মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার: স্বপ্ন পুড়ল ৩১ হাজার কর্মীর

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
আপডেট : ০১ জুন ২০২৪, ০২: ৪২
Thumbnail image

ভিসা ও ছাড়পত্র পেয়েও উড়োজাহাজের টিকিটসংকটে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হলো প্রায় ৩১ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো উড়োজাহাজে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে এবং বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করলেও শেষরক্ষা হয়নি। 

জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা এ জন্য দায়ী করেছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি ও উদাসীনতাকে। তাঁরা বলছেন, গত মার্চেই মালয়েশিয়া বিদেশি কর্মী প্রবেশের জন্য গতকাল ৩১ মে সময়সীমা বেঁধে দিলেও মন্ত্রণালয় এ নিয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি দেয় ১৬ মে। ফলে শেষ মুহূর্তে উড়োজাহাজের টিকিটের তীব্র সংকট তৈরি হয়।

সময়সীমার শেষ দিনে গতকাল শুক্রবার মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ চেষ্টা করতে টিকিট ছাড়াই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় জমান হাজারো মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে না পেরে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরেও ছিল বাংলাদেশি কর্মীদের উপচে পড়া ভিড়। শেষ দিনে দেশটিতে ঢুকতে পারার আনন্দ থাকলেও ইমিগ্রেশন পার হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান গতকাল বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রবেশের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আরও আগে জানলে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিতে পারত। বর্তমানে বিমানের হজ ফ্লাইট চলছে। তারপরও প্রবাসীদের কুয়ালালামপুর নেওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে। 

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। গত বছর সেখানে গেছেন ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জন কর্মী। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গেছেন ৪৪ হাজার ৭২৭ জন। চার বছর পর ২০২২ সালে দেশটির শ্রমবাজার খুলেছিল। মালয়েশিয়া সরকার গত মার্চেই ঘোষণা করে, ৩১ মের (গতকাল) পর আর কোনো নতুন বিদেশি শ্রমিক দেশটিতে ঢুকতে পারবেন না। সে হিসাবে আজ থেকে আবার অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হলো এই শ্রমবাজার। 

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়ালালামপুর নিয়মিত ৯টি ফ্লাইট যায়। পাশাপাশি সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে ঢাকা-কুয়ালালামপুর পথে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ। সব ফ্লাইট মিলিয়ে গতকাল দেড় হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছেন। 

গতকাল শেষ দিনে সকাল থেকে রিক্রুটিং এজেন্সির আশ্বাসে উড়োজাহাজের টিকিট ছাড়াই বিমানবন্দরে ছিলেন হাজারো মালয়েশিয়াগামী। তাঁদের কেউ কেউ দুই-তিন দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন। শাহীন আলম নামের একজন বলেন, ‘এজেন্সির লোকজন বলেছেন যেকোনো সময় টিকিটের ব্যবস্থা হতে পারে। তাই সব সময় যেন বিমানবন্দরের পাশেই থাকি। এ জন্য ভোর থেকে অপেক্ষা করছি।’

ভিসা পাওয়া কয়েকজন আজকের পত্রিকাকে জানান, রিক্রুটিং এজেন্সির আশ্বাসে কয়েক দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন। বিমান বিশেষ ফ্লাইটের ঘোষণা দিলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিমানবন্দরে টিকিট দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অনেককে ডেকে এনেছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও টিকিট পাননি। রিক্রুটিং এজেন্সিরও কাউকে পাননি।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সন্ধ্যায় বিশেষ ফ্লাইটের জন্য জনপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করে ৭৩ হাজার ৬১৬ টাকা।

মালয়েশিয়ায় পৌঁছাতে পারলেও অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ থেকে সেখানে পৌঁছেছেন প্রায় ২০ হাজার কর্মী। এই বিপুলসংখ্যক কর্মীর কাগজপত্র নিশ্চায়ন করতে পেরিয়ে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।	ছবি: সংগৃহীতবিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. আল মাসুদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের বিশেষ অতিরিক্ত ফ্লাইটে ২৭১ জন যাত্রী পরিবহন করা হয়।

ভিসা হওয়ার পর কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়া যেতে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সিদ্ধান্ত ছিল ২১ মের পর বিএমইটি আর কোনো ছাড়পত্র দেবে না। তবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধা পর্যন্ত ছাড়পত্র দেয় বিএমইটি। ২১ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ১ হাজার ১১২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। 

বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। মন্ত্রণালয় থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

১৬ মে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বর্তমান কোটার আওতায় মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশসহ ১৪টি কর্মী প্রেরণকারী দেশ থেকে চলতি বছরের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়া প্রবেশের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। মন্ত্রণালয়ের এ ঘোষণার পরই মূলত চাহিদা বাড়ে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের টিকিটের। ২০ মে থেকে বিষয়টি জানাজানি হলে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার হিড়িক পড়ে। টিকিটসংকট দেখা দেয়।

ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস, এয়ার এশিয়া ও বাটিক এয়ারের। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে সিঙ্গাপুর হয়ে এবং থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক হয়েও মালয়েশিয়া যান বাংলাদেশি কর্মীরা।

চাহিদা বাড়ায় গত এক মাস ধরে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে উড়োজাহাজে আসন সক্ষমতাও বাড়িয়েছে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো। নিয়মিত ফ্লাইটের পাশাপাশি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করেছে বিমান বাংলাদেশ ও এয়ার এশিয়া। বেসরকারি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসও এ রুটে বড় উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসন সক্ষমতা দ্বিগুণ করেছে। টিকিটের চাহিদা বাড়ায় কম্বোডিয়ার সরকারি এয়ারলাইনস কম্বোডিয়া অ্যাংকর এয়ারকে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ায় চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। কিন্তু এসব চেষ্টার পরও স্বপ্নপূরণ হলো না প্রায় ৩১ হাজার মানুষের।

সিলভ্যারিনা ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মানি উল্লাহ জানান, ভিসা হলেও টিকিট জটিলতার কারণে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি প্রায় ৩১ হাজার বাংলাদেশি কর্মী।

সরকারের উদাসীনতায় এই সংকট তৈরি হয়েছে জানিয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এক মাসের মধ্যে মালয়েশিয়ায় লোক যেতে হবে ৫০-৬০ হাজার। এটা নিয়ে সরকারের উদাসীনতার কারণে কোনো প্রস্তুতি নেই, আলোচনা নেই। এটা আমাদের মালয়েশিয়াগামী প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্ভাগ্য।’ 

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় অনিয়মের কারণে চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে বাংলাদেশিদের জন্য আবার দেশটির শ্রমবাজার খোলে। তখন আবারও চক্র সক্রিয় হয়। 

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-১-এ গতকাল ছিল ঢাকা থেকে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের উপচে পড়া ভিড়। যাত্রীদের চাপে হিমশিম খায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। বাড়তি চাপ সামাল দিতে বিমানবন্দরের নিয়মিত কর্মীদের সঙ্গে যুক্ত হন দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা। তবু যাত্রীদের ব্যবস্থাপনায় লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। 

জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে যা হচ্ছে, তা দুর্বৃত্তপনা। এখানে সিন্ডিকেটের জয়জয়কার। এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না, ভিসার মেয়াদ থাকার পরও ওই দেশে ঢুকতে পারবে না। দুই দেশের এখানে দায় রয়েছে। এতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের জয় হয়েছে, হেরেছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। অথচ এই প্রবাসী শ্রমিকদের টাকায় দেশ চলে। আমরা চাই সরকার এ ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশন করে প্রকৃত সত্য খতিয়ে দেখুক। সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শপথ নিয়েই বাইডেনের নীতি বাতিল ও ১০০ নির্বাহী আদেশের ঘোষণা ট্রাম্পের

আয়রন রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট পরবে পুলিশ

বিচার বিভাগের সমস্যা তুলে ধরলেন বিচারক, আনিসুল হক বললেন ‘সমস্যা কেটে যাবে’

শাহজালাল বিমানবন্দরে চাকরি নেননি মনোজ কুমার, বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে বিভ্রান্তি

সিলেটে রিসোর্টে ৮ তরুণ-তরুণীকে জোর করে বিয়ে, কিছু না করেই ফিরে এল পুলিশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত