১৯৫২ সালের২০ ফেব্রুয়ারির সেই সভা

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
Thumbnail image

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করে পরদিন থেকে ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। আন্দোলনকারীদের সামনে তখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটিই এসে দাঁড়াল—১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না। সেদিনই বেলা ৩টায় শুরু হয়েছিল আইন পরিষদের সভা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ও বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কর্মসূচিতে অ্যাসেম্বলি (আইন পরিষদ) ভবন ঘেরাও করার কথা ছিল। কিন্তু তাতে এমন কোনো ঘোষণা ছিল না, যাতে জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়, তা নিয়ে ৯৪ নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে খেলাফতে রব্বানী পার্টির আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’র এক বৈঠক হয়। গুরুত্বপূর্ণ ওই সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে যাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরোধিতা করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবুল হাশিম, কামরুদ্দীন আহমদ, খয়রাত হোসেন, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী গোলাম মাহবুব, আব্দুস সামাদ প্রমুখ। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে এদের মূল যুক্তি ছিল—যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়, তাহলে দেশে বিশৃঙ্খলা ও সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এবং যদি তা হয়, তাহলে সাধারণ নির্বাচন বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সরকার ১৯৪৭ সালের পর থেকে সাধারণ নির্বাচন দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন পিছিয়ে গেলে বা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকলে তা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক হবে। 

অন্যদিকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অলি আহাদ ও আব্দুল মতিন বলেন, ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কাছে নতিস্বীকার করলে ভাষা আন্দোলনের কোনো অগ্রগতি তো হবেই না, উপরন্তু তা ধ্বংস হয়ে যাবে।

সেই সভায় মওলানা ভাসানী উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি ছিল। মওলানা ভাসানীকে তাঁর পূর্বনির্ধারিত ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারির মফস্বল সফরসূচি বাতিল করতে অনুরোধ করেছিলেন অলি আহাদ। কিন্তু মওলানা ভাসানী তাঁর সফরসূচি বাতিল না করায় এবং আতাউর রহমান খান আইন ব্যবসার প্রয়োজনে ময়মনসিংহ কোর্টে মক্কেলের পক্ষে মামলা পরিচালনায় ব্যস্ত থাকায় তাঁরা সেই গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত ছিলেন না।

সভায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছিলেন, ‘আমাদের পার্টি হঠকারী কিছু করার বিপক্ষে। তবে আমাদের আন্দোলনের পথ ত্যাগ করা ভুল হবে। আমাদের পার্টি কোন পক্ষ অবলম্বন না করে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে ভোট না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকার নীতি অবলম্বন করবে এবং ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকবে।’

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ সদস্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব এবং শাসকদের আগামী দিনে পাকিস্তানব্যাপী নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দেন। একটি হলের ছাত্র প্রতিনিধি, মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রতিনিধি ও যুবলীগের সম্পাদক যুক্তির ভিত্তিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলনকে জয়যুক্ত করার পক্ষে জোরালোভাবে মত ব্যক্ত করেন।

ভোটাভুটিতে দেখা গেল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ভোট পড়েছে ১১ জনের, ভঙ্গ করার পক্ষে ভোট পড়ে ৪ জনের। আব্দুল মতিনের বক্তব্যের ভিত্তিতে ভোটাভুটির মাধ্যমে যে দুটি মত প্রকাশ পায়, তাকে সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা না করে পরদিনের নির্ধারিত ছাত্রসমাবেশে সর্বদলীয় কমিটির সিদ্ধান্ত বলে ঘোষণা দিয়ে ছাত্রদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১১ সদস্যের মতের পক্ষে কথা বলার জন্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে এবং চার সদস্যের অন্য মতের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বক্তব্য বলার জন্য আবদুল মতিনকে নির্বাচন করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে, নাকি হবে না—এই দোদুল্যমানতায় রাত কেটে যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত