষিণ বনশ্রীতে ছেলে সাঈদ হোসেনের নামে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন আফজাল হোসেন।
এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তিনি গড়েন হুন্ডির রমরমা ব্যবসা। এভাবে তিনি কত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, আফজাল ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আফজালের নামে সিঙ্গাপুরের অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি-গাড়ি ও মালয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি-গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, রাজধানী ঢাকায় ২০২৩ সালের ৯ মে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) কার্যালয়ে মো. কামাল হোসেন রিপন নামের এক ব্যবসায়ী সংবাদ সম্মেলন করে আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। আফজাল হোসেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টারে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দোকান বরাদ্দ দিয়ে এই টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ী।
দুদকে অভিযোগ
২০১৯ সালের শেষের দিকে ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে আফজালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের ক্যাসিনো-কাণ্ড ও বড় আকারের দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী দলকে।
আফজালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ও বেআইনি কার্যক্রম চালিয়ে শতকোটির বেশি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। জেলার বাজিতপুর-নিকলী আসনে টানা তিনবার এমপি হয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধভাবে নদীর বালু উত্তোলন, জমি দখলসহ নানাভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। নিজের এলাকার বাইরে রাজধানী ও বিদেশেও রয়েছে তাঁর সম্পদ।
ওই সময় দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সদস্যরা আফজালের সঙ্গে হোটেল রাজমণি ঈশা খাঁ, ফুয়াং ক্লাব, পুরান ঢাকার কয়েকটি বাড়িতে নিয়মিত আসর বসাতেন। আফজাল রাষ্ট্রের শীর্ষ কারও নাম ভাঙিয়ে অবাধে অপকর্ম চালিয়ে গেছেন। এ কারণে ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সদস্যরা একসময় মনে করতেন, আসরে আফজাল থাকলে ভয়ের কারণ নেই।
ওই অভিযোগে আরও বলা হয়, আফজালের ছোট ভাই এবং বাজিতপুর পৌর মেয়র আনোয়ার হোসেন আশরাফ হঠাৎ তাঁর ব্যবসা ছেড়ে ইয়াবা কারবারে ঢুকে পড়েন। ইয়াবা কারবারের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে তাকে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হতো, হয়রানিমূলক মামলাও করা হতো। অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের কাছে আফজাল শতকোটি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকসংক্রান্ত একটি নিউজ শেয়ার দেন। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাঁকে।
বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি এহসান বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে চিহ্নিত যে কটি উপজেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল, তার মধ্যে বাজিতপুর অন্যতম। তারা দুই ভাই এই রাজত্ব গড়ে তুলেছে। এমন কোনো অপকর্ম নেই যে তারা করেনি।’
এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক এমপি আফজাল হোসেনের মোবাইল ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায় এবং তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
দুদক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ইকবাল হোসাইন বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা দুদক কার্যালয়ে আফজাল হোসেনের ব্যাপারে কোনো ফাইল ওপেন হয়নি। এই বিষয়ে হেড অফিস বলতে পারবে। আর তাঁর ভাই আশরাফের দুটি ফাইল ছিল। একটা হলো তাঁর সম্পদের, আরেকটা ছিল অর্থ আত্মসাতের। আশরাফের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটিতে এখনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, আইনগত কাজ চলমান।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে