আজকের পত্রিকা: বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার এত বছর পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে?
যতীন সরকার: বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকে মনে করেন, মায়ের ভাষাই হলো মাতৃভাষা। কিন্তু কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। মাতৃভাষা হলো মাতৃস্বরূপিণী ভাষা। যে ভাষা নিজেই মা; মানে আমরা মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করি, তারপর মানুষ হই ভাষার সাহায্যে। যে ভাষার সাহায্যে আমি মানুষ হলাম, সেই ভাষাটাই হলো মাতৃস্বরূপিণী ভাষা।
আমার জন্ম বাংলাদেশে। এখন আমার মায়ের ভাষা বাংলা। আমাকে যদি ছোটবেলায় অন্য ভাষাভাষী কোনো জায়গায় রাখা হতো, তাহলে সেই ভাষাই আমার মাতৃভাষা হতো। অনেকে বিষয়টা এভাবে বুঝতে চায় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একটি অপরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাম, যার নাম পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতা জিন্নাহ বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
আমি কিন্তু অনেক সময় বলি, জিন্নাহর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তিনি ভাষার প্রশ্ন সামনে এনে আমাদের আত্মসমীক্ষা জাগিয়ে তুললেন। আমরা সেই দিনই মনে করলাম, আমাদের ভাষার ওপর যে আঘাতটা আসছে, সেটা আসলে আমাদের বাঙালি সত্তার ওপর আঘাত। সেই আঘাত প্রতিহত করতে হলে আমাদের আন্দোলনে নেমে পড়তে হবে। সেই আন্দোলনে নেমে পড়ার কারণে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেয়েছিল। এর অনেক দিন পর আমরা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলাম।
স্বাভাবিকভাবে কাগজে-কলমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু বাংলাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা দেখছি, দেশ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছেয়ে গেছে। যাদের একটু আর্থিক সংগতি আছে, তারাই তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায়। ইংরেজি জানলে প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায়—এ রকম একটা ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে।
কিন্তু আসলে কি তাই? আমরা এমন কতগুলো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, যেগুলো কার্যত বাংলা শব্দই হয়ে গেছে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ইউনিভার্সিটিই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ অন্তর্ভুক্ত হওয়া দোষের কিছু নয়। এটা আমাদের ভাষার ক্ষতি করে না; বরং ভাষার উন্নতি সাধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আজকের পত্রিকা: ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
যতীন সরকার: প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজের মাতৃভাষায় কথা বলা ও লেখাপড়া করার অধিকার আছে। আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল বলেই আমরা সেদিন বিদ্রোহ করেছিলাম। সেই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। সেই রাষ্ট্রে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষও আছে। সেই জাতিসত্তার মানুষগুলোর যে ভাষা-সংস্কৃতি, তাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, যাতে সেই ভাষাভাষীর মানুষগুলো নিজেদের ভাষায় লেখাপড়া করতে পারে, কথা বলতে পারে। সত্যিকার অর্থে আমরা বাঙালিরা যেভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছি, সেভাবে প্রতিষ্ঠা যেন হতে পারে অন্য ভাষাভাষীর মানুষ, সেটা আমাদের কামনা। কিন্তু সেই কাম্য অবস্থাটা আমরা ঠিক তৈরি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।
আমাদের দেশে আরও যেসব ভাষা আছে, সেগুলোর প্রতি বাংলা ভাষাভাষীদের নজর দেওয়া উচিত। কারণ, আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমরা যদি অন্য ভাষার চর্চায় সহযোগিতা না করি, তাহলে অপরাধ করব। যে অপরাধ পাকিস্তানিরা করেছিল।
আসলে মাতৃভাষা সবার সমান অধিকার। যার যে মাতৃভাষা, সে তার মতো করে চর্চা করবে। এক ভাষাভাষী অন্য ভাষাভাষীদের সাহায্য করবে। বাঙালিদের বিশেষ দায়িত্ব পড়ে, বাংলা ছাড়া অন্য যেসব ভাষা আছে, সেই ভাষাগুলোর পরিচর্যায় সহায়তা করা। এই যে সহায়তার ব্যাপারটা, সেটা আমরা মোটেই করছি না।
আজকের পত্রিকা: অন্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি শেখায় তো বাধা নেই। আপনি কী মনে করেন?
যতীন সরকার: পাকিস্তান আমলে যখন বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি চেয়েছিলাম, তখন অন্য ভাষার আমরা বিরোধিতা করিনি। ইংরেজির সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ সময়ের সংশ্লিষ্টতা, সেই ইংরেজির মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা, সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ইংরেজি ভাষা আমরা অবশ্যই শিখব। ইংরেজি শেখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের যে অবস্থা, যারা ইংরেজি বেশি জানে, তারাই সমাজে ‘লায়েক’ হিসেবে পরিচিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইংরেজি শিখব কেন? ইংরেজি শিখব আমার ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। ইংরেজি থেকে পৃথিবীর অনেক বিষয় বাংলায় অনুবাদ করতে পারি এবং আমাদের দেশের অনেক বিষয় ইংরেজির মাধ্যমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারি।
কাজটা করা উচিত ছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। যেটা আমরা মোটেই করতে পারছি না। আমাদের বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান আছে। তারা কিছু কাজ করেছে। কিন্তু সেই কাজগুলো খুবই অকিঞ্চিৎকর। আমাদের দেশের চিন্তাগুলো বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা যদি এখনই শুরু না করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের পত্রিকা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা কম হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। পদ-পদবি পেতে শিক্ষকদের বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এ বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?
যতীন সরকার: বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ব্যঙ্গোক্তি আছে। ‘বিশ্বের বিদ্যা যেখানে লয় প্রাপ্ত হয়, সেটাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়।’ আমাদের জন্য তাঁর এই ব্যঙ্গোক্তিটা সত্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বিদ্যা আমরা সেভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতাও খুব অল্প। এই সচেতনতা বাড়ানো যাদের দায়িত্ব, সেই গোষ্ঠীকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। বুদ্ধিজীবীরা অতীতে আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু এখনকার যাঁরা বুদ্ধিজীবী আছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরাধিকার ও তাঁদের চেতনা বহনকারী হলেও, সেটা তাঁরা ভালোভাবে করতে পারছেন বলে আমি মনে করি না। তাই এ বিষয়ে তাঁদের বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। সেই সচেতনতার কাজটিও সচেতন বুদ্ধিজীবীদেরই করতে হবে। সে জন্য একটা জাগরণ ঘটাতে হবে। তার জন্য একটা আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে।
আজকের পত্রিকা: বুদ্ধিজীবীদের দলীয় রাজনীতি করার বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
যতীন সরকার: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বুদ্ধিজীবীরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মতামত পোষণ করবেন। তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের বৈচিত্র্য থাকবে, সেটাই কাম্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই বৈচিত্র্যের চেয়ে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বুদ্ধি বিক্রি করার কৌশল আয়ত্ত করা। কীভাবে বুদ্ধি বিক্রি করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়, সেটাই এখন হচ্ছে।
আমাদের অনেকেই বুদ্ধি বিক্রি করতে পছন্দ করছি। বিভিন্ন দলীয় চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করে, সেটার ওপর সব ভার অর্পণ করেছি। এ কাজটা মোটেই বিবেকসম্মত নয় বলেই মনে করি। দলীয় বুদ্ধিজীবিতা থেকে বুদ্ধিজীবীদের বের করার জন্যও একটা জাগরণ ঘটাতে হবে। এটা ঘটবে কীভাবে? বর্তমানে আমাদের যে রাষ্ট্র স্বাধীন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম যে কারণে, সেটা আমরা এখনো দূর করতে পারিনি; বরং নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন আমরা একটা রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি। ইসলাম আমাদের রাষ্ট্রধর্ম। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে। এটা আসলে খাতির করার ব্যাপার নয়। এ ব্যাপারটা কোনোভাবেই সঠিক নয়। একদিকে রাষ্ট্রধর্ম বজায় রাখা, অন্যদিকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখাটা বড় ধরনের গোঁজামিলের শামিল।
আজকের পত্রিকা: অতীতে আমরা দেখেছি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি—দুটি একসঙ্গে সমন্বিত হয়ে এগিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। এটাকে আপনি কি একটা বড় স্খলন হিসেবে মনে করেন?
যতীন সরকার: অবশ্যই এটা একটা স্খলন। কিন্তু এটা কেন হলো, সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। হাঙ্গেরির মার্ক্সবাদী দার্শনিক লুকাস বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। রাজনীতি হচ্ছে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটা উপায় মাত্র।’ কিন্তু আমরা মূলটাকে দ্বিতীয় করে ফেলেছি। আমরা রাজনীতি করি, কিন্তু রাজনীতির যে মূল উদ্দেশ্য সংস্কৃতিকে বিকশিত করা, যার জন্য আমরা বিভিন্ন আন্দোলনে করেছি; কিন্তু সেই আন্দোলন আমরা সফল করতে পারিনি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই যে রাজপথে রাজনৈতিক আন্দোলন সফল হয়ে ওঠে, অতীতে তা আমরা দেখেছি। এখনো আবার সংস্কৃতিকেই মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে অগ্রসর হতে হবে।
আজকের পত্রিকা: বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার এত বছর পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে?
যতীন সরকার: বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকে মনে করেন, মায়ের ভাষাই হলো মাতৃভাষা। কিন্তু কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। মাতৃভাষা হলো মাতৃস্বরূপিণী ভাষা। যে ভাষা নিজেই মা; মানে আমরা মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করি, তারপর মানুষ হই ভাষার সাহায্যে। যে ভাষার সাহায্যে আমি মানুষ হলাম, সেই ভাষাটাই হলো মাতৃস্বরূপিণী ভাষা।
আমার জন্ম বাংলাদেশে। এখন আমার মায়ের ভাষা বাংলা। আমাকে যদি ছোটবেলায় অন্য ভাষাভাষী কোনো জায়গায় রাখা হতো, তাহলে সেই ভাষাই আমার মাতৃভাষা হতো। অনেকে বিষয়টা এভাবে বুঝতে চায় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একটি অপরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাম, যার নাম পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতা জিন্নাহ বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
আমি কিন্তু অনেক সময় বলি, জিন্নাহর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তিনি ভাষার প্রশ্ন সামনে এনে আমাদের আত্মসমীক্ষা জাগিয়ে তুললেন। আমরা সেই দিনই মনে করলাম, আমাদের ভাষার ওপর যে আঘাতটা আসছে, সেটা আসলে আমাদের বাঙালি সত্তার ওপর আঘাত। সেই আঘাত প্রতিহত করতে হলে আমাদের আন্দোলনে নেমে পড়তে হবে। সেই আন্দোলনে নেমে পড়ার কারণে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেয়েছিল। এর অনেক দিন পর আমরা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলাম।
স্বাভাবিকভাবে কাগজে-কলমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু বাংলাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা দেখছি, দেশ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছেয়ে গেছে। যাদের একটু আর্থিক সংগতি আছে, তারাই তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায়। ইংরেজি জানলে প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায়—এ রকম একটা ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে।
কিন্তু আসলে কি তাই? আমরা এমন কতগুলো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, যেগুলো কার্যত বাংলা শব্দই হয়ে গেছে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ইউনিভার্সিটিই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ অন্তর্ভুক্ত হওয়া দোষের কিছু নয়। এটা আমাদের ভাষার ক্ষতি করে না; বরং ভাষার উন্নতি সাধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আজকের পত্রিকা: ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
যতীন সরকার: প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজের মাতৃভাষায় কথা বলা ও লেখাপড়া করার অধিকার আছে। আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল বলেই আমরা সেদিন বিদ্রোহ করেছিলাম। সেই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। সেই রাষ্ট্রে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষও আছে। সেই জাতিসত্তার মানুষগুলোর যে ভাষা-সংস্কৃতি, তাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, যাতে সেই ভাষাভাষীর মানুষগুলো নিজেদের ভাষায় লেখাপড়া করতে পারে, কথা বলতে পারে। সত্যিকার অর্থে আমরা বাঙালিরা যেভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছি, সেভাবে প্রতিষ্ঠা যেন হতে পারে অন্য ভাষাভাষীর মানুষ, সেটা আমাদের কামনা। কিন্তু সেই কাম্য অবস্থাটা আমরা ঠিক তৈরি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।
আমাদের দেশে আরও যেসব ভাষা আছে, সেগুলোর প্রতি বাংলা ভাষাভাষীদের নজর দেওয়া উচিত। কারণ, আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমরা যদি অন্য ভাষার চর্চায় সহযোগিতা না করি, তাহলে অপরাধ করব। যে অপরাধ পাকিস্তানিরা করেছিল।
আসলে মাতৃভাষা সবার সমান অধিকার। যার যে মাতৃভাষা, সে তার মতো করে চর্চা করবে। এক ভাষাভাষী অন্য ভাষাভাষীদের সাহায্য করবে। বাঙালিদের বিশেষ দায়িত্ব পড়ে, বাংলা ছাড়া অন্য যেসব ভাষা আছে, সেই ভাষাগুলোর পরিচর্যায় সহায়তা করা। এই যে সহায়তার ব্যাপারটা, সেটা আমরা মোটেই করছি না।
আজকের পত্রিকা: অন্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি শেখায় তো বাধা নেই। আপনি কী মনে করেন?
যতীন সরকার: পাকিস্তান আমলে যখন বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি চেয়েছিলাম, তখন অন্য ভাষার আমরা বিরোধিতা করিনি। ইংরেজির সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ সময়ের সংশ্লিষ্টতা, সেই ইংরেজির মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা, সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ইংরেজি ভাষা আমরা অবশ্যই শিখব। ইংরেজি শেখার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের যে অবস্থা, যারা ইংরেজি বেশি জানে, তারাই সমাজে ‘লায়েক’ হিসেবে পরিচিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ইংরেজি শিখব কেন? ইংরেজি শিখব আমার ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। ইংরেজি থেকে পৃথিবীর অনেক বিষয় বাংলায় অনুবাদ করতে পারি এবং আমাদের দেশের অনেক বিষয় ইংরেজির মাধ্যমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারি।
কাজটা করা উচিত ছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। যেটা আমরা মোটেই করতে পারছি না। আমাদের বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান আছে। তারা কিছু কাজ করেছে। কিন্তু সেই কাজগুলো খুবই অকিঞ্চিৎকর। আমাদের দেশের চিন্তাগুলো বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা যদি এখনই শুরু না করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
আজকের পত্রিকা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা কম হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। পদ-পদবি পেতে শিক্ষকদের বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এ বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?
যতীন সরকার: বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ব্যঙ্গোক্তি আছে। ‘বিশ্বের বিদ্যা যেখানে লয় প্রাপ্ত হয়, সেটাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়।’ আমাদের জন্য তাঁর এই ব্যঙ্গোক্তিটা সত্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বিদ্যা আমরা সেভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতাও খুব অল্প। এই সচেতনতা বাড়ানো যাদের দায়িত্ব, সেই গোষ্ঠীকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। বুদ্ধিজীবীরা অতীতে আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু এখনকার যাঁরা বুদ্ধিজীবী আছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরাধিকার ও তাঁদের চেতনা বহনকারী হলেও, সেটা তাঁরা ভালোভাবে করতে পারছেন বলে আমি মনে করি না। তাই এ বিষয়ে তাঁদের বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। সেই সচেতনতার কাজটিও সচেতন বুদ্ধিজীবীদেরই করতে হবে। সে জন্য একটা জাগরণ ঘটাতে হবে। তার জন্য একটা আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে।
আজকের পত্রিকা: বুদ্ধিজীবীদের দলীয় রাজনীতি করার বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
যতীন সরকার: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বুদ্ধিজীবীরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মতামত পোষণ করবেন। তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের বৈচিত্র্য থাকবে, সেটাই কাম্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই বৈচিত্র্যের চেয়ে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বুদ্ধি বিক্রি করার কৌশল আয়ত্ত করা। কীভাবে বুদ্ধি বিক্রি করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়, সেটাই এখন হচ্ছে।
আমাদের অনেকেই বুদ্ধি বিক্রি করতে পছন্দ করছি। বিভিন্ন দলীয় চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করে, সেটার ওপর সব ভার অর্পণ করেছি। এ কাজটা মোটেই বিবেকসম্মত নয় বলেই মনে করি। দলীয় বুদ্ধিজীবিতা থেকে বুদ্ধিজীবীদের বের করার জন্যও একটা জাগরণ ঘটাতে হবে। এটা ঘটবে কীভাবে? বর্তমানে আমাদের যে রাষ্ট্র স্বাধীন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম যে কারণে, সেটা আমরা এখনো দূর করতে পারিনি; বরং নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন আমরা একটা রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি। ইসলাম আমাদের রাষ্ট্রধর্ম। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে। এটা আসলে খাতির করার ব্যাপার নয়। এ ব্যাপারটা কোনোভাবেই সঠিক নয়। একদিকে রাষ্ট্রধর্ম বজায় রাখা, অন্যদিকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখাটা বড় ধরনের গোঁজামিলের শামিল।
আজকের পত্রিকা: অতীতে আমরা দেখেছি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি—দুটি একসঙ্গে সমন্বিত হয়ে এগিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। এটাকে আপনি কি একটা বড় স্খলন হিসেবে মনে করেন?
যতীন সরকার: অবশ্যই এটা একটা স্খলন। কিন্তু এটা কেন হলো, সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। হাঙ্গেরির মার্ক্সবাদী দার্শনিক লুকাস বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। রাজনীতি হচ্ছে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটা উপায় মাত্র।’ কিন্তু আমরা মূলটাকে দ্বিতীয় করে ফেলেছি। আমরা রাজনীতি করি, কিন্তু রাজনীতির যে মূল উদ্দেশ্য সংস্কৃতিকে বিকশিত করা, যার জন্য আমরা বিভিন্ন আন্দোলনে করেছি; কিন্তু সেই আন্দোলন আমরা সফল করতে পারিনি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই যে রাজপথে রাজনৈতিক আন্দোলন সফল হয়ে ওঠে, অতীতে তা আমরা দেখেছি। এখনো আবার সংস্কৃতিকেই মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে অগ্রসর হতে হবে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে