ময়লা-আবর্জনায় বাড়ছে পানিবাহিত রোগ

ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট
Thumbnail image

‘ফানি খাইলিছিল রে বাবা। হুড়োতা (ছোট) মানুষ, খইলেও হুনে না। ওখন তো খালি পাতলা পায়খানা ওয়রো (হচ্ছে)। ডাখতারে (ডাক্তারে) খইছে অবস্থা ভালা না। আইসিইউত ভর্তি খরার লাগি। ওত ট্যাখা পাইতাম খই। ফাইন্নে সবতা ভাসাইয়া লইয়া গেছেগি। খাইয়া ওই বাঁচতাম ফারতাম না।’

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচতলার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় বসে এভাবেই বলছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর গ্রামের সালমা বেগম। ডায়রিয়া হওয়ায় তাঁর ১৪ বছরের ছেলে রাহেলকে গতকাল শনিবার এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সিলেট নগরীর উপশহরের বাসিন্দা রমিজ আলী তাঁর দুর্দশার কথা তুলে ধরলেন এভাবে, ‘যেদিন বাসা পরিষ্কার করছি ওই দিন থেকেই সারা শরীর চুলকায়। বিভিন্ন জায়গায় ফুসকা উঠের। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে থাকা যাচ্ছে না।’

সালমা-রমিজদের মতো অবস্থা বন্যাকবলিত এলাকার অধিকাংশ মানুষের। কয়েক দিন ধরে সুনামগঞ্জ-সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বটে। কিন্তু বানের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে নতুন নতুন বিপদও দেখা দিচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ছে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। ডায়রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চর্মরোগসহ নানা পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। বিশুদ্ধ পানির সংকট, আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে বসবাস, ময়লা-আবর্জানাযুক্ত পানির সংস্পর্শে যাওয়ায় এসব রোগের প্রকোপ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দু-তিন দিন ধরে আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও বাস্তব চিত্র পুরোপুরি উল্টো। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে নামার পর থেকেই সেনাবাহিনীর ২৩টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বন্যাদুর্গত এলাকায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৩টি মেডিকেল টিমের প্রধান কর্নেল ডা. ইরতাকা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী পাচ্ছি ডায়রিয়া, পাতলা পায়খানা, চুলকানি, সর্দি-কাশি, জ্বর এবং কাটাছেঁড়ার। চোখ ওঠার (প্রদাহ) রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের ২৩টি টিম গড়ে প্রতিদিন ৫-৬ হাজার মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা, পচা দুর্গন্ধ, অপরিষ্কার পানি থেকে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে থাকায় এসব রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।’

গতকাল দুপুরে সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মূল সড়কগুলো থেকে পানি নেমে গেলেও পাড়া-মহল্লার ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে আছে। এসব পানিতে ময়লা জমে কালো রং ধারণ করেছে। বাসিন্দারা এসব পানি মাড়িয়েই চলাফেরা করছে। এ ছাড়া নগরীর ছড়া, খালগুলো ময়লা-আবর্জনা পড়ে পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। নগরীর প্রায় সবগুলো ছড়া-খালে পানির ওপর ময়লা-আবর্জনা ভেসে থাকতে দেখা যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সিলেট জেলায় ডায়রিয়ায় ৩৯ জন, সুনামগঞ্জ জেলায় ১০৩ জন, হবিগঞ্জ জেলায় ৫৪ জন ও মৌলভীবাজার জেলায় ৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আরটিআইয়ে ১৭, চোখের প্রদাহে ১০ জন, আঘাতপ্রাপ্ত ১৯ জন ও অন্যান্য ১২৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। 
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বন্যার পর থেকে এ পর্যন্ত এ বিভাগে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ মিলিয়ে মোট আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ১৮৮ জন। এর মধ্যে সিলেটে সর্বোচ্চ, ২ হাজার ৫৫২ জন, সুনামগঞ্জে সর্বনিম্ন ১ হাজার ১৫২ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর বাইরে হবিগঞ্জে ১ হাজার ৯২৭ জন ও মৌলভীবাজারে ১ হাজার ৫৫২ জন আক্রান্ত হয়েছে।

সিলেটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডায়রিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ভর্তি ছাড়াও হাসপাতালের বহির্বিভাগে বিপুলসংখ্যক লোক ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির পর সিলেটে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। ডায়রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চর্মরোগসহ নানা পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। 

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নগরীর বন্যাকবলিত এলাকায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে নগরীতে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত