রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট–রেস্তোরাঁর শুধু তালিকাই হয়, ব্যবস্থা গ্রহণ নয়

সৌগত বসু, সাইফুল মাসুম ও রাসেল মাহমুদ, ঢাকা
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৪, ০৮: ২৬
আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৪, ১৯: ৪৩

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের পোড়া কঙ্কালও টনক নড়াতে পারছে না রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁ-ক্যাফের ছড়াছড়ি থাকা ভবন কর্তৃপক্ষের। একই রকম ঝুঁকি থাকলেও ভবনগুলোর রেস্তোরাঁ-ক্যাফে চলছে দিব্যি। একই অবস্থা ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় আগুনের ঝুঁকিতে থাকা ৫৮ বিপণিবিতানেরও (মার্কেট)।

বিপণিবিতানগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে ফায়ার সার্ভিস বারবার নোটিশ দিলেও মানছে না মালিক সমিতি ও ভবনমালিক। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ভবনের মালিককে নোটিশ দিতে পারি। এ ছাড়া আর কিছু করার নেই। মামলা করা বা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের আইনের মধ্যে যা যা করা সম্ভব, তা-ই করছি।’

নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, নোটিশে বেঁধে দেওয়া সময়ে কাজ না হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। একটির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে বাকিগুলো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। এ জন্য ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

এদিকে ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করা ভবনগুলোর বিরুদ্ধে গতকাল রোববার অভিযানে নেমেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।গ্রিন কোজি কটেজের মতো রেস্তোরাঁ-ক্যাফের ছড়াছড়ি ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড, মিরপুর, খিলগাঁওয়ের তালতলায়।

নগরের আরও এলাকায়ও আছে এমন রেস্তোরাঁ ভবন। কোনো ভবনের বাণিজ্যিক অনুমোদন আছে, আবার কোনো কোনোটির রয়েছে আবাসিক ভবনের অনুমোদন। বেশির ভাগ রেস্তোরাঁতেই ব্যবহার হচ্ছে সিলিন্ডারের এলপি গ্যাস। বেইলি রোডে আগুনে ৪৬ জনের প্রাণহানির পর আলোচনায় এসেছে এসব রেস্তোরাঁর ঝুঁকি। তবে এই ঝুঁকি নির্মূলের পদক্ষেপ গতকালও চোখে পড়েনি।

গতকাল রেস্তোরাঁ-ক্যাফে থাকা পাঁচটি ভবন এবং আগুনের ঝুঁকিতে থাকা ১০টি বিপণিবিতান ঘুরেছেন আজকের পত্রিকার প্রতিবেদকেরা। সরেজমিনে দেখা যায়, রেস্তোরাঁ থাকা বেশির ভাগ ভবনে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই। সামনের অংশ কাচঘেরা, কোনো জানালা নেই। রান্নাঘরে একটিমাত্র এগজস্ট ফ্যান। সার্বক্ষণিক নির্ভরশীলতা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ওপর। ওঠা-নামার জন্য ভরসা লিফট। সিঁড়ি আছে, তবে সহজে চোখে পড়ে না। কয়েকটি ভবনে সিঁড়ি ধোয়া-মোছা চলছে। এ ছাড়া ঝুঁকি এড়াতে আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে মার্কেটগুলোর জরুরি বহির্গমন ও উন্মুক্ত স্থানগুলো আগের মতোই মালামাল রেখে বন্ধ করা হয়েছে। আগুন নেভানোর সরঞ্জাম আছে নামমাত্র।

ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের লাগোয়া ১৩ তলা ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টারে রয়েছে ১৯টি রেস্তোরাঁ, ক্যাফে ও লাউঞ্জ। রয়েছে পোশাক, বেকারি, ক্লিনিক, ব্যাংক, ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান ও শরীরচর্চা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের তালিকা ভবনের নিচতলাতেই বোর্ডে রয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই ভবনের একটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা কম। জানা গেল, দুপুরের খাবারের সময় এবং সন্ধ্যার পর ভিড় হয়। এই ভবনের জরুরি নির্গমনের জন্য প্রশস্ত দুটি সিঁড়ি রয়েছে। তবে রেস্তোরাঁগুলো যেখানে আছে, আগুন লাগলে বের হতে অনেক সময় লাগবে।

নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ শামীম রেজা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভবনটিতে ছয়টি রেস্তোরাঁ আছে। তাঁরা বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন নিয়েছেন। রেস্তোরাঁ করার অনুমতিও আছে। ভবনে পাইপলাইনের গ্যাস-সংযোগ আছে, কোনো সিলিন্ডার নেই।

ওই ভবনের উল্টো পাশের ১২ তলা রূপায়ণ জেড আর প্লাজায় ১২টি রেস্তোরাঁ আছে। বেইলি রোডে আগুনের পর নিরাপত্তাব্যবস্থায় কড়াকড়ি করা হয়েছে। এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, বেইলি রোডে আগুনের পর ভবনের সিঁড়ি পরিষ্কার করা হয়েছে।

রাজধানীতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ। অনেক এলাকায় একই ভবনে বেশ কয়েকটি করে রেস্তোরাঁও রয়েছে। কোনো কোনো ভবনে রেস্তোরাঁর পাশাপাশি দোকানপাটসহ নানা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গতকাল রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে ধানমন্ডি এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকাসাতমসজিদ রোডের শংকর বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোলে ১২ তলা জি এইচ হাইটস নামের একটি ভবন। সেখানেও ছয়টি রেস্তোরাঁ আছে। ভবনে দুটি লিফটের পাশাপাশি সিঁড়ি এবং একটি ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি রয়েছে। রিসিপশনে থাকা মেহেদী হোসেন জানান, আগে আরও বেশি রেস্তোরাঁ ছিল। সম্প্রতি কয়েকটি গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি, ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন আছে।

একই সড়কের ১৪ তলা গাউছিয়া টুইন পিক নামের ভবনে ২০টির বেশি রেস্তোরাঁ ও কফি হাউস আছে। বেইলি রোডে আগুনের পর ভবনটির স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ভবনটিতে না যেতে সবার প্রতি অনুরোধ করেছেন। তিনি লেখেন, বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে ভবনটিকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে।

সাতমসজিদ রোডে ১৪ তলা কেবি স্কয়ার ভবনের পুরোটিতেই রেস্তোরাঁ। ভবনটির পেছনে দেখা গেল বিশাল আকারের ৩০টির মতো গ্যাস সিলিন্ডার। সিলিন্ডার থেকে পাইপের সাহায্যে বিভিন্ন তলার রেস্তোরাঁয় গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মিরপুর ১২ নম্বরে পল্লবীতে ১০ তলা সাফুরা টাওয়ারে ১৪টি রেস্তোরাঁ রয়েছে। প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁর বাইরের অংশে কাচ লাগানো। তবে গতকাল ভবনের প্রধান ফটকসহ সব রেস্তোরাঁ বন্ধ পাওয়া গেছে। বিকেলে ভবনটি পরিদর্শন করেন রাজউকের জোন-৩-এর কর্মকর্তারা। পরিদর্শনের পর তাঁরা জানান, ভবনটিতে জরুরি নির্গমন সিঁড়ি নেই।

রাজউকের জোন-৩-এর পরিচালক তাজিনা সারোয়ার বলেন, ভবনের কোনো নকশা পাওয়া যায়নি। ভবনটির বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন ছিল কি না, দেখতে হবে। বন্ধ থাকায় অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা রেস্তোরাঁগুলোতে ছিল কি না, তা দেখার সুযোগ হয়নি। 

রাজধানীতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ। অনেক এলাকায় একই ভবনে বেশ কয়েকটি করে রেস্তোরাঁও রয়েছে। কোনো কোনো ভবনে রেস্তোরাঁর পাশাপাশি দোকানপাটসহ নানা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গতকাল রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে ধানমন্ডি এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকাঝুঁকি কমেনি ৫৮ মার্কেটে 
বঙ্গবাজার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস রাজধানীর ৫৮টি মার্কেটকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে ৯টি মার্কেটকে চিহ্নিত করা হয় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। এই ৯টি হলো গাউছিয়া মার্কেট, ফুলবাড়িয়ার বরিশাল প্লাজা মার্কেট, টিকাটুলীর রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, লালবাগের আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজারের সাকিব আনোয়ার টাওয়ার, শহীদ উল্লাহ মার্কেট, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট, মাশা কাটারা ২২ মার্কেট এবং সিদ্দিক বাজারের রোজলীন ভিসতা মার্কেট।

গত দুদিন সিদ্দিকবাজারের রোজলীন ভিসতা মার্কেটে গিয়ে অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ১৬ তলা ভবনটির চারতলা পর্যন্ত দোকান এবং বাকি তলাগুলো আবাসিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নামমাত্র। তবে মার্কেটটির মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তাক আহমেদের দাবি, ভুল বোঝাবুঝির কারণে তাঁদের মার্কেটের নাম অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শে তাঁরা অনেক কিছু হালনাগাদ করেছেন। তবে ভবন ভেঙে এখন পানির লাইন করা সম্ভব নয়।

ফুলবাড়িয়ার ছয়তলা বরিশাল প্লাজার প্রথম তিনতলায় পোশাকের দোকান। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠতলা আবাসিক। দ্বিতীয় তলার টি-শার্টের দোকানের নয়ন হোসেন বলেন, মার্কেটে ২৫০টির মতো দোকান রয়েছে। সব সময় আতঙ্কে থাকেন। মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে চাইলে ভবনের ব্যবস্থাপক এড়িয়ে যান।

রাজধানীতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ। অনেক এলাকায় একই ভবনে বেশ কয়েকটি করে রেস্তোরাঁও রয়েছে। কোনো কোনো ভবনে রেস্তোরাঁর পাশাপাশি দোকানপাটসহ নানা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গতকাল রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে ধানমন্ডি এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকাঅধিক ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় থাকা চকবাজারের ১০ তলা শাকিব আনোয়ার টাওয়ারে গিয়ে দেখা যায়, সিঁড়ি মাত্র একটি। অথচ রাজউকের বিধিমালা অনুসারে, এমন ভবনে সিঁড়ি থাকতে হবে দুটি। চকবাজারের সাততলা শহীদুল্লাহ মার্কেটের প্রথম দুটি তলায় তৈরি পোশাকের দোকান। পরের চারটি তলায় পোশাক তৈরির কারখানা। একটি সরু সিঁড়ি। ভবনের ভেতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই।

সার্বিক বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খুব কঠোর হতে হবে। সময় দেওয়ার পরও ঠিক করা না হলে কঠোর ব্যবস্থায় যেতে হবে। ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ৫৮টি মার্কেটের মধ্যে একটিতে যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, বাকি ৫৭টি এমনিতে ঠিক হয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত