দুগ্ধশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার গল্প কাতারের

ফারুক মেহেদী,কাতার থেকে ফিরে
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ১০: ৩৬

সবাই বলে, মরুর দেশ কাতারে তেল-গ্যাস ছাড়া আর কিছু নেই! এ দুটি খনিজ পণ্য বিক্রি করেই দেশটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী। এ কারণে দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয়ও বিশ্বের অন্য সবার চেয়ে বেশি। কথা সত্য। তবে, এই ধন-সম্পদই অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর ঈর্ষার কারণ হয়ে ওঠে। নানান ছুতোয় ২০১৭ সালে ছোট এই দেশটির ওপর অর্থনৈতিকসহ নানান নিষেধাজ্ঞা দেয় প্রতিবেশী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ। বলা যায়, দেশটির সঙ্গে এসব দেশের সড়ক, আকাশ ও নৌপথের সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে। রীতিমতো একঘরে করে রাখা হয় কাতারকে। এতে আমদানিনির্ভর দেশটি ভয়ংকর বিপাকে পড়ে। দেশটিতে তখন খাদ্যস্বল্পতা দেখা দেয়।

পরে আকাশপথ ব্যবহার করে, কয়েক গুণ বেশি দামে খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ওষুধসহ জরুরি পণ্য তারা মিত্র দেশ থেকে সরাসরি আনতে বাধ্য হয়। এমন এক সংকটময় মুহূর্তে কাতার তাদের সীমান্ত আর আকাশপথের বিকল্প হিসেবে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে মনোযোগী হয়। এ লক্ষ্যে প্রায় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে গড়ে তোলা হয় সমুদ্রবন্দর। গুরুত্ব দেওয়া কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে। এরই অংশ হিসেবে দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে দুধ উৎপাদনে বিকল্প চিন্তা করতে শুরু করে কাতার। যে দেশটি দুধে শতভাগ আমদানিনির্ভর, সে দেশ কীভাবে নিজস্ব গরুর খামার করে দুধ উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারে, তৈরি হয় সেই পরিকল্পনা। ২০১৭ সালে জুনে দেশটিতে চলমান কঠিন অবরোধের ৩৬ দিনের মাথায় তারা উড়োজাহাজে করে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে প্রথম দফায় চার হাজার উন্নত জাতের গাভি নিয়ে আসে। চলে নতুন যুদ্ধ। কাতারের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরের উত্তরের এলাকা আল-খোরে চলে খামার তৈরির কাজ। গড়ে তোলা হয় বালাদনা নামের একটি দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এর পর নতুন বন্দর দিয়ে আসে আরও ১০ হাজার গরু। একে একে সেখানে গড়ে তোলা হয় ৪০টি খামার। চার হাজার গাভি দিয়ে তৈরি বালাদনা দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট এখন প্রায় ১ হাজার ৬০০ কর্মীর তত্ত্বাবধানে ২৪ হাজার গরুর বিশাল সাম্রাজ্য। আর এভাবেই বালাদনার হাত ধরে বদলে যেতে থাকে কাতারের দুধের উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা। শুধু বালাদনা প্লান্টেই এখন দিনে প্রায় ৩২০ টন দুধ উৎপাদন হয়। এ দুধ থেকেই এখন আড়াই শ দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করা হয়।

বালাদনার পর একে একে আরও বেশ কিছু দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি আল-খোরে প্রতিষ্ঠিত কাতারের সবচেয়ে বড় এ দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বালাদনা পরিদর্শনে গিয়ে বিস্ময়ের সীমা থাকে না! এর একেকটি শাখা প্লান্ট নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থাপিত। এর কোনোটিতে গরুর দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে, আবার কোনোটিতে তা প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে। মূল প্লান্টে ঢুকতেই একটি মনোরম পার্ক চোখে পড়বে। গরুর খামারের চমৎকার পার্ক যে কাউকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে সহায়তা করবে! আছে হাজারো গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। এ প্লান্ট সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে একটি পরিদর্শন হলরুম রয়েছে। ওই হলরুম থেকে নিচে দেখা যায়, স্বয়ংক্রিয় একটি প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে অন্তত ১০০টি গাভি এসে দাঁড়ায়, সেখানে গাভিগুলো থেকে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে দুধ সংগ্রহ করা হয়।

একটি গাভি থেকে দিনে দুই দফায় অন্তত ৪০ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়। সব মিলিয়ে এক এলাহি কাণ্ড! খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরে শুধু বালাদনা নয়, খোদ কাতারই এখন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু তাই নয়, দেশটি এখন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য রপ্তানিতে মনোযোগ দিয়েছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে প্লান্ট স্থাপন করে এর বাজার প্রসার করতে চুক্তিও হয়েছে। মোট কথা, যে দেশকে অবরোধ দিয়ে প্রায় অচল করে দেওয়া হয়েছিল, আমদানি না করলে যে দেশের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না; সেই দেশটি সব প্রতিবন্ধকতাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে এ খাতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। সত্যিই সংকট থেকে এক অভাবনীয় ঘটনার জন্ম হয়েছে মরুর দেশ কাতারে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত