আনু মুহাম্মদ
সম্প্রতি একজন মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের নদীগুলো অনেক প্রশস্ত, আমাদের এত প্রশস্ত নদীর প্রয়োজন নেই। সেগুলো কেটে সরু করতে হবে, রিসোর্ট ও রাস্তা তৈরি এবং নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য নদীতীর থেকে জমি পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, মাঝেমধ্যে আমাদের মন্ত্রীরা তো দায়িত্বজ্ঞানহীন নানা রকম বক্তব্য দেন; সুতরাং এগুলোকে গুরুত্ব না দিলেও চলে। কিন্তু পরে দেখলাম, এগুলো নিছক মন্ত্রীর দায়িত্বহীন মন্তব্য নয়, এটা সর্বনাশা পরিকল্পনার অংশ। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর নাব্যতা এবং জলপ্রবাহ বাড়ানোর নামে এগুলোকে কেটে সরু করার বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, মেঘনা—সব এই আগ্রাসী পরিকল্পনার মধ্যে আছে। সর্বশেষ, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যমুনা নদী কেটে সরু করার জন্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক! ঋণ করে নদী শেষ করার মহাযজ্ঞ!
এসব প্রকল্পের অনেক দিকের মধ্যে অপরিহার্যভাবে থাকে প্রকল্প নিয়ে বহু রকম ‘স্টাডি’, বিদেশ সফর, কর্মশালা, সেমিনার এবং নির্মাণসংক্রান্ত কাজ। এসব প্রকল্পের সঙ্গে তাই দেশি-বিদেশি অনেকের স্বার্থ যুক্ত। এ রকম অনেকের জন্য এসব প্রকল্প তাই সুখবরই বটে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি এসব প্রকল্পের ব্যাপারে উদার, কেননা তাদের সঙ্গেই যুক্ত আছে অনেক সুবিধাভোগী। যমুনা ছাড়াও ব্রহ্মপুত্র নদের চারপাশে আরও একটি প্রকল্পও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
আমরা বর্তমানে তিস্তা নদীর পানি থেকে বঞ্চিত, বাংলাদেশের জন্য ন্যায্য সমাধান হওয়ার মতো কোনো পানিবণ্টন চুক্তি এখনো প্রণয়নই হয়নি, স্বাক্ষরের তো প্রশ্নই নেই। পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে, তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবা ছাড়াও আরও বহুসংখ্যক বাঁধ তৈরি করেছে। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার নদীর পানি সরাতে খাল খননের পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশের দিকে এমনিতেই শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ কম থাকে। তার ওপর গজলডোবাসহ বিভিন্ন বাঁধ একটা বাধা। এর প্রধান শিকার প্রাণপ্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তার তীরে বসবাসকারী মানুষজন। অন্যদিকে বর্ষাকালে ভারত বাঁধ খুলে দিলে এখানে হঠাৎ করে পানির প্রবাহ বেড়ে যায়। তিস্তায় এই বর্ধিত পানিপ্রবাহের কারণে তীর উপচে পড়ে এবং এই অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আর এ বিষয়ে আলোচনাও স্থবির হয়ে আছে।
সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে বিষয়টি সমাধান করার। পরিস্থিতি এমন নয় যে কেন্দ্রীয় সরকার সব সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অখুশি করে এমন কিছু করে না। বহু কিছুই করছে, যেগুলো মমতাবিরোধী। সে জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এগোচ্ছে না, এ রকম যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের উদ্যোগে আলোচনা করা যেত; দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় বৈঠক হতে পারত, জাতিসংঘে বিষয়টি নেওয়া যেত, কিন্তু সে রকম কিছুই করা হয়নি। এসবের পরিবর্তে, চীনের সম্পৃক্ততায় দেশের তিস্তা অংশে একটি বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর ফলে তিস্তার তীরকে আরও সংকীর্ণ করা হবে। নদীটিতে ড্রেজিং করা হবে এবং দুই পাশ সরু করে রিসোর্ট তৈরি করা হবে। এটাকেই বলা হচ্ছে বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প, তার জন্য বাজেটও বিরাট!
মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নিয়েও পরিকল্পনা আছে। তাদের মধ্যে ভারতের সঙ্গে অংশীদারত্বে আছে এবং বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও জড়িত। বাংলাদেশের অনেক পানি বিশেষজ্ঞও এর সঙ্গে কাজ করছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে সংস্থাটির বাংলাদেশের নদীগুলোতে জলপ্রবাহ নিশ্চিত করা, নদীগুলোর অবস্থা দেখাশোনা করা এবং নদীভাঙনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব, সেই পানি উন্নয়ন বোর্ডই নদীবিধ্বংসী এসব প্রকল্পের প্রধান বাস্তবায়নকারী।
নদী আমাদের অস্তিত্বের অংশ। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানিসম্পদ। আমাদের কৃষি, জীবন-জীবিকা, মাটির উর্বরতা, জীববৈচিত্র্য—সবই নদীর ওপর নির্ভরশীল। আর এসব নদী এখন আক্রমণের মুখে। এই আক্রমণ তিন দিক থেকে আসছে। প্রথমত, ভারতের দিকে একের পর এক বাঁধ, সেই সঙ্গে নদীসংযোগ প্রকল্প; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিজস্ব প্রকল্প, যা উন্নয়নের নামে হাতে নেওয়া হচ্ছে। কিছু প্রকল্প নদীর তল ভরাট করছে, কিছু স্লুইসগেট দিয়ে জলপ্রবাহ ব্যাহত করছে এবং কিছু প্রকল্প নদীর তীর বরাবর নির্মাণ করায় নদীর পানির অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে কয়লা ও পারমাণবিক প্রকল্প এবং অন্যান্য অনুরূপ উদ্যোগ নদীগুলোর জন্য অভিশাপ তৈরি করছে। তৃতীয়ত, আক্রমণ আসছে বাংলাদেশের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের কাছ থেকে, যারা সরকারঘনিষ্ঠ। তারা নদী দখল করে, নদী দূষিত করে ড্রেনে পরিণত করছে। এগুলোর সম্মিলিত ফলাফল হলো নদী বিনাশ। চোখের সামনে এসব পথে খুন হয় নদী।
আশির দশকের শেষের দিকে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে বিশাল প্রকল্পের চুক্তি করা হয়েছিল। জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র বরাবর ৪ হাজার কিলোমিটার প্রাচীর ও বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা ছিল এই প্রকল্পে। কোন বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ব্যাপার এই পরিকল্পনাগুলো করতে পরিচালিত করেছিল, তা বোঝা কঠিন। এর পেছনে আসলে প্রধান চালিকা শক্তি ছিল কিছু গোষ্ঠীর আর্থিক লাভ, যে পরিকল্পনাগুলো যত বড় হয়, তত বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়। এসবের সঙ্গে যুক্ত ছিল নির্মাণ সংস্থা, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, পরামর্শদাতা, বিশেষজ্ঞ, ঋণ প্রদানকারী সংস্থা ইত্যাদি। এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারেনি; কারণ, সে সময় এর বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন নামে একই কাজ করে আসছে। এ মুহূর্তে যে ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা মূলত একই দৃষ্টিভঙ্গির। অতীতের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোনো চেষ্টা সরকার বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেখা যায় না।
ভারতের সঙ্গে নদীবিরোধ নিষ্পত্তির একটি সহজ উপায় সরকারের কাছে ছিল। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক একটি আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশন গৃহীত হয়। সেই কনভেনশনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, উজানের নিচের দিকের দেশগুলোর পানির অধিকার রয়েছে। উজানের দেশ সেই অধিকার হরণ করতে পারবে না। বাংলাদেশ এখনো এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, ভারতও করেনি। ভারতের পক্ষে এটি অনুসমর্থন না করার কারণ হলো, তারা তো উজানের দেশ, অপরাধ করে যাচ্ছে, তার অসুবিধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্রুত কনভেনশনটিতে স্বাক্ষর করা দরকার ছিল নিজের অস্তিত্বের জন্য। সেটি করার পর বাংলাদেশ বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে পারত। তিস্তা, মেঘনা, যমুনা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং অন্য সব নদ-নদীর জলপ্রবাহ নিশ্চিত করার এটি একটি সহজ উপায়; বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বহু বছর ধরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর সমাধান হয়নি, জাতিসংঘের কনভেনশন দিয়েই সমাধান হতে পারত।
আজ কেউ যদি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একটু চোখ মেলে তাকান, দেখবেন, অনেক সেতু পার হচ্ছেন, যেগুলোর নিচে কোনো পানি নেই, নদীর ধ্বংসাবশেষ আছে। দেশের অভ্যন্তরে তাকালে বোঝা যায়, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর একটি বিপজ্জনক দিক নদীগুলো ধ্বংসের চরিত্র। নদী ভরাট, রিসোর্ট নির্মাণ এবং পর্যটন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের জিডিপি বাড়াতে পারে। কিন্তু যখন একটি নদীর স্বাভাবিক গতিপথে হস্তক্ষেপ করা হয়, তখন নদীটি মারা যায়। এরই মধ্যে অনেক নদীকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এর ক্ষতি অপূরণীয়।
এর থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নদী-প্রশ্ন সব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক আলোচনার অগ্রভাগে রাখতে হবে। যাঁরা বাংলাদেশের জনগণের অধিকার, বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সামান্যতম চিন্তা করেন, তাঁদের অবশ্যই নদীর জন্য ক্ষতিকর সব উন্নয়ন প্রকল্প, নদীর প্রতি আগ্রাসন এবং নদী দখলের বিরোধিতা করতে হবে। একদিকে আমরা দেখি, হাইকোর্টের রায়ে বলা হচ্ছে যে নদীগুলো জীবন্ত সত্তা; অন্যদিকে আমরা দেখছি এই জীবের ওপর বারবার আক্রমণ। সুতরাং এসবের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জোরালো প্রতিরোধ এখন বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি হওয়া দরকার। আর যাঁরা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত এবং তাঁদের সমর্থন দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে।
আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ
সম্প্রতি একজন মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের নদীগুলো অনেক প্রশস্ত, আমাদের এত প্রশস্ত নদীর প্রয়োজন নেই। সেগুলো কেটে সরু করতে হবে, রিসোর্ট ও রাস্তা তৈরি এবং নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য নদীতীর থেকে জমি পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, মাঝেমধ্যে আমাদের মন্ত্রীরা তো দায়িত্বজ্ঞানহীন নানা রকম বক্তব্য দেন; সুতরাং এগুলোকে গুরুত্ব না দিলেও চলে। কিন্তু পরে দেখলাম, এগুলো নিছক মন্ত্রীর দায়িত্বহীন মন্তব্য নয়, এটা সর্বনাশা পরিকল্পনার অংশ। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর নাব্যতা এবং জলপ্রবাহ বাড়ানোর নামে এগুলোকে কেটে সরু করার বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, মেঘনা—সব এই আগ্রাসী পরিকল্পনার মধ্যে আছে। সর্বশেষ, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যমুনা নদী কেটে সরু করার জন্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক! ঋণ করে নদী শেষ করার মহাযজ্ঞ!
এসব প্রকল্পের অনেক দিকের মধ্যে অপরিহার্যভাবে থাকে প্রকল্প নিয়ে বহু রকম ‘স্টাডি’, বিদেশ সফর, কর্মশালা, সেমিনার এবং নির্মাণসংক্রান্ত কাজ। এসব প্রকল্পের সঙ্গে তাই দেশি-বিদেশি অনেকের স্বার্থ যুক্ত। এ রকম অনেকের জন্য এসব প্রকল্প তাই সুখবরই বটে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি এসব প্রকল্পের ব্যাপারে উদার, কেননা তাদের সঙ্গেই যুক্ত আছে অনেক সুবিধাভোগী। যমুনা ছাড়াও ব্রহ্মপুত্র নদের চারপাশে আরও একটি প্রকল্পও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
আমরা বর্তমানে তিস্তা নদীর পানি থেকে বঞ্চিত, বাংলাদেশের জন্য ন্যায্য সমাধান হওয়ার মতো কোনো পানিবণ্টন চুক্তি এখনো প্রণয়নই হয়নি, স্বাক্ষরের তো প্রশ্নই নেই। পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে, তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবা ছাড়াও আরও বহুসংখ্যক বাঁধ তৈরি করেছে। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার নদীর পানি সরাতে খাল খননের পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশের দিকে এমনিতেই শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ কম থাকে। তার ওপর গজলডোবাসহ বিভিন্ন বাঁধ একটা বাধা। এর প্রধান শিকার প্রাণপ্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তার তীরে বসবাসকারী মানুষজন। অন্যদিকে বর্ষাকালে ভারত বাঁধ খুলে দিলে এখানে হঠাৎ করে পানির প্রবাহ বেড়ে যায়। তিস্তায় এই বর্ধিত পানিপ্রবাহের কারণে তীর উপচে পড়ে এবং এই অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আর এ বিষয়ে আলোচনাও স্থবির হয়ে আছে।
সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে বিষয়টি সমাধান করার। পরিস্থিতি এমন নয় যে কেন্দ্রীয় সরকার সব সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অখুশি করে এমন কিছু করে না। বহু কিছুই করছে, যেগুলো মমতাবিরোধী। সে জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এগোচ্ছে না, এ রকম যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের উদ্যোগে আলোচনা করা যেত; দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় বৈঠক হতে পারত, জাতিসংঘে বিষয়টি নেওয়া যেত, কিন্তু সে রকম কিছুই করা হয়নি। এসবের পরিবর্তে, চীনের সম্পৃক্ততায় দেশের তিস্তা অংশে একটি বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর ফলে তিস্তার তীরকে আরও সংকীর্ণ করা হবে। নদীটিতে ড্রেজিং করা হবে এবং দুই পাশ সরু করে রিসোর্ট তৈরি করা হবে। এটাকেই বলা হচ্ছে বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প, তার জন্য বাজেটও বিরাট!
মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নিয়েও পরিকল্পনা আছে। তাদের মধ্যে ভারতের সঙ্গে অংশীদারত্বে আছে এবং বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও জড়িত। বাংলাদেশের অনেক পানি বিশেষজ্ঞও এর সঙ্গে কাজ করছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে সংস্থাটির বাংলাদেশের নদীগুলোতে জলপ্রবাহ নিশ্চিত করা, নদীগুলোর অবস্থা দেখাশোনা করা এবং নদীভাঙনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব, সেই পানি উন্নয়ন বোর্ডই নদীবিধ্বংসী এসব প্রকল্পের প্রধান বাস্তবায়নকারী।
নদী আমাদের অস্তিত্বের অংশ। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানিসম্পদ। আমাদের কৃষি, জীবন-জীবিকা, মাটির উর্বরতা, জীববৈচিত্র্য—সবই নদীর ওপর নির্ভরশীল। আর এসব নদী এখন আক্রমণের মুখে। এই আক্রমণ তিন দিক থেকে আসছে। প্রথমত, ভারতের দিকে একের পর এক বাঁধ, সেই সঙ্গে নদীসংযোগ প্রকল্প; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিজস্ব প্রকল্প, যা উন্নয়নের নামে হাতে নেওয়া হচ্ছে। কিছু প্রকল্প নদীর তল ভরাট করছে, কিছু স্লুইসগেট দিয়ে জলপ্রবাহ ব্যাহত করছে এবং কিছু প্রকল্প নদীর তীর বরাবর নির্মাণ করায় নদীর পানির অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে কয়লা ও পারমাণবিক প্রকল্প এবং অন্যান্য অনুরূপ উদ্যোগ নদীগুলোর জন্য অভিশাপ তৈরি করছে। তৃতীয়ত, আক্রমণ আসছে বাংলাদেশের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের কাছ থেকে, যারা সরকারঘনিষ্ঠ। তারা নদী দখল করে, নদী দূষিত করে ড্রেনে পরিণত করছে। এগুলোর সম্মিলিত ফলাফল হলো নদী বিনাশ। চোখের সামনে এসব পথে খুন হয় নদী।
আশির দশকের শেষের দিকে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে বিশাল প্রকল্পের চুক্তি করা হয়েছিল। জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র বরাবর ৪ হাজার কিলোমিটার প্রাচীর ও বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা ছিল এই প্রকল্পে। কোন বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ব্যাপার এই পরিকল্পনাগুলো করতে পরিচালিত করেছিল, তা বোঝা কঠিন। এর পেছনে আসলে প্রধান চালিকা শক্তি ছিল কিছু গোষ্ঠীর আর্থিক লাভ, যে পরিকল্পনাগুলো যত বড় হয়, তত বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়। এসবের সঙ্গে যুক্ত ছিল নির্মাণ সংস্থা, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, পরামর্শদাতা, বিশেষজ্ঞ, ঋণ প্রদানকারী সংস্থা ইত্যাদি। এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারেনি; কারণ, সে সময় এর বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন নামে একই কাজ করে আসছে। এ মুহূর্তে যে ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা মূলত একই দৃষ্টিভঙ্গির। অতীতের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোনো চেষ্টা সরকার বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেখা যায় না।
ভারতের সঙ্গে নদীবিরোধ নিষ্পত্তির একটি সহজ উপায় সরকারের কাছে ছিল। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক একটি আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশন গৃহীত হয়। সেই কনভেনশনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, উজানের নিচের দিকের দেশগুলোর পানির অধিকার রয়েছে। উজানের দেশ সেই অধিকার হরণ করতে পারবে না। বাংলাদেশ এখনো এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, ভারতও করেনি। ভারতের পক্ষে এটি অনুসমর্থন না করার কারণ হলো, তারা তো উজানের দেশ, অপরাধ করে যাচ্ছে, তার অসুবিধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্রুত কনভেনশনটিতে স্বাক্ষর করা দরকার ছিল নিজের অস্তিত্বের জন্য। সেটি করার পর বাংলাদেশ বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে পারত। তিস্তা, মেঘনা, যমুনা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং অন্য সব নদ-নদীর জলপ্রবাহ নিশ্চিত করার এটি একটি সহজ উপায়; বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বহু বছর ধরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর সমাধান হয়নি, জাতিসংঘের কনভেনশন দিয়েই সমাধান হতে পারত।
আজ কেউ যদি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একটু চোখ মেলে তাকান, দেখবেন, অনেক সেতু পার হচ্ছেন, যেগুলোর নিচে কোনো পানি নেই, নদীর ধ্বংসাবশেষ আছে। দেশের অভ্যন্তরে তাকালে বোঝা যায়, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর একটি বিপজ্জনক দিক নদীগুলো ধ্বংসের চরিত্র। নদী ভরাট, রিসোর্ট নির্মাণ এবং পর্যটন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের জিডিপি বাড়াতে পারে। কিন্তু যখন একটি নদীর স্বাভাবিক গতিপথে হস্তক্ষেপ করা হয়, তখন নদীটি মারা যায়। এরই মধ্যে অনেক নদীকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এর ক্ষতি অপূরণীয়।
এর থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নদী-প্রশ্ন সব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক আলোচনার অগ্রভাগে রাখতে হবে। যাঁরা বাংলাদেশের জনগণের অধিকার, বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সামান্যতম চিন্তা করেন, তাঁদের অবশ্যই নদীর জন্য ক্ষতিকর সব উন্নয়ন প্রকল্প, নদীর প্রতি আগ্রাসন এবং নদী দখলের বিরোধিতা করতে হবে। একদিকে আমরা দেখি, হাইকোর্টের রায়ে বলা হচ্ছে যে নদীগুলো জীবন্ত সত্তা; অন্যদিকে আমরা দেখছি এই জীবের ওপর বারবার আক্রমণ। সুতরাং এসবের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জোরালো প্রতিরোধ এখন বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি হওয়া দরকার। আর যাঁরা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত এবং তাঁদের সমর্থন দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে।
আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে