বরগুনায় নয়ন বন্ড না থাকলেও সক্রিয় কিশোর গ্যাং

রুদ্র রুহান, বরগুনা
প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯: ২৩

বরগুনার আলোচিত কিশোর গ্যাং ‘নয়ন বন্ড গ্রুপের’ প্রধান সাব্বির আহমেদ বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। এরপর এলাকায় ‘গ্যাংচর্চা’ কিছুদিন স্তিমিত ছিল। কিন্তু তারা আবার সক্রিয় হয়েছে। গত তিন বছরে ৬৯টি মামলায় শতাধিক শিশু-কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকের সাজাও হয়েছে। মাদক বিক্রি ও সেবন, হত্যা-ধর্ষণসহ একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বরগুনার শিশু-কিশোরেরা। 

বরগুনার স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, বরগুনা শহরের বটতলা, আমতলা, কেজি স্কুল, পিটিআই ও জিলা স্কুল সড়ক, চরকলোনি, স্টেডিয়াম, কড়ইতলা ও বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড এলাকা, দক্ষিণ বরগুনার খাড়াকান্দা, বাঁশবুনিয়া ও কালিতবক, কলেজ রোড, ব্রাঞ্চ রোড, কাঠপট্টিসহ আশপাশের এলাকায় কিশোরদের বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্যরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। 

যা ঘটছে বরগুনায়
১২ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজে ঢোকে ‘নয়ন বন্ড গ্রুপের’ সদস্যরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পৌর শহরের বটতলা এলাকার মো. টিটুর ছেলে রানা, মো. সবুজ গাজীর ছেলে নিশাত ও মো. লিটনের ছেলে মো. রাফি একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢোকে। এ সময় তারা ইমরান হোসেন নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে। পরে অন্য ছাত্ররা এসে বাধা দিলে নয়ন বন্ড গ্রুপের সদস্যরা কলেজ ছেড়ে চলে যায়। 

এ ঘটনার পর সরকারি কলেজে হামলার ঘটনা ও মাদক সেবনের অপরাধে গত বৃহস্পতিবার রাতে শহরের কেজি স্কুল সড়কের শাহনেওয়াজ সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা সেবনরত অবস্থায় ইজমাম (১৯), আবদুল্লাহ ওরফে অর্ণব (১৮), ওমর ফারুক (১৮), আরিয়ান (১৯), রাফসান আহমেদ (১৯), মুশফিকুর (১৮) ও শোয়েব আক্তারকে (১৯) আটক করে পুলিশ। পরে পুলিশ জানায়, তারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য। 

গত ১৮ মে তুচ্ছ ঘটনায় বরগুনা সদরের ক্রোক এলাকা থেকে বাবুল (২৩) নামের এক কলেজছাত্রকে অপহরণ করে বাপ্পি গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। এরপর তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। খবর পেয়ে ডিবি পুলিশের একটি দল জিহাদ ও সিয়াম নামের দুজনকে আটক করে। এ ঘটনায় ওই রাতেই বাবুলের ভাই রিপন বাদী হয়ে বাপ্পি, হাসিব, জিহাদ, সিয়াম, রাকিবসহ অজ্ঞাতনামা সাত-আটজনের বিরুদ্ধে বরগুনা সদর থানায় মামলা করেন। এই গ্রুপের সদস্যরা গত ১ জানুয়ারি রাতে এম বালিয়াতলী ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন গাজীকে (৪৮) মারধর করেন।

বরগুনা শিশু আদালতের তথ্যমতে, গত তিন বছরে মাদক, হত্যা, ধর্ষণসহ ৬৯টি মামলায় শতাধিক শিশু-কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৪ জনকে দেওয়া হয়েছে শিশু আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি। আটকাদেশ পাওয়া অধিকাংশই বরগুনা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। এসব অপরাধের বাইরেও ইভ টিজিং, বেপরোয়া বাইক চালিয়ে পথচারীদের আহত করা, ছিনতাই ও চুরিতেও জড়িয়ে পড়ছে অনেক কিশোর। 

এ প্রসঙ্গে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. আবদুস ছালাম বলেন, ‘আমরা কিশোরদের কয়েকটি গ্রুপের তথ্য পেয়েছি। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। স্কুল-কলেজগুলোয় আমরা নিয়মিত সেমিনার করছি, যাতে কিশোর অপরাধ কমে আসে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতা খুবই জরুরি।’ 

গ্যাংয়ের পেছনে মাদক
এসব কিশোর গ্যাং সক্রিয় মূলত রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। কেউ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতার আশ্রয়ে, কেউ ছাত্রলীগ নেতার আশ্রয়ে এমন গ্যাং পরিচালনা করছেন। সম্প্রতি নতুন করে গড়ে ওঠা ‘বন্ড বাহিনীর’ নেতৃত্বে আমতলা এলাকার আরেফিন রাফি। তিনি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশীদের নাতি। এ বিষয়ে আবদুর রশীদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার নাতির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, সব সত্য না। কিশোর বয়সে ভুলত্রুটি করে ফেলতে পারে। আমরা ওকে সংশোধন করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’ 

বন্ড গ্রুপ শহরের বটতলা, আমতলা, কেজি স্কুল, ব্রাঞ্চ রোড এলাকায় সক্রিয়। এ ছাড়া কালীবাড়ি এলাকায় আবিদ মুন্না, পশু হাসপাতাল এলাকায় জনি, কাঠপট্টি এলাকায় মিরাজ সিকদার, লাকুড়তলায় আমিন, কেজি স্কুল এলাকায় রিমন এবং খাড়াকান্দা ও বাজার এলাকায় পাপ্পু গ্রুপ সক্রিয়। গোয়েন্দা ও পুলিশ সূত্র বলছে, মূলত মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে এসব গ্যাং গড়ে উঠছে। 

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরগুনার সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, বরগুনার কিশোরদের মাদকে জড়িয়ে ফেলছে মাদক বিক্রেতা একটি চক্র। এরা সুকৌশলে কিশোরদের টার্গেট করছে। 

একই ধরনের কথা বললেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারীপক্ষের ‘অধিকার এখানে, এখনই’ প্রকল্পের পরিচালক সামিয়া আফরিন। তিনি বলেন, বরগুনার শিশু-কিশোরেরা একদিকে যেমন ক্রীড়া-সংস্কৃতিবিমুখ, অপরদিকে সহজলভ্য হওয়ায় মাদকে আকর্ষিত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত