চিররঞ্জন সরকার
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস হয়ে গেল। এই সময়ে নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে দেশ চলছে। বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অদল-বদল চলছে। কিন্তু যতটা দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তনগুলো হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। এর ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দেশের নাগরিকেরা।
এই মুহূর্তে ঢাকা নগরীর মানুষেরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এর ছয় সপ্তাহের মাথায় সরিয়ে দেওয়া হয় কাউন্সিলরদেরও। নাগরিক সেবা সচল রাখতে ১৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে সরকার, যেখানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা রয়েছেন।
তাঁদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনগুলো অকার্যকর রয়েছে। করপোরেশনের নাগরিক সেবা প্রদানকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত রয়েছেন। এ কারণে ডেঙ্গু জ্বরবাহী এডিস মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধি না থাকায় ঢাকাসহ সারা দেশের নগর এলাকায় নাগরিক সেবা কার্যক্রম তলানিতে পৌঁছেছে।
ডেঙ্গুর মৌসুমে মশকনিধন ছাড়াও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিসান সনদ, নাগরিক সনদ, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি, সামাজিক শৃঙ্খলা, রাস্তাঘাট মেরামত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সেবায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে যেকোনো সমস্যায় পড়লে নাগরিকেরা ছুটে যেতেন কাউন্সিলরদের কাছে। এমনকি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনুপস্থিতিতে অনেক কাউন্সিলর সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁদের সবাইকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করায় একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। সরকারি আমলাদের দিয়ে যে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা নাগরিক সেবা প্রদানে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। পালন করার কথাও না। সরকারি কর্মকর্তারা কখনো জনপ্রতিনিধির বিকল্প হতে পারেন না।
জনপ্রতিনিধির মূল ভিত্তিই হলো জনগণ। তাঁদের সঙ্গে জনগণের সরাসরি সম্পর্ক থাকে, জবাবদিহি থাকে। জনবিচ্ছিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করার বিষয়টি বাস্তবায়ন করা তাই সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্ট।
অথচ সরকারের উচিত ছিল মেয়র-কাউন্সিলরদের মাধ্যমে নাগরিক সেবা সচল রেখে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সেটা করা হয়নি। এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিদিনই মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিনে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১৬ জন। সিটি করপোরেশনসহ কার্যত নাগরিক সেবা প্রদানকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত থাকায় ডেঙ্গু জ্বরবাহী এডিস মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩০ হাজার রোগীর মধ্যে গেল মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭ জন। মারা যাওয়া ১৬৩ জনের ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে গত মাসে। এর মধ্যে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ডিএসসিসি এলাকায়। মশকনিধন কাজে গাফিলতির কারণেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর এ সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী।
শুধু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেই নয়, জনপ্রতিনিধি না থাকায় সিটি করপোরেশনগুলোতে একটা হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করছেন না। ওয়ার্ড পর্যায়ে রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকছে। কোথাও মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। তাদের বলারও কেউ নেই। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নাগরিক সনদসহ অন্য সেবা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ২০টি জোনে ২০ জন কর্মকর্তার এ দায়িত্ব পালন করার কথা। এ দুই সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড রয়েছে ১২৯টি। একেকটি জোনে দশ-বারো জন কাউন্সিলরের কাজ একজন নির্বাহী কর্মকর্তা কীভাবে সামলাবেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। নাগরিকেরা তাঁদের চেনেন না, তাঁরাও নাগরিকদের চেনেন না। নাগরিকেরা কোন জায়গা থেকে সেবা নেবেন, সেটাও উল্লেখ নেই। ফলে মানুষ কেবল হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এবার ডেঙ্গু মশা বৃদ্ধির পিকটাইমে মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়নি। প্রথমে আন্দোলনের কারণে, পরে সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরদের বাদ দেওয়ার কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। ওয়ার্ডভিত্তিক এডিস মশা নিধনে টিম গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও পরিচ্ছন্ন সিটি গড়ার কার্যক্রমে যুক্ত করা। মশার বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ও সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করা। মশা মারতে না পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। মশা মারার কাজে মনোনিবেশ না করলে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা যাবে না।
প্রসঙ্গত, ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে মূলত দুই ধরনের সংক্রমণ হয়—সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর ও মারণাত্মক ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু সিনড্রোম শক। যদিও চটজলদি রোগ নির্ণয় এবং হাসপাতালে আপৎকালীন শুশ্রূষার মাধ্যমে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো যাচ্ছে, তবু মৃত্যু ঘটছে। কারণ, আজ পর্যন্ত এই ধরনের জ্বরের সঠিক চিকিৎসা বেরোয়নি। মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। এপিডেমিয়োলজির তত্ত্ব বলছে, অনুকূল পরিবেশে (ঠিক বর্ষা-পরবর্তী সময়ে) এ রোগের ভাইরাস মশা দ্বারা মানবদেহে বসতি বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটায়। যেহেতু ডেঙ্গু রোগের সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি বা প্রতিষেধক টিকা এখনো সেভাবে আবিষ্কার হয়নি, তাই মশকনিধনযজ্ঞ বিনা আর উপায় নেই। আর ঠিক এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কারণ, মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। ডেঙ্গুকে জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে, যার ব্যাপ্তি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বহুগুণ বেশি। জনস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, ডেঙ্গুর অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। মশক নিধনে ক্রমাগত ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং অবশ্যই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়া। জনসচেতনতার অভাবও এর জন্য কম দায়ী নয়।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাও ডেঙ্গু বিস্তারে ভূমিকা পালন করছে। নগরায়ণের নীতি ও রূপরেখায় এবং নগর পরিচালনায় জনস্বাস্থ্যের দিকটি আমাদের দেশে অত্যন্ত অবহেলিত। যেকোনো মশাবাহিত রোগের উৎপত্তি সাধারণত শহরকেন্দ্রিক, কারণ শহরের জনবহুল, ঘিঞ্জি, অপরিষ্কার পরিবেশ মশা জন্মানো ও দ্রুত রোগ সংক্রমণের জন্য আদর্শ। ডেঙ্গু রোধেও তাই জনস্বাস্থ্যমুখী নগর-পরিকল্পনা ও পরিচালনা পদ্ধতি থাকা চাই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যনীতি ক্রমেই অভিমুখ পাল্টেছে। এখন তা চিকিৎসাকেন্দ্রিক। জনস্বাস্থ্য সেখানে উপেক্ষিত। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার কিংবা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা মোটেও আশাপ্রদ নয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন সার্বক্ষণিক ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকে। সেখানে সিটি করপোরেশনের ১৫ থেকে ২০ জন কর্মী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪টি ওয়ার্ডে কাজ করেন। একটি দলের কাজ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, অন্যটির কাজ এলাকায় ডেঙ্গু মশার জন্ম নিতে পারে—এমন জমানো পানি শনাক্ত করা। ৮ থেকে ১০ জনের আরেকটি দলকে প্রস্তুত রাখা হয় জরুরি সেবার জন্য। খবর পেয়ে তারা গিয়ে এডিস মশার জন্মস্থল ধ্বংস করে। যদি কোনো ভবনে জমানো পানি দেখতে পায়, যেখানে এডিস মশার জন্ম হতে পারে, তা হলে সেই ভবনের মালিককে ১ লাখ রুপি জরিমানা করা হয়।
পানি সরানোর খরচও জুড়ে দেওয়া হয় করের টাকার সঙ্গে। নগরীর ১৪৪টি ওয়ার্ডের সবগুলোতেই ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে ডেঙ্গু বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেসব তথ্য দ্রুত মশা নিধনকারী দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই তারা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ নেই।
এলাকা বা মহল্লাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা, বাসার ছাদ, বাড়ির আশপাশ, দুই বাড়ির সীমানায় নোংরা জায়গাগুলো পরিষ্কার করার কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ উল্লিখিত সব স্থান, সেপটিক ট্যাংক, ঢাকা জলাধার বা নর্দমার মশার বংশ নাশ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন না হলে ডেঙ্গুর মৃত্যুমিছিল আটকানো অসম্ভব। সুতরাং জনগণ ও সিটি করপোরেশন—উভয়েরই সমান সচেতনতা জরুরি।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস হয়ে গেল। এই সময়ে নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে দেশ চলছে। বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অদল-বদল চলছে। কিন্তু যতটা দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তনগুলো হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। এর ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দেশের নাগরিকেরা।
এই মুহূর্তে ঢাকা নগরীর মানুষেরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এর ছয় সপ্তাহের মাথায় সরিয়ে দেওয়া হয় কাউন্সিলরদেরও। নাগরিক সেবা সচল রাখতে ১৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে সরকার, যেখানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা রয়েছেন।
তাঁদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনগুলো অকার্যকর রয়েছে। করপোরেশনের নাগরিক সেবা প্রদানকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত রয়েছেন। এ কারণে ডেঙ্গু জ্বরবাহী এডিস মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধি না থাকায় ঢাকাসহ সারা দেশের নগর এলাকায় নাগরিক সেবা কার্যক্রম তলানিতে পৌঁছেছে।
ডেঙ্গুর মৌসুমে মশকনিধন ছাড়াও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিসান সনদ, নাগরিক সনদ, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি, সামাজিক শৃঙ্খলা, রাস্তাঘাট মেরামত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সেবায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে যেকোনো সমস্যায় পড়লে নাগরিকেরা ছুটে যেতেন কাউন্সিলরদের কাছে। এমনকি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনুপস্থিতিতে অনেক কাউন্সিলর সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁদের সবাইকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করায় একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। সরকারি আমলাদের দিয়ে যে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা নাগরিক সেবা প্রদানে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। পালন করার কথাও না। সরকারি কর্মকর্তারা কখনো জনপ্রতিনিধির বিকল্প হতে পারেন না।
জনপ্রতিনিধির মূল ভিত্তিই হলো জনগণ। তাঁদের সঙ্গে জনগণের সরাসরি সম্পর্ক থাকে, জবাবদিহি থাকে। জনবিচ্ছিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করার বিষয়টি বাস্তবায়ন করা তাই সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্ট।
অথচ সরকারের উচিত ছিল মেয়র-কাউন্সিলরদের মাধ্যমে নাগরিক সেবা সচল রেখে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সেটা করা হয়নি। এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিদিনই মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিনে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১৬ জন। সিটি করপোরেশনসহ কার্যত নাগরিক সেবা প্রদানকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত থাকায় ডেঙ্গু জ্বরবাহী এডিস মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩০ হাজার রোগীর মধ্যে গেল মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭ জন। মারা যাওয়া ১৬৩ জনের ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে গত মাসে। এর মধ্যে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ডিএসসিসি এলাকায়। মশকনিধন কাজে গাফিলতির কারণেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর এ সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী।
শুধু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেই নয়, জনপ্রতিনিধি না থাকায় সিটি করপোরেশনগুলোতে একটা হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করছেন না। ওয়ার্ড পর্যায়ে রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকছে। কোথাও মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। তাদের বলারও কেউ নেই। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নাগরিক সনদসহ অন্য সেবা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ২০টি জোনে ২০ জন কর্মকর্তার এ দায়িত্ব পালন করার কথা। এ দুই সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড রয়েছে ১২৯টি। একেকটি জোনে দশ-বারো জন কাউন্সিলরের কাজ একজন নির্বাহী কর্মকর্তা কীভাবে সামলাবেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। নাগরিকেরা তাঁদের চেনেন না, তাঁরাও নাগরিকদের চেনেন না। নাগরিকেরা কোন জায়গা থেকে সেবা নেবেন, সেটাও উল্লেখ নেই। ফলে মানুষ কেবল হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এবার ডেঙ্গু মশা বৃদ্ধির পিকটাইমে মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়নি। প্রথমে আন্দোলনের কারণে, পরে সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরদের বাদ দেওয়ার কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। ওয়ার্ডভিত্তিক এডিস মশা নিধনে টিম গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও পরিচ্ছন্ন সিটি গড়ার কার্যক্রমে যুক্ত করা। মশার বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ও সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করা। মশা মারতে না পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। মশা মারার কাজে মনোনিবেশ না করলে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা যাবে না।
প্রসঙ্গত, ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে মূলত দুই ধরনের সংক্রমণ হয়—সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর ও মারণাত্মক ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু সিনড্রোম শক। যদিও চটজলদি রোগ নির্ণয় এবং হাসপাতালে আপৎকালীন শুশ্রূষার মাধ্যমে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো যাচ্ছে, তবু মৃত্যু ঘটছে। কারণ, আজ পর্যন্ত এই ধরনের জ্বরের সঠিক চিকিৎসা বেরোয়নি। মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। এপিডেমিয়োলজির তত্ত্ব বলছে, অনুকূল পরিবেশে (ঠিক বর্ষা-পরবর্তী সময়ে) এ রোগের ভাইরাস মশা দ্বারা মানবদেহে বসতি বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটায়। যেহেতু ডেঙ্গু রোগের সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি বা প্রতিষেধক টিকা এখনো সেভাবে আবিষ্কার হয়নি, তাই মশকনিধনযজ্ঞ বিনা আর উপায় নেই। আর ঠিক এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কারণ, মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। ডেঙ্গুকে জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে, যার ব্যাপ্তি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বহুগুণ বেশি। জনস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, ডেঙ্গুর অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। মশক নিধনে ক্রমাগত ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং অবশ্যই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়া। জনসচেতনতার অভাবও এর জন্য কম দায়ী নয়।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাও ডেঙ্গু বিস্তারে ভূমিকা পালন করছে। নগরায়ণের নীতি ও রূপরেখায় এবং নগর পরিচালনায় জনস্বাস্থ্যের দিকটি আমাদের দেশে অত্যন্ত অবহেলিত। যেকোনো মশাবাহিত রোগের উৎপত্তি সাধারণত শহরকেন্দ্রিক, কারণ শহরের জনবহুল, ঘিঞ্জি, অপরিষ্কার পরিবেশ মশা জন্মানো ও দ্রুত রোগ সংক্রমণের জন্য আদর্শ। ডেঙ্গু রোধেও তাই জনস্বাস্থ্যমুখী নগর-পরিকল্পনা ও পরিচালনা পদ্ধতি থাকা চাই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যনীতি ক্রমেই অভিমুখ পাল্টেছে। এখন তা চিকিৎসাকেন্দ্রিক। জনস্বাস্থ্য সেখানে উপেক্ষিত। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার কিংবা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা মোটেও আশাপ্রদ নয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন সার্বক্ষণিক ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকে। সেখানে সিটি করপোরেশনের ১৫ থেকে ২০ জন কর্মী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪টি ওয়ার্ডে কাজ করেন। একটি দলের কাজ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, অন্যটির কাজ এলাকায় ডেঙ্গু মশার জন্ম নিতে পারে—এমন জমানো পানি শনাক্ত করা। ৮ থেকে ১০ জনের আরেকটি দলকে প্রস্তুত রাখা হয় জরুরি সেবার জন্য। খবর পেয়ে তারা গিয়ে এডিস মশার জন্মস্থল ধ্বংস করে। যদি কোনো ভবনে জমানো পানি দেখতে পায়, যেখানে এডিস মশার জন্ম হতে পারে, তা হলে সেই ভবনের মালিককে ১ লাখ রুপি জরিমানা করা হয়।
পানি সরানোর খরচও জুড়ে দেওয়া হয় করের টাকার সঙ্গে। নগরীর ১৪৪টি ওয়ার্ডের সবগুলোতেই ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে ডেঙ্গু বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেসব তথ্য দ্রুত মশা নিধনকারী দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই তারা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ নেই।
এলাকা বা মহল্লাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা, বাসার ছাদ, বাড়ির আশপাশ, দুই বাড়ির সীমানায় নোংরা জায়গাগুলো পরিষ্কার করার কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ উল্লিখিত সব স্থান, সেপটিক ট্যাংক, ঢাকা জলাধার বা নর্দমার মশার বংশ নাশ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন না হলে ডেঙ্গুর মৃত্যুমিছিল আটকানো অসম্ভব। সুতরাং জনগণ ও সিটি করপোরেশন—উভয়েরই সমান সচেতনতা জরুরি।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে