বন্যা পরিস্থিতি: বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৮: ৩২
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৮: ৪১

চারদিকে পানি আর পানি। ডুবেছে বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের নলকূপগুলো। ফলে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে। দেশের সব প্রান্ত থেকে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ যাচ্ছে; কিন্তু পৌঁছাচ্ছে না বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে। ফলে পানি ও খাদ্যসংকটে এ মানুষগুলো রয়েছেন প্রচণ্ড কষ্টে। বিদ্যুৎ না থাকায় এবং মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে সমস্যার কারণে কষ্ট আরও বেড়েছে তাঁদের। 

এদিকে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। কুমিল্লায় গতকাল রোববার তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অবশ্য মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। 

বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার
ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের ১১টি জেলা এখন বন্যাকবলিত। নতুন করে আর কোনো জেলা আক্রান্ত হয়নি। সারা দেশ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণও যাচ্ছে। তবে এসব ত্রাণসহায়তার মধ্যে সিংহ ভাগই শুকনো খাবার, ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পোশাক।

সুপেয় পানির পরিমাণ সে তুলনায় অপ্রতুল। এসব সহায়তা আবার গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না।

উপদ্রুত এলাকার নলকূপগুলো কয়েক দিন ধরে পানির নিচে। ফলে প্রত্যন্ত এলাকার বানভাসি মানুষগুলো খাদ্য ও পানির ব্যাপক সংকটে পড়েছেন। 

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার যাদৈয়া এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘চারদিকে শুধু পানি আর পানি। কোথাও বের হওয়ার মতো অবস্থা নেই। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শিশুসন্তানসহ বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে আছি।’ 

রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে তিন ট্রাক ত্রাণ নিয়ে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ভরসা এলাকায় গিয়েছিলেন একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ত্রাণ দিতে গিয়ে তাঁরাও পড়েছেন বেকায়দায়। সুজন আহম্মেদ রনি নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘নৌকা বা স্পিডবোট ছাড়া গ্রামে যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা তো নৌকা আনিনি। এখানে কোনো ব্যবস্থাও নেই। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের বানভাসিদের ত্রাণ দিতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ডাঙায় যাঁরা তাঁবুতে ছিলেন, তাঁদের ত্রাণ দিয়ে চলে আসতে হলো।’ 

ওই শিক্ষার্থীদের মতো এমন বেকায়দায় পড়েছেন ত্রাণ দিতে যাওয়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি। সড়কে আশ্রয় নেওয়া বুড়িচংয়ের বুড়বুড়িয়া নদীভাঙন এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল ভূইয়া বলেন, ‘বন্যাকবলিত যাঁরা পাড়ে বা ডাঙায় আছেন, সবাই তাঁদের ত্রাণ দেন। যেখানে বেশি পানি, সেখানে মানুষ যেতে পারছেন না। পানিবন্দী অনেকে না খেয়ে আছেন। আমাদের যে খাবার আছে, তাতে আরও ছয় দিন চলবে। তারপরও আমাদেরই দেয়। গ্রামের মানুষের না আছে খাবার, না আছে পানি।’ 

গতকাল সকাল থেকে বুড়িচংয়ের বন্যাকবলিত বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, একের পর এক ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান, রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বানভাসি মানুষকে সহায়তা দিতে ছুটে আসছেন বিভিন্ন স্থানের মানুষ। তবে নৌযান-সংকটে প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে পারছেন তাঁরা। ওই সব এলাকায় নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও পয়োনিষ্কাশন। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন দুর্গতরা। 

লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর বন্যাকবলিত গ্রামীণ এলাকার পানিবন্দী মানুষেরাও খাবার-পানির সংকটে দিন পার করছেন। লক্ষ্মীপুরে অন্তত ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দী। 

স্থানীয় এলাকাবাসী ও জেলা প্রশাসন সূত্র বলেছে, ২০ বছরের মধ্যে এমন বন্যা লক্ষ্মীপুরের মানুষ দেখেননি। কোথাও কোথাও ৪ থেকে ৬ ফুট পানি। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছেন। গত শুক্রবার বিকেল থেকে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। ত্রাণের যে সরবরাহ আসছে, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। নৌযান-সংকটের কারণে এখানেও গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। ওই সব এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। এতে করে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। 

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামসহ অন্যান্য উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অবনতি ঘটেছে নাঙ্গলকোটে। এদিকে এ জেলায় গতকাল পানিতে ডুবে তিন শিক্ষার্থীসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। 

নাঙ্গলকোট উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে এখন পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষ। এই উপজেলায় গতকাল দুপুর থেকে পানি বাড়ছে। সাতবাড়িয়া এলাকার কলেজশিক্ষার্থী সেলিনা সুলতানা নিশীতা বলেন, ‘সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন উপজেলার সবচেয়ে নিচু এলাকা। এই ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ কয়েকদিন ধরে অর্ধাহার-অনাহারে দিন পার করছেন। কোনো ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। 

তবে এখন সঙ্গিন অবস্থা লক্ষ্মীপুরের মানুষের। রাতভর বৃষ্টি আর ফেনী ও নোয়াখালী থেকে ধেয়ে আসা পানির তোড়ে এই জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। অন্তত ৮ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। স্থানীয় এলাকাবাসী ও জেলা প্রশাসন সূত্র বলেছে, দুদিন ধরে ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী ও ডাকাতিয়া খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকছে। 

লক্ষ্মীপুরে রামগতি আবহাওয়া সতর্কীকরণ অফিসের কর্মকর্তা সৌরভ হোসেন বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৭০ মিলিমিটার। বন্যার অবনতি হচ্ছে। বৃষ্টি আরও কয়েকদিন থাকবে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। 

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ-উজ-জামান বলেন, ‘দুদিন ধরে পানি বাড়ছে। বিশেষ করে গত ২৪ ঘণ্টায় কোথাও ১ ফুট, আবার কোথাও ২ ফুট পানি বেড়েছে। মজুচৌধুরীর হাটের স্লুইসগেটের সব দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে।’ 

নোয়াখালী ও ফেনীর পানি নামার জন্য কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর রেগুলেটরের ২৩টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে বৃষ্টির কারণে বন্যার পানি আরও বাড়ছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলেছে, ভারতের ত্রিপুরা থেকে উজানের ঢল আন্তসীমান্ত কাকড়ি ও ডাকাতিয়া নদী হয়ে ছোট ফেনী নদীর মুখে মুছাপুর ক্লোজার গেটের মাধ্যমে সন্দ্বীপ চ্যানেল হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। কাকড়ি নদীর পানি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের উজিরপুর ও কাশিনগর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডাকাতিয়ায় মিশছে। ডাকাতিয়া নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার বাগসারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং পরবর্তী সময়ে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি কুমিল্লা-লাকসাম-চাঁদপুর হয়ে মেঘনায় মিশেছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আমির ফয়সাল বলেন, গত ১৫ ঘণ্টায় নোয়াখালীতে ৪০ মিলিমিটার পানি কমেছে। আর ৩ ঘণ্টায় পানি কমেছে ১০ মিলিমিটার। অর্থাৎ পানি দ্রুতই কমে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাত কমলে এবং ক্লোজার দিয়ে পানি নামতে থাকলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্যার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। 

তবে ফেনী ও নোয়াখালীতে গত শনিবার রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। নোয়াখালী আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রোববার বেলা ৩টা পর্যন্ত জেলায় ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। 

মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে উন্নতি
মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকা কমলগঞ্জ, রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও সদর উপজেলা থেকে পানি দ্রুত কমছে। তবে বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার্তদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতাল ও সংগঠন বিনা মূল্যের মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করছে। 

হবিগঞ্জেও বন্যার পানি কমছে। ইতিমধ্যে অনেক বাসাবাড়ি ও সড়ক থেকে পানি নেমে গেছে। বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদ-নদীর পানি। অনেকে বাড়িঘরে ফিরতেও শুরু করেছেন। 

পার্বত্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
খাগড়াছড়িতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। সদর উপজেলার বেতছড়ি ছড়ার ওপর নির্মিত কালভার্টের মুখের সড়ক ধসে পড়েছে। এতে বেতছড়ি, বেতছড়ি মুখ, মারমাপাড়া, ইটছড়ি, দাঁতকুপ্যাসহ ৩০টি গ্রামের সঙ্গে খাগড়াছড়ি শহরের যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের বাঁধের ১৬টি জলকপাট গতকাল সকাল ৮টায় ৬ ইঞ্চি খুলে দেওয়ার ৬ ঘণ্টা পর বন্ধ করা হয়। এরপর পানির স্তর ফের বেড়ে গেলে দ্বিতীয় দফায় সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় জলকপাটগুলো ফের ৪ ইঞ্চি খুলে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এ টি এম আব্দুজ্জাহের। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত