Ajker Patrika

ঐতিহ্য ও গৌরবের হিজরি সন

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২২, ০৯: ১২
ঐতিহ্য ও গৌরবের হিজরি সন

হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ও যুগান্তকারী ঘটনা। মক্কার কাফেরদের অত্যাচার-নির্যাতন, অমানবিক আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে এবং তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে মুসলমানদের তিনি মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন এবং নিজেও মদিনায় হিজরত করেন। ফলে হিজরতের মাধ্যমে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের পথ খুলে যায়। তাই এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক হিসেবে খলিফা হজরত ওমর (রা.) হিজরি সনের গোড়াপত্তন করেন এবং মুসলমানদের জন্য পৃথক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন। (আল-কামিল ফিত-তারিখ লি-ইবনিল আছির, ১/৪)

হিজরি সনের তাৎপর্য
ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সন অনুযায়ী পালন করতে হয়। যেমন রমজানের রোজা, আইয়ামে বিজের রোজা, হজ, আশুরা, ঈদ, শবে বরাত, শবে কদর প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিধিনিষেধ চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া জাকাতের বছর গণনা, সন্তানের বয়স গণনা এবং পূর্ণ দুই বছর সন্তানকে মায়ের দুধ পান করানোর হিসাব—সবই হিজরি সন তথা চান্দ্রমাস অনুযায়ী হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘লোকে তোমাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলো, এটি মানুষ এবং হজের জন্য সময় নির্দেশক।’ (সুরা বাকারা: ১৮৯)

চাঁদ দেখে মাসের হিসাব সহজেই আয়ত্ত করা যায়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামবাসী-মরুবাসী-উপজাতি–সবার জন্যই চান্দ্রমাসের হিসাব সহজ। আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মনজিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।’ (সুরা ইউনুস: ৫)

বারো মাসের নামকরণ
হিজরি সনের বারো মাসের প্রতিটির নামকরণের আলাদা গল্প রয়েছে। এখানে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হলো—

  • মহররম: হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। ‘মহররম’ অর্থ সম্মানিত। আরবে এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ থাকত এবং এ মাসকে সম্মানিত মনে করা হতো, তাই এ মাসের নাম মহররম।
  • সফর: হিজরি সনের দ্বিতীয় মাস সফর। মহররমের পর আরবের লোকজন বাড়িঘর খালি করে যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়ত। মানবশূন্য স্থানকে আরবিতে ‘সাফিরাল মাকান’ বলা হয়। সেখান থেকে এ মাসের নাম সফর।
  • রবিউল আউয়াল: হিজরি সনের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। ‘রবিউন’ অর্থ বসন্তকাল। এ মাসে আরবের প্রকৃতিতে বসন্ত লাগত। তাই এর নাম রবিউল আউয়াল বা বসন্তের প্রথম মাস।
  • রবিউস সানি: রবিউল আউয়ালের পরের মাস যেহেতু বসন্তের দ্বিতীয় মাস, তাই সেটির নাম রবিউস সানি বা রবিউল আখির।
  • জমাদিউল আউয়াল: জমাদিউল আউয়াল পঞ্চম মাস। আরবিতে জুমুদ অর্থ জমে যাওয়া। প্রচণ্ড শীতে কিংবা প্রবল শৈত্যপ্রবাহে সবকিছু জমে যায়, তাই এ মাসের নাম জমাদিউল আউয়াল।
  • জমাদিউস সানি: জমাদিউস সানি ষষ্ঠ মাস। যে সময় এ মাসের নাম রাখা হয় তখন পানি জমাটবদ্ধ হওয়ার শেষ মৌসুম ছিল।
  • রজব: ‘রজব’ অর্থ সম্মান করা। প্রাক্‌-ইসলামি যুগ থেকেই এ মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল। এ মাস সবার কাছে সম্মানিত ছিল। তাই এ মাস রজব।
  • শাবান: শাবান অর্থ বিভক্ত হওয়া। রজব শেষ হওয়ার পর যুদ্ধের জন্য মানুষ বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ত। এ জন্য এ মাস শাবান।
  • রমজান: নবম মাস রমজান। ‘রামাদুন’ অর্থ প্রখর তাপ। এ মাসে আল্লাহর অনুগ্রহে গুনাহ জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। তাই এ মাসের নাম রমজান।
  • শাওয়াল: দশম মাস শাওয়াল। ‘শাওলুন’ অর্থ ক্ষিপ্রতা। এ মাসে আরবের লোকজন সফর ও শিকারের উদ্দেশ্যে নিজ এলাকা থেকে বের হতো। শিকারের সময় শিকারির ক্ষিপ্রতা থাকাই স্বাভাবিক। তাই এ মাসের নাম শাওয়াল।
  • জিলকদ: জিলকদ এগারোতম মাস। ‘কাআদাহ’ অর্থ বসা, বিশ্রাম করা। মহান আল্লাহ এই পবিত্র মাসে যুদ্ধবিগ্রহ হারাম করেছেন। সবাই এ মাসে ঘরে বসে দিন কাটাত। তাই এ মাসের নাম জিলকদ।
  • জিলহজ: বারোতম ও সর্বশেষ মাস জিলহজ। এটি ফরজ বিধান হজ পালনের মাস। তাই এ মাসকে জিলহজ বলা হয়।

কোরআন-হাদিসে হিজরি সন
হিজরি সনের মাসগুলোর কথা কোরআন-হাদিসে আলোচিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা হিজরি সনের গৌরবময় অধ্যায়। আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস—এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কোরআন নাজিল হয়েছে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হজ হয় সুবিদিত মাসসমূহে।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭) ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘সুবিদিত মাসসমূহ হলো—শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম দশক।’ (বুখারি: ১৪৮৪)

আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর গণনায় মাস বারোটি। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ (সুরা তওবা: ৩৬) এ প্রসঙ্গে নবী (সা.) বলেন, ‘চারটি নিষিদ্ধ মাসের তিন মাস ধারাবাহিক—জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। আর রজব যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যের মাস।’ (বুখারি: ৩০২৫; মুসলিম: ৪৪৭৭)

সফর মাস প্রসঙ্গে নবী (সা.) বলেন, ‘সফর মাসে অকল্যাণ নেই।’ (বুখারি: ৫৪২৫; মুসলিম: ৫৯২৬)

রবিউল আওয়াল মাস সম্পর্কে উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সবাইকে নিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে বনু আমর ইবনে আউফ গোত্রে নামলেন। দিনটি ছিল রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার।’ (বুখারি: ৩৬৯৪)

ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের স্বার্থে যথাসময়ে চাঁদ দেখার মাধ্যমে হিজরি বর্ষের হিসাব রাখা জরুরি। মুসলমানদের জন্য ঐতিহ্য ও গৌরবের হিজরি বর্ষ এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই।

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা, সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নবরাত্রির জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষা, পিরিয়ডের কারণে পালন করতে না পেরে আত্মহত্যা

আ.লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ, খই-মুড়ির মতো বোমা ফুটছে জাজিরায়

অটোতে ফেলে যাওয়া ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার ফিরিয়ে দিলেন কলেজছাত্র

পরকীয়া নিয়ে ঝগড়া, স্ত্রীর কাঠের আঘাতে স্বামী নিহত

সারা দেশে ৩২৯ উপজেলায় হচ্ছে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ: মহাপরিচালক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত