Ajker Patrika

স্বাধীনতাসংগ্রাম: উত্তর প্রজন্মের উপলব্ধি

মারুফ রসূল
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, ১০: ৩২
স্বাধীনতাসংগ্রাম: উত্তর প্রজন্মের উপলব্ধি

মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রায় দুই দশক পর জন্ম নেওয়া প্রজন্মের একজন যখন স্বাধীনতাসংগ্রাম-সম্পর্কিত উপলব্ধির বয়ান লিপিবদ্ধ করতে বসে; তখন কেবল সময়ের কারণেই তার ব্যাসার্ধ যায় বেড়ে, পরিধি হয়ে পড়ে বিস্তৃত। তার ওপর সে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছিল এমন একসময়ে, যখন রাষ্ট্রজুড়ে রাজনীতির নামে চলছিল পুতুলের কুচকাওয়াজ। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের অমোঘ ইতিহাস তো আমাদের পরিচয়জ্ঞাপক একমাত্র অঙ্গুরীয়। রাজা দুষ্মন্ত যে অঙ্গুরীয় দেখে চিনেছিলেন শকুন্তলাকে; একাত্তরের সিলমোহর আঁকা সেই অঙ্গুরীয় দিয়েই বাংলার মানুষ নিজেকে তুলে ধরে গোটা বিশ্বে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রণম্য অগ্রজদের মতে, আমাদের প্রহরযাপন মোবাইলমন্থন দোষে দুষ্ট হলেও আমাদের উপলব্ধির সরলরেখায় যাবতীয় সচেতনতা নিয়ে আজও বিন্যস্ত থাকে মানুষ। তাই পঞ্জিকার পাতা ঘুরে মহান স্বাধীনতা দিবসের দিনটি যখন প্রতিবছর আমাদের চেতনার চক্ষুদানপর্ব সমাপ্ত করে, আমরা বুঝতে পারি, এই মহাসংগ্রাম ছিল আদতে মধ্যবিত্তের সংগ্রাম।

কিন্তু তৎক্ষণাৎ ধাক্কা খাই; কেননা, মিডিয়ার ম্যাকবেথ আর ক্লাসরুমের অধ্যাপকেরা আমাদের সামনে মধ্যবিত্তের এমন একটি সংজ্ঞা তৈরি করে দিয়েছেন যে মুক্তিসংগ্রামের মহাবাদলে মধ্যবিত্তের ইলশেগুঁড়ি খোঁজ করার সাহস আর আমাদের হয় না। অথচ আমরা যদি ইতিহাসনিষ্ঠ হই, তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সেমিনারনির্মিত মধ্যবিত্ত নয়, বরং ইতিহাসনির্মিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সর্বেসর্বা। গত শতাব্দীর শুরুতে অখণ্ড বাংলায় ঘটে যাওয়া নবজাগরণের ইতিহাসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী মোতাহার হোসেন বা কাজী আবদুল ওদুদের মতো স্বমহিমায় উজ্জ্বল ধ্রুব তারকাদের নাম যতখানি স্পষ্ট, লালন কিংবা বিজয় সরকার যেন ঠিক ততখানিই অস্পষ্ট। এ কথাটির দ্বিধাথরথর চূড়ে ইতিহাসের চিরচঞ্চল গতির সঙ্গে মিলিয়ে দিলে আমরা বুঝতে পারি যে শিক্ষিত আর রাজনীতিসচেতন ভদ্রলোকেরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁরাই ৩৬ বছর পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশভাগটি অপরিহার্য। বাঁ হাতে কার্ল মার্ক্স আর ডান হাতে গ্রামসি নিয়ে দাঁড়ালেও সাতচল্লিশ-পরবর্তী বাংলার ইতিহাস আমাকে টেনে নিয়ে যায় শাহ আবদুল করিমের দিকে, অর্থাৎ ইতিহাস আমাকে মৃত্তিকামুখী হওয়ার শিক্ষা দেয়।

আমার যুক্তি হলো, ১৯০০-৪৭ পর্যন্ত রাজনীতির ইতিহাসে আমাদের অগ্রজরা যাঁদের ‘মধ্যবিত্ত’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, আদতে তাঁরা ছিলেন অন্তর্বর্তী শ্রেণি-শিক্ষিত, শিকড়চ্যুত, ঔপনিবেশিক রুচির ভদ্রলোক কিন্তু সুযোগসন্ধানী। আর যে কৃষক, বাউল কিংবা পরবর্তী সময়ে তৈরি হওয়া বাংলার শ্রমিকশ্রেণিকে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত মানস ‘অশিক্ষিত’, ‘অন্ত্যজ’ বা ‘ব্রাত্য’ হিসেবে দেখে এসেছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরাই হলেন মধ্যবিত্ত। ঔপনিবেশিক শিক্ষাবলয়ে অন্তর্বর্তী শ্রেণির রুচি তৈরি হয় বলেই মাটির সঙ্গে তার সংযোগটি কেটে যায় তারই নিজের মুদ্রাদোষে। আর এ কারণেই শোষক তাকে অনায়াসে ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত কখনো কখনো ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও ঔপনিবেশিক রুচিতে নিজের মানস তৈরি করে না বলেই সময়ের প্রয়োজনে বিপ্লব হয়ে ওঠে তার চূড়ান্ত গন্তব্য।

এই যুক্তির ডানায় ভর করে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে ফিরে গেলে দেখতে পাই কী অনায়াসে রাজনৈতিক বিপ্লব অনূদিত হচ্ছে সাংস্কৃতিক পরিভাষায় অথবা সংস্কৃতির লেখচিত্র আঁকা হচ্ছে রাজনীতির সমীকরণে। অন্তর্বর্তী শ্রেণির কাছে রবীন্দ্রনাথ কেবলই শিল্পের অমূল্য অনুষঙ্গ, কিন্তু মধ্যবিত্তের কাছে ১৯৬১ সালের প্রতিবাদী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ সাক্ষী–বাংলার মানুষ রবীন্দ্রনাথকে লড়ে জিতে নিয়েছিলেন। ফলে গত শতাব্দীর প্রথম সাতচল্লিশটি বছরকে আমরা যদি ধরে নিই অন্তর্বর্তী শ্রেণির জয়জয়কারের যুগ হিসেবে, তবে ১৯৪৭-৭১—এই তেইশটি বছর ছিল বাংলার মধ্যবিত্তের গৌরবগাথাময় মহাকাব্য। এই তেইশ বছরে বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসেছে মধ্যবিত্ত থেকে, সাংস্কৃতিক মশাল জ্বলেছে মধ্যবিত্তের হাতে এবং সাংবাদিকতার ইতিহাস রচিত হয়েছে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের ইতিহাস, ছায়ানট থেকে উদীচী পর্যন্ত সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আর মানিক মিয়া-সিরাজুদ্দীন হোসেনের ইত্তেফাক থেকে রণেশ দাশগুপ্ত- শহীদুল্লা কায়সারের সংবাদ পত্রিকার গণমুখী ইতিহাস কার্যত বাংলার মৃত্তিকাসংলগ্ন মধ্যবিত্তের ইতিহাস।

প্রশ্ন হতে পারে, অন্তর্বর্তী শ্রেণির শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা তখন কোথায় ছিলেন? আশপাশেই ছিলেন, কিন্তু নেতৃত্বে ছিলেন না; কারণ ধর্মের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁরা যখন দেখলেন নেতৃত্ব চলে গেছে অবাঙালি মুসলমানের হাতে, তখন তাঁদের ঘুম ভাঙল বটে কিন্তু আরামের বিছানা তাঁরা ছাড়লেন না। গত শতাব্দীতে অন্তর্বর্তী শ্রেণির সবচেয়ে বিপজ্জনক আবিষ্কার ছিল ‘ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ; এর বিপরীতে মধ্যবিত্তের আবিষ্কার ছিল ‘ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ’। সুযোগসন্ধানী অন্তর্বর্তী শ্রেণি মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে পরিচালিত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বটে কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে থেকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁরা অংশ নিয়েছিলেন নানাভাবে। স্বাধীন বাংলাদেশ তাই স্বদেশিকতায় ভাস্বর মধ্যবিত্ত শ্রেণির রক্তসংগ্রামের ফসল; আমলা বা সেনাতান্ত্রিক অন্তর্বর্তী শ্রেণির নয়। এ কথা বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত জানতেন–আর জানতেন বলেই তিনি গণতন্ত্র নয়, বরং শোষিতের গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। বারবার বলেছিলেন, ‘আমার কৃষক দুর্নীতি করে না, আমার শ্রমিক দুর্নীতি করে না...দুর্নীতি করি আমরা ৫% শিক্ষিত মানুষ।’ তাঁর বক্তব্যগুলো থেকে এটুকু পরিষ্কার হয়, তিনি ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক বা সেনাতান্ত্রিক অন্তর্বর্তী শ্রেণির নেতৃত্বসর্বস্ব বাংলাদেশ গড়তে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন স্বভাষী, স্বদেশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বনির্ভর দেশ গড়তে।

ফলে আমাদের শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবীরা যে নানা গ্রন্থে লিখে গেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল বাহাত্তর সাল থেকেই, এ কথাটি আসলে সত্যের বিকৃতি। স্বাধীন দেশে শ্রেণিদ্বন্দ্ব অবশ্যই ছিল, কিন্তু সেটা মধ্যবিত্ত ও অন্তর্বর্তী শ্রেণির দ্বন্দ্ব। নিরাপদ দূরত্বে থেকে সংগ্রাম করলেও অন্তর্বর্তী শ্রেণি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল একবার মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে, নিজেদের ঔপনিবেশিক মানমর্যাদা আর থাকবে না। জনগণের পয়সায় বাংলো-ক্যান্টনমেন্ট সংস্কৃতি তারা চালাতে পারবে না। ফলে স্বাধীন দেশে হঠাৎ করেই তারা মুক্তিসংগ্রামের রাজাধিরাজ হয়ে উঠতে চাইলেন।

১৯৪৮-৭১ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যেমন হয়ে উঠেছিলেন মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ভাষ্যকার, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই আশিরনখপদে হয়ে উঠেছিলেন মধ্যবিত্তের সাংবিধানিক ভাষ্যকার। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের কণ্ঠনালিটিও কেটে দিয়েছে সুবিধাবাদী অন্তর্বর্তী শ্রেণি। এরপরের বাংলাদেশ সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র আর কালোটাকার রাজনীতিবিদদের হম্বিতম্বির বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। মুক্তিসংগ্রামের কক্ষপথে একটু একটু করে ফিরে আসছে প্রিয় স্বদেশ। কিন্তু যে দার্শনিক দার্ঢ্যতায় রচিত হয়েছিল বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, তা এখনো যেন স্বপ্নকথা, দূরের শোনা গল্প। যে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই মধ্যবিত্তের রাজনীতিই আজ ঘরছাড়া, উদ্বাস্তু। তাকে ঘরে ফেরাতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতার বর্ণপরিচয় ফিকে হয়ে যাবে, আমাদের ইতিহাসপাঠ হয়ে উঠবে কেবলই সাজানো তথ্যের তোড়া।

মারুফ রসূল: লেখক ও ব্লগার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত