অসময়ের নদীভাঙনে বাড়িঘর বিলীন

ইসমাইল হোসেন কিরণ, হাতিয়া (নোয়াখালী)
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১০: ০১
আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪: ২৫

কারও ঠাঁই হয়েছে রাস্তার ওপর, কারও বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনে, কেউ আশ্রয় নিয়েছে অন্যের বাড়িতে কেউ বা বিলের মধ্যে খুপরি ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। অসময়ে তীব্র নদীভাঙনে বাড়িঘর হারানো হাজারো পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ২ নম্বর চানন্দী ইউনিয়নের বাতানখালী বাজার থেকে হেমায়েতপুর পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার নদীতীরের চিত্র এটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চানন্দী ইউনিয়নের জনতা বাজারের বিশাল মসজিদটির বেশির ভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আগের সপ্তাহে এই মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে পারলেও গত শুক্রবার তা পারেননি মুসল্লিরা। একই অবস্থা হেমায়েতপুর বাজার জামে মসজিদের। কয়েকজন মুসল্লিকে দেখা যায় ঘরবিহীন শূন্য ভিটার ওপর আসরের নামাজ আদায় করতে। নদীর একেবারে তীরের মসজিদের ভিটির অনেকাংশে ফাটল ধরেছে। ঝুঁকি নিয়ে তাতে নামাজ আদায় করছেন ইমামসহ পাঁচজন মুসল্লি।

একই ইউনিয়নের নলেরচর এলাকার মসজিদটি সরিয়ে অন্যত্র নেওয়া হয়আলাপকালে হেমায়েতপুর বাজার মসজিদের ইমাম মো. ফারুক (৫৫) জানান, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বর্ষা মৌসুম আসার আগে মসজিদটি অন্যত্র স্থানান্তরের। কিন্তু শীত মৌসুমেও নদীর তীব্র ভাঙনে মসজিদটি দ্রুত স্থানান্তর করতে হলো। তবে নতুন জায়গার ব্যবস্থা এখনো হয়নি। এলাকার মুসল্লিদের অনেকে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতাও পাওয়া যাচ্ছে না।

চানন্দী ইউনিয়নের কালাদুর বাজার থেকে পূর্বদিকে গেলে হেমায়েতপুর বাজার। তার একটু আগে রাস্তার ওপর চোখে পড়ে কয়েকটি বসতঘরের অংশবিশেষ স্তূপ করে রাখা। এরই পাশে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধকে দেখা যায় ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন।

নুরনবী নামের ওই বৃদ্ধ জানান, গত রাতে তাঁর বসত ভিটাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যরা মিলে ঘরের চালসহ বিভিন্ন অংশ এনে রাস্তার ওপর রেখেছেন। গত দু’রাত রাস্তার পাশে খুপরি ঘর তৈরি করে কেটেছে।

ভাঙনকবলিত ওই ইউনিয়নের হেমায়েতপুর গ্রামের একটি পরিবারের সদস্যরা খুপরি ঘর বানিয়ে কোনো রকমে দিন যাপন করছেনবৃদ্ধ নুরনবী আরও জানান, হেমায়েতপুর থেকে আলী নগর পর্যন্ত এই গ্রামে তিন শতাধিক পরিবার বসবাস করত। গত তিন মাসে সবার বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সবাই অন্যত্র বাড়িঘর করেছেন। তিনি এখনো কোথাও বাড়ি তৈরি করার ব্যবস্থা করতে পারেননি। ঘরে দুটি মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত। তাঁদের বিয়ে দেওয়া, নতুন বাড়ি তৈরি করা। অনেক টাকা দরকার। তিনি এত টাকা এখন কোথায় পাবেন!

নলেরচরের ফরিদপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আ স ম জাফর ইকবাল জানান, শীত মৌসুমেও ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। গত তিন বছরে নলেরচর ও কেরিংচরে অন্তত ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে চলে গেছে। সবশেষে গত মাসে ভেঙে যায় জনতা বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটি। ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে নলেরচর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবন, হেমায়েতপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরও ১০-১৫টি স্থাপনা।

নতুন জেগে ওঠা এই চরে মানুষের বসবাস শুরু হয় ১৯৯৮ সালের দিকে। ২০০৩ সালে ঘোষিত চানন্দী ইউপি দুটি প্রশাসনিক শাখায় ভাগ করে চলছে। একটি কেরিংচর প্রশাসনিক শাখা, অপরটি নলেরচর।

প্রশাসনিক চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, গত তিন বছরের অব্যাহত ভাঙনে কেরিংচর প্রশাসনিক শাখার প্রায় পুরোটাই ভেঙে গেছে নদীতে। এখন ভাঙছে নলেরচর। গত দুই মাসে নলেরচরেরও বিশাল এলাকা ভেঙে যায়। জনতা বাজারের পাশে ইউপি কার্যালয় ভবন। নদীর একেবারে তীরে চলে আসায় এখন আর সেখানে কার্যক্রম চালানো হয় না। এখন দরবেশ বাজারের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অস্থায়ী ভিত্তিতে চালানো হচ্ছে পরিষদের কার্যক্রম।

এ ব্যাপারে হাতিয়া উপজেলার দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জামিল আহম্মেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘নলেচর ও কেরিংচরে নদীভাঙনের গতি অনেক বেশি। এখানে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকার ভাঙন রোধে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৮৫ কোটি টাকা। এটি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছে। ইতিমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কিছু সমীক্ষা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই চিঠির আলোকে আমরা এখন মাঠে কাজ করছি। আশা করছি, শিগগিরই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা যাবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত