দারিদ্র্য, ধর্ম এবং অর্থ

মামুনুর রশীদ
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮: ১২

মাঝে মাঝে আমি গ্রামবাংলায় যাই। সাম্প্রতিককালের নির্বাচনেও আমার গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বিপুলসংখ্যক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। গ্রামে এখনো দারিদ্র্য আছে আবার কিছু কিছু মানুষ হঠাৎ করেই বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে গেছে। অনেক গ্রামেই ভালো রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু গ্রামে এখনো রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেশ অনুন্নতই থেকে গেছে। এর প্রধান কারণ, এলাকার জনপ্রতিনিধিদের অবহেলা।

দারিদ্র্য যেখানে আছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই, সেখানে ধর্ম মানুষের কাছে একটা বড় অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা এসব অনুন্নত জায়গায় এসে বসবাস করে গির্জা স্থাপন করত এবং গির্জার পাশাপাশি একটি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করত। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের মিশনারি স্কুল এখনো দেখা যায়। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে শহরে প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কলেজ। এই মিশনারি স্কুল, কলেজগুলো খুব একটা ধর্মীয় শিক্ষা দিত না; বরং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার প্রচেষ্টা চালাত। ঢাকা শহরের সেন্ট গ্রেগরিজ, সেন্ট ফ্রান্সিস, সেন্ট যোসেফ এবং নটর ডেম কলেজের প্রতিষ্ঠা বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর জন্য ভালো শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

একসময় মাদ্রাসা শিক্ষাও একই কারণে শুরু হয়েছিল। কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা, এরও আগে দেওবন্দ মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল। আর গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছিল মোগল আমল থেকেই মক্তব, যেখানে আরবি, ফারসিসহ ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হতো। এই শিক্ষা সংস্কারের জন্য নিউ স্কিম মাদ্রাসা তৈরি হয়েছিল। সেই নিউ স্কিম মাদ্রাসা থেকে অনেক প্রগতিশীল চিন্তাবিদের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে দরিদ্র-অধ্যুষিত জায়গায় প্রচুর মাদ্রাসা গড়ে উঠেছিল। সরকারও মাদ্রাসা বোর্ড করে প্রচুর মাদ্রাসার অনুমোদন দিয়েছে এবং সরকারি অর্থায়নেই এসব চলছে। এর সমান্তরালে গড়ে উঠেছে প্রচুর কওমি মাদ্রাসা। একেবারেই ভিন্ন অর্থায়নে এই মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয় বলে সরকারের কোনো অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। এই মাদ্রাসাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রমাণিত, হেফাজতে ইসলাম এই মাদ্রাসাগুলো পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এর বাইরেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী এবং বিত্তবান লোকেরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে থাকে। দেখা যায় একেবারেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া কিছু বিত্তবান লোক, আমলা জীবনের একটা পর্যায়ে এসে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তাদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করে।

সরকারি মাদ্রাসার কারিকুলামে বর্তমানে প্রায় সব বিষয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু অন্য মাদ্রাসাগুলোর কারিকুলামের ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে একধরনের মানসিক সংকট দেখা দেয়। যার পরিণতিতে একদা ঢাকা শহর হেফাজতে ইসলাম তাদের ছাত্রদের দিয়ে প্লাবিত করে দিয়েছিল। এখনো বিত্তহীন এবং নিম্নবিত্তের সংখ্যা বাংলাদেশে অগণিত। ছেলেমেয়ের ভরণ-পোষণ চালাতে না পেরে যেকোনো বোর্ডিং মাদ্রাসায় সন্তানদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বোর্ডিং মাদ্রাসায় সুযোগ না পেলে অবৈতনিক মাদ্রাসায় তাদের স্থান হয়। মাদ্রাসা পাস করা ছেলেমেয়েদের চাকরিবাকরির সুযোগও সীমিত। কাজেই বেকারত্বের একটা বড় অংশ এই সব শিক্ষার্থী থেকে তৈরি হচ্ছে। যেহেতু মাদ্রাসা শিক্ষার ওই সব নিম্নবিত্তের একমাত্র ব্যবস্থা, তাই এর অনুষঙ্গগুলোকেও তাদের মেনে চলতে হয়। কখন কার বিরুদ্ধে কার পক্ষে তাদের দাঁড়াতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাদের নেই।

আবার সরকার যে প্রাথমিক অবৈতনিক বিদ্যালয়গুলো করেছে, সেখানেও লেখাপড়ার ব্যবস্থা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্কুলে শিক্ষা তো হয়ই না, নির্ভর করতে হয় কোচিংয়ের ওপর। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত উচ্চমূল্যের কোচিং করানোর ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। এই পরিস্থিতিতে একটা পর্যায়ে ঝরে পড়া এবং উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাটাকে যদি উপযোগী এবং কোচিংবিহীন করা যেত, তাহলে শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হলে পরবর্তী শিক্ষাটাও ঠিকমতো হতে পারত। এই পরিস্থিতিতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটাতেই ধস নেমেছে। অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি সমাজকে একটা উদ্দেশ্যবিহীন এবং আদর্শহীনতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

একদা লর্ড ক্লাইভ বাংলাকে দখল করে প্রচুর লুটপাট করেছেন। সেই লুটপাটের অর্থ দিয়ে লন্ডনের অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর এই দ্রুত সম্পদ আহরণ লন্ডনবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে তিনি কোনো সামাজিক মর্যাদা পাননি। আমরাও দেখেছি পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের কারণে কেউ কোনো সামাজিক মর্যাদা পেত না। কিন্তু আশির দশক থেকে সমাজে দ্রুত দুর্বৃত্তায়নের ফলে একজন অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনকারীকে কেউ ঘৃণা করে না; বরং তাঁরা রাজনৈতিকভাবে প্রতিপত্তি অর্জন করে সমাজে শ্রদ্ধার জায়গায় স্থান পেয়ে বসে আছেন। এই শতাব্দীতে এসে মানুষের মূল্যবোধ ও আদর্শগত জায়গাটা যেমন শূন্য হয়ে গেছে, তখন কোনো ন্যায় চিন্তা সমাজে আর কাজে লাগছে না। যেসব লোক সম্পদের অধিকারী হয়েছে, তার পেছনে খুন, হত্যা, লুণ্ঠন, ক্ষমতার অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও মানুষ ভয়ে হোক অথবা নিজের অস্তিত্বের কারণে তাকে সমর্থন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খুঁজে পায় না। এই করে করে সমাজের শুদ্ধ আত্মাটা ক্রমেই মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যায়।

এই প্রবণতা যে শুধু বাংলাদেশে তা নয়, উপমহাদেশজুড়েই এই ধারা চলছে। কিন্তু ভারতে এই ধারার বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষ লড়াই করে যাচ্ছে। কখনো দলগতভাবে, কখনো ব্যক্তিগতভাবে। অথচ আমাদের দেশে ক্ষমতার জন্য লড়াই আছে। কিন্তু আদর্শ, নীতিবোধের জন্য তেমন একটা লড়াই নেই। আদর্শের লড়াইটা মূলত কমিউনিস্ট পার্টি এবং বাম ধারার রাজনীতিবিদেরাই করতেন। তাঁদের লড়াই, ত্যাগ তিতিক্ষা সমাজে একটা প্রভাব সৃষ্টি করত। ষাটের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে একটা বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ছাত্রসংগঠনগুলো নানা ধরনের ত্যাগ-তিতিক্ষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সামনে তারা দাঁড়াতে পারেনি।

কিন্তু দেখা গেল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বাম ধারার সংগঠনগুলোই এগিয়ে। যথার্থই মানুষ ভেবে দেখল এই ধারার বিজয় হলে দেশের আদর্শগত একটা অবস্থান নিশ্চিত হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এই ধারা ক্ষীয়মাণ হতে থাকে এবং ক্ষমতাসীন দলগুলো ছাত্ররাজনীতিকে দখল করে নেয়।

মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আশির দশকের গোড়ার দিকে একটা বড় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেটি আন্দোলনের মুখে অকার্যকর হলেও পরবর্তীকালে সেই শিক্ষানীতিটিই কার্যকর হয়ে গেছে। শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে ক্ষমতাসীন ও প্রগতিশীল দলগুলোর মধ্যেও তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। হেফাজতের আন্দোলনের পর আমাদের সিলেবাসে বেশ কিছু প্রগতিবিরোধী বিষয় মেনে নেওয়া হয়েছে, যা আসলে আত্মঘাতী। এখনো সেই ব্যবস্থা সরকারিভাবে কার্যকর এবং একটা চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের জন্য এই ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর।

দেশের জাতীয় নির্বাচনে দারিদ্র্য এবং দরিদ্রের ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে একটা শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা রাজধানীতে থেকে বোঝা যায় না। গ্রামাঞ্চলে আজ নারীমুক্তির সম্ভাবনা একেবারেই সুদূরপরাহত। বোরকার গভীর অন্ধকারের মধ্যে বেগম রোকেয়ার এক শ বছর আগের আন্দোলন অন্তর্হিত। গ্রামীণ নারী দাসত্বের ওই পরিস্থিতি থেকে যাঁরা গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদেরও মনের গভীরে ধর্মের বিষয়টি রয়ে গেছে। তাঁরাও বোরকা-হিজাবের আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, সচিবালয়ে সর্বত্রই নারীরা এই অবস্থাকে অনুসরণ করছেন। বৃহত্তর রাজনীতি এখন ধর্ম, অর্থ এবং কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। কোনো কোনো জায়গায় এখন পয়লা বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতির বদলে চলে ওয়াজ মাহফিল।

বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান দিক ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্বমানবতার প্রতি আগ্রহ এবং সাংস্কৃতিক উজ্জীবন। সেই জায়গা থেকে সরে গিয়ে মানুষ ক্রমাগত প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আদর্শহীন, উদ্দেশ্যবিহীন জীবনযাপন মানুষের জীবনে কোনো সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। এ সত্যটি বোঝাতে পারলে মানুষের মানবিক গুণগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারত।

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত