জাহীদ রেজা নূর
এরা পরিচালিত হয় লোভ দিয়ে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পত্তি দখল করতে পারলেই তো হলো। এ জন্য কোনো ধর্মীয় বাণীর প্রয়োজন হয় না, ধর্মীয় নেতাদের বিচক্ষণ আলোচনা কোনো কাজে লাগে না, শুধু হৃদয়ে লোভ-হিংসা-ঈর্ষা আর ঘৃণা পুষে রাখতে পারলেই চলে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া হলেই এটা ঘটে।
দেশের কিছু কিছু মুসলমানের হলো কী? তাদের চেতনা তো দেখা যাচ্ছে ‘অবমাননা’য় ঘেরা। কেউ একটু উসকানি দিলেই তারা সবখানে ধর্মের অবমাননা দেখছে। ঘটনা যাচাই-বাছাই না করে, কোনো ধরনের যুক্তি দিয়ে না বুঝে, ‘কান নিয়েছে চিলে’ শুনেই কান আছে কি নেই, সেটা না দেখে চিলের পেছনে ছুটে বেড়ানোই তাদের কাজ হয়ে উঠেছে। আর উসকানির মুখে কিছু কিছু মানুষ বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের সাজানো ফাঁদে পা দিচ্ছে। যেকোনো সময়ই তাৎক্ষণিক আবেগের বশে উত্তেজিত হয়ে সহিংসতা চালানোর এই অপচেষ্টা কি বন্ধ হবে না?
দুর্গাপূজার সময় দেবীমূর্তি ভাঙচুর কিংবা সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ, হত্যা যেন প্রতিবছরের রুটিন হয়ে গেছে। পূজার সময় কাছে এলেই সনাতন ধর্মের মানুষেরা উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কায়ও ভোগেন এখন। এ যেন তাঁদের ললাটলিখন। যে স্বাধীন রাষ্ট্রটি গড়ে তোলা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, তার অন্যতম বিষয় ছিল ধর্মের নামে শোষণ চালানো যাবে না। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কী হবে, তা নিয়ে আমাদের সংবিধানে বিস্তারিত লেখা রয়েছে, শুধু কী কারণে একজন সামরিক সরকারপ্রধানের মদদে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখা হয়েছে এবং কী কারণে তা সংবিধান থেকে অপসারিত হচ্ছে না, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই আসলে বোঝা যাবে, বাংলাদেশ তার মূল জায়গা থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে সরে গেল।
ইতিহাসবিমুখ লোকজনকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, ১৯৪৭ সালের প্রবল ধর্মীয় উন্মাদনার রেশ ধূসর হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। যাঁরা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তান এনেছিলেন, তাঁরাই ১৯৪৮ সাল থেকে বুঝতে পারছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গরমিলটা। লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে সংগতিহীন একটিমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র তৈরি করাটাও যে ছিল একটা চক্রান্তের অংশ, সেটা বুঝতে দেরি করেছে বাঙালি এবং সেই ভুলের মাশুল তাকে দিতে হয়েছে বছরের পর বছর বুকের রক্ত দিয়ে। বছরের পর বছর পাঞ্জাবিদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার শিকার হয়ে। এই ধর্মভীরু বাঙালি সন্তানেরা পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন, পড়লে বুঝতে পারবেন, তারা বাঙালি মুসলমানকে ‘আতরাফ’ বলে গণ্য করত। বাঙালি মুসলমান মানেই হিন্দুয়ানির ছাপ মারা—এ কথাই তারা ছড়াত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে।
ভাষাভিত্তিক আন্দোলন শুরু হওয়ার পরই কেবল বাঙালি মুসলমান বুঝতে শুরু করল, সে বাঙালি হয়েও হতে পারে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান। যেমন বাঙালি হয়েও সে হতে পারে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা। এগুলো হতে গেলে সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি পরিচয়কে উহ্য রাখার কোনো দরকার নেই। এ নিয়ে বাদানুবাদ বহু হয়েছে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় এই ভূখণ্ডের মানুষ সত্যিই উপলব্ধি করেছিল, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’ সেই পথরেখা ধরেই এ দেশে চলমান বামপন্থী, ইসলামি এবং জাতীয়তাবাদী তিনটি ধারার মধ্যে জনমনে ঠাঁই করে নিয়েছিল জাতীয়তাবাদী ধারা। নানা রকম রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় একসময় শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা। যে ধারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেটি ছিল পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক।
জাতির অসাম্প্রদায়িক পরিচয় বলতে বোঝানো হয়েছে, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। প্রতিটি মানুষ তার নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে কোনো বাধা ছাড়াই। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, হিন্দুদের তথা ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু যেকোনো সম্প্রদায়ের জমি, সম্পত্তি ইত্যাদি দখল করার সময় একজোট হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নধারার লোকেরা। হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যে মুসলমানদের মতোই এ দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক, সে কথা কি এই মতলববাজেরা জানে না? খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু এরা পরিচালিত হয় লোভ দিয়ে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পত্তি দখল করতে পারলেই তো হলো। এ জন্য কোনো ধর্মীয় বাণীর প্রয়োজন হয় না, ধর্মীয় নেতাদের বিচক্ষণ আলোচনা কোনো কাজে লাগে না, শুধু হৃদয়ে লোভ-হিংসা-ঈর্ষা আর ঘৃণা পুষে রাখতে পারলেই চলে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া হলেই এটা ঘটে।
বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। সবাই জানেন, এ হলো একটি রাষ্ট্রের মানুষের বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়ার মহা ফল। কয়েকটি প্রশ্ন আসছে মনে, সেগুলোর উত্থাপন করেই আজ এ বিষয়ে কথা শেষ করব। আসলে প্রশ্নগুলো করব ভাবনার রাস্তাটা পরিষ্কার করার জন্য। বিবেক আর হৃদয়জুড়ে যে শেওলার জন্ম হয়েছে, সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করাটাই লক্ষ্য।
প্রশ্নগুলো হলো:
১. অসাম্প্রদায়িক দেশটি কী করে এ রকম সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত হলো? (টীকা, রাজনৈতিক দলগুলোয় কি অসাম্প্রদায়িকতার বাণী প্রচারের কোনো অবকাশ আছে? তাদের সদস্যরা কি অন্য ধর্মের মানুষদের সম্মান করেন? পরিবারে কি ধর্মসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া হয়? স্কুলে কি ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান ঘোচানো হয়েছে?)
২. একটি দেশে লোকজ সংস্কৃতি ধ্বংস করে কীভাবে ওয়াজ সংস্কৃতি সর্বত্র জায়গা করে নিল? (টীকা, ধর্মের বাণী ব্যাখ্যা করার জন্য ওয়াজ হলে তাতে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যেসব ওয়াজ হয়, তার অনেকগুলোতেই নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের পাশাপাশি অন্য ধর্মকে হেয় করার অপচেষ্টা হয়। কোরআন-হাদিসে যা নেই, তা-ও ব্যাখ্যা করে প্রচার করা হয়। করোনার সময় ইহুদি-নাসারাদের গাল দিয়ে যেসব ওয়াজ হয়েছে, সেগুলো লক্ষ করুন। দেখবেন, কতটা ঘৃণা হৃদয়ে পুষে এরা ধর্মদরদি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চায়! আর এরই সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাউলদের চুল কেটে দেওয়ার মতো ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে কেউ কেউ। যাত্রাপালা যেন হতে না পারে, সে জন্য সামাজিকভাবে ষড়যন্ত্র করেছে।)
৩. সুফি ভাবধারার জায়গায় কট্টর মুসলিম ভাবধারার অনুপ্রবেশ। (টীকা, এ দেশে দুভাবে ইসলাম ঢুকেছে। সুফিরা এসেছিলেন সহজিয়া ধারায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীনতার বাণী নিয়ে, নৃপতিরা এসেছিলেন তলোয়ার হাতে। মূলত এই অঞ্চলের দরিদ্র হিন্দু ও বৌদ্ধরাই ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বাণীকে বরণ করে নিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও তাঁদের আচরিত জীবনযাত্রায় খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক প্রায় ছিলই না। একই গ্রামে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মিলেমিশেই থাকতেন। অভাব তাঁদের একাত্ম করত। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হঠাৎ করে বাঙালি মুসলমান ভাবতে শুরু করল, তারাই একসময় এ দেশটা চালিয়েছে। সেই সুখের সন্ধানে ব্যাপৃত হলো তারা। অথচ আগে কখনোই নিজেদের শাসক বলে ভাবেনি আম-মুসলমান। এই রাজনৈতিক ইসলামই ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়েছে। স্বাধিকার আন্দোলনের সময় তা স্তিমিত হয়ে আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর পেছনে একটা বড় কারণ–পেট্রো ডলার। সৌদি ডলারের পাশাপাশি সেখানকার কট্টর ইসলাম এসে আমাদের সুফি ইসলামকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর ধর্মের মানবতার জায়গায় নিষ্ঠুরতাই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।)।
এই হলো আইসবার্গের চূড়া। আরও অনেক কারণ আছে, যেগুলো নিয়েও আলোচনা হতে হবে এবং এই অপরিষ্কার জায়গাগুলো পরিষ্কার না করলে প্রতিবছরই কুমিল্লা, রংপুর, নোয়াখালীর মতো পুরো দেশটাতেই শোনা যাবে হায়েনার হাসি, দেখা যাবে শকুনের বিচরণ।
যারা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশটাকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের এমন শাস্তি হতে হবে, যা দেখে পরবর্তীকালে আর কেউ এই উসকানি দিতে সাহস না পায়।
এবার অন্য আরেকটি প্রশ্ন, সরাসরি সরকারের কাছে: আমরা যখন প্রতিবছরই দেখে আসছি, একশ্রেণির বদমাশ পবিত্র ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে থাকে, সাধারণ মুসলমানকে উসকে দিতে পারে, তাহলে কেন আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগে থেকেই সচেতন হতে বলি না? কেন ভাঙচুর, অবমাননা, হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হয়?
জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এরা পরিচালিত হয় লোভ দিয়ে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পত্তি দখল করতে পারলেই তো হলো। এ জন্য কোনো ধর্মীয় বাণীর প্রয়োজন হয় না, ধর্মীয় নেতাদের বিচক্ষণ আলোচনা কোনো কাজে লাগে না, শুধু হৃদয়ে লোভ-হিংসা-ঈর্ষা আর ঘৃণা পুষে রাখতে পারলেই চলে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া হলেই এটা ঘটে।
দেশের কিছু কিছু মুসলমানের হলো কী? তাদের চেতনা তো দেখা যাচ্ছে ‘অবমাননা’য় ঘেরা। কেউ একটু উসকানি দিলেই তারা সবখানে ধর্মের অবমাননা দেখছে। ঘটনা যাচাই-বাছাই না করে, কোনো ধরনের যুক্তি দিয়ে না বুঝে, ‘কান নিয়েছে চিলে’ শুনেই কান আছে কি নেই, সেটা না দেখে চিলের পেছনে ছুটে বেড়ানোই তাদের কাজ হয়ে উঠেছে। আর উসকানির মুখে কিছু কিছু মানুষ বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের সাজানো ফাঁদে পা দিচ্ছে। যেকোনো সময়ই তাৎক্ষণিক আবেগের বশে উত্তেজিত হয়ে সহিংসতা চালানোর এই অপচেষ্টা কি বন্ধ হবে না?
দুর্গাপূজার সময় দেবীমূর্তি ভাঙচুর কিংবা সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ, হত্যা যেন প্রতিবছরের রুটিন হয়ে গেছে। পূজার সময় কাছে এলেই সনাতন ধর্মের মানুষেরা উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কায়ও ভোগেন এখন। এ যেন তাঁদের ললাটলিখন। যে স্বাধীন রাষ্ট্রটি গড়ে তোলা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, তার অন্যতম বিষয় ছিল ধর্মের নামে শোষণ চালানো যাবে না। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কী হবে, তা নিয়ে আমাদের সংবিধানে বিস্তারিত লেখা রয়েছে, শুধু কী কারণে একজন সামরিক সরকারপ্রধানের মদদে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখা হয়েছে এবং কী কারণে তা সংবিধান থেকে অপসারিত হচ্ছে না, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই আসলে বোঝা যাবে, বাংলাদেশ তার মূল জায়গা থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে সরে গেল।
ইতিহাসবিমুখ লোকজনকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, ১৯৪৭ সালের প্রবল ধর্মীয় উন্মাদনার রেশ ধূসর হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। যাঁরা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তান এনেছিলেন, তাঁরাই ১৯৪৮ সাল থেকে বুঝতে পারছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গরমিলটা। লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে সংগতিহীন একটিমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র তৈরি করাটাও যে ছিল একটা চক্রান্তের অংশ, সেটা বুঝতে দেরি করেছে বাঙালি এবং সেই ভুলের মাশুল তাকে দিতে হয়েছে বছরের পর বছর বুকের রক্ত দিয়ে। বছরের পর বছর পাঞ্জাবিদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার শিকার হয়ে। এই ধর্মভীরু বাঙালি সন্তানেরা পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন, পড়লে বুঝতে পারবেন, তারা বাঙালি মুসলমানকে ‘আতরাফ’ বলে গণ্য করত। বাঙালি মুসলমান মানেই হিন্দুয়ানির ছাপ মারা—এ কথাই তারা ছড়াত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে।
ভাষাভিত্তিক আন্দোলন শুরু হওয়ার পরই কেবল বাঙালি মুসলমান বুঝতে শুরু করল, সে বাঙালি হয়েও হতে পারে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান। যেমন বাঙালি হয়েও সে হতে পারে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা। এগুলো হতে গেলে সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি পরিচয়কে উহ্য রাখার কোনো দরকার নেই। এ নিয়ে বাদানুবাদ বহু হয়েছে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় এই ভূখণ্ডের মানুষ সত্যিই উপলব্ধি করেছিল, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’ সেই পথরেখা ধরেই এ দেশে চলমান বামপন্থী, ইসলামি এবং জাতীয়তাবাদী তিনটি ধারার মধ্যে জনমনে ঠাঁই করে নিয়েছিল জাতীয়তাবাদী ধারা। নানা রকম রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় একসময় শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা। যে ধারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেটি ছিল পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক।
জাতির অসাম্প্রদায়িক পরিচয় বলতে বোঝানো হয়েছে, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। প্রতিটি মানুষ তার নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে কোনো বাধা ছাড়াই। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, হিন্দুদের তথা ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু যেকোনো সম্প্রদায়ের জমি, সম্পত্তি ইত্যাদি দখল করার সময় একজোট হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নধারার লোকেরা। হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যে মুসলমানদের মতোই এ দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক, সে কথা কি এই মতলববাজেরা জানে না? খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু এরা পরিচালিত হয় লোভ দিয়ে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পত্তি দখল করতে পারলেই তো হলো। এ জন্য কোনো ধর্মীয় বাণীর প্রয়োজন হয় না, ধর্মীয় নেতাদের বিচক্ষণ আলোচনা কোনো কাজে লাগে না, শুধু হৃদয়ে লোভ-হিংসা-ঈর্ষা আর ঘৃণা পুষে রাখতে পারলেই চলে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া হলেই এটা ঘটে।
বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। সবাই জানেন, এ হলো একটি রাষ্ট্রের মানুষের বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়ার মহা ফল। কয়েকটি প্রশ্ন আসছে মনে, সেগুলোর উত্থাপন করেই আজ এ বিষয়ে কথা শেষ করব। আসলে প্রশ্নগুলো করব ভাবনার রাস্তাটা পরিষ্কার করার জন্য। বিবেক আর হৃদয়জুড়ে যে শেওলার জন্ম হয়েছে, সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করাটাই লক্ষ্য।
প্রশ্নগুলো হলো:
১. অসাম্প্রদায়িক দেশটি কী করে এ রকম সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত হলো? (টীকা, রাজনৈতিক দলগুলোয় কি অসাম্প্রদায়িকতার বাণী প্রচারের কোনো অবকাশ আছে? তাদের সদস্যরা কি অন্য ধর্মের মানুষদের সম্মান করেন? পরিবারে কি ধর্মসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া হয়? স্কুলে কি ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান ঘোচানো হয়েছে?)
২. একটি দেশে লোকজ সংস্কৃতি ধ্বংস করে কীভাবে ওয়াজ সংস্কৃতি সর্বত্র জায়গা করে নিল? (টীকা, ধর্মের বাণী ব্যাখ্যা করার জন্য ওয়াজ হলে তাতে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যেসব ওয়াজ হয়, তার অনেকগুলোতেই নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের পাশাপাশি অন্য ধর্মকে হেয় করার অপচেষ্টা হয়। কোরআন-হাদিসে যা নেই, তা-ও ব্যাখ্যা করে প্রচার করা হয়। করোনার সময় ইহুদি-নাসারাদের গাল দিয়ে যেসব ওয়াজ হয়েছে, সেগুলো লক্ষ করুন। দেখবেন, কতটা ঘৃণা হৃদয়ে পুষে এরা ধর্মদরদি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চায়! আর এরই সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাউলদের চুল কেটে দেওয়ার মতো ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে কেউ কেউ। যাত্রাপালা যেন হতে না পারে, সে জন্য সামাজিকভাবে ষড়যন্ত্র করেছে।)
৩. সুফি ভাবধারার জায়গায় কট্টর মুসলিম ভাবধারার অনুপ্রবেশ। (টীকা, এ দেশে দুভাবে ইসলাম ঢুকেছে। সুফিরা এসেছিলেন সহজিয়া ধারায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদহীনতার বাণী নিয়ে, নৃপতিরা এসেছিলেন তলোয়ার হাতে। মূলত এই অঞ্চলের দরিদ্র হিন্দু ও বৌদ্ধরাই ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বাণীকে বরণ করে নিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও তাঁদের আচরিত জীবনযাত্রায় খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক প্রায় ছিলই না। একই গ্রামে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মিলেমিশেই থাকতেন। অভাব তাঁদের একাত্ম করত। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হঠাৎ করে বাঙালি মুসলমান ভাবতে শুরু করল, তারাই একসময় এ দেশটা চালিয়েছে। সেই সুখের সন্ধানে ব্যাপৃত হলো তারা। অথচ আগে কখনোই নিজেদের শাসক বলে ভাবেনি আম-মুসলমান। এই রাজনৈতিক ইসলামই ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়েছে। স্বাধিকার আন্দোলনের সময় তা স্তিমিত হয়ে আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর পেছনে একটা বড় কারণ–পেট্রো ডলার। সৌদি ডলারের পাশাপাশি সেখানকার কট্টর ইসলাম এসে আমাদের সুফি ইসলামকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর ধর্মের মানবতার জায়গায় নিষ্ঠুরতাই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।)।
এই হলো আইসবার্গের চূড়া। আরও অনেক কারণ আছে, যেগুলো নিয়েও আলোচনা হতে হবে এবং এই অপরিষ্কার জায়গাগুলো পরিষ্কার না করলে প্রতিবছরই কুমিল্লা, রংপুর, নোয়াখালীর মতো পুরো দেশটাতেই শোনা যাবে হায়েনার হাসি, দেখা যাবে শকুনের বিচরণ।
যারা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশটাকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের এমন শাস্তি হতে হবে, যা দেখে পরবর্তীকালে আর কেউ এই উসকানি দিতে সাহস না পায়।
এবার অন্য আরেকটি প্রশ্ন, সরাসরি সরকারের কাছে: আমরা যখন প্রতিবছরই দেখে আসছি, একশ্রেণির বদমাশ পবিত্র ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে থাকে, সাধারণ মুসলমানকে উসকে দিতে পারে, তাহলে কেন আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগে থেকেই সচেতন হতে বলি না? কেন ভাঙচুর, অবমাননা, হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হয়?
জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে