খোদেজা বেগমের বয়স ৭১ বছর। চলেন হামাগুড়ি দিয়ে। নানান রোগে কাবু। মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। চিকিৎসা দূরে থাক। দুবেলা পেট পুরে খাওয়ার সুযোগও হয় না তাঁর। তবুও বয়সের ভারে ন্যুব্জ খোদেজা বেগমের কপালে জোটেনি বয়স্ক ভাতা।

তবে হ্যাঁ, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সমাজসেবা কর্মকর্তার সমবেদনা পাচ্ছেন ভূরি ভূরি। তাতে কি খোদেজা বেগমের কিছু আসে যায়? নাকি পেটে ভাত জোটে? দুর্বিষহ জীবন যাপন করা খোদেজা বেগমের বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকী ইউনিয়নের তিরঞ্চ গ্রামে। দুই সন্তানের জননী তিনি। করোনা মহামারির কারণে একমাত্র ছেলে বিল্লাহ হোসেনের উপার্জন কমে যাওয়ায় অনাহারে-অর্ধহারে দিন পার করছেন খোদেজা বেগম।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কোনো নারীর বয়স ৬১ বছর হলেও তিনি পাবেন বয়স্ক ভাতা। আর পুরুষের বয়স্ক ভাতা পেতে হলে বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৬৫ বছর। সে অনুযায়ী খোদেজা বেগম বয়স্ক ভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি পাননি। এমনকি কেউ তাঁর সহযোগিতায় এগিয়েও আসেননি।

খোদেজা বেগমের দুঃসময় শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ৪০ বছর আগে তিনি হারিয়েছেন স্বামী। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে কেটেছে দিন। বড় মেয়ে ফাতেমা বেগমকে দিয়েছেন বিবাহ। তবে মেয়ের পরিবারও সচ্ছল নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আর ছেলে বিল্লাহ হোসেন ঝাল মুড়ি বিক্রি করেন। যা উপার্জন হয় তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসার চলে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ঝাল মুড়ি বিক্রিতে পড়েছে ভাটা।

খোদেজা বেগমের প্রতিবেশী লাল চান আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে তাঁর কষ্টের সংসার। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে তিন শতাংশ স্বামীর ভিটা। তাঁর চেয়ে সচ্ছল ব্যক্তিরা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। অথচ তিনি পাচ্ছেন না। আরও আগে তো তাঁর বিধবা ভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও তিনি পাননি। বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ঝাল মুড়ি বিক্রি করে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। মায়ের চিকিৎসা করানোর মতো টাকাপয়সা নেই। মায়ের বয়স্ক ভাতার কার্ডের জন্য মেম্বারের (ইউপি সদস্য) কাছে অনেকবার গেছি। কার্ড দেওনের কথা কত কইলাম। কিন্তু কার্ড আর জুটে নাই। আমি নাকি ধনী মানুষ। তাই আমার মায়রে কার্ড কইরা দেয় না।’

খোদেজা বেগম বলেন, ‘স্বামীর রাইখা যাওয়া ২/৩ শতাংশ বাড়ি ছাড়া কোনো জমিজমাও নাই। পোলা ঝাল মুড়ি বেইচা বউ-পোলাপান নিয়া ওরই সংসার চলে না। তার ওপর আমাকে খাওনদাওন দিতে ওর ম্যালা কষ্ট হয়। স্বামী মইরা যাওয়ার পর থেইক্যা খুব কষ্টে আছি। অ্যাকটা ভাতার কার্ড পাইলে উপকার অইতো।’

তবে ফুলকী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য সাইফুল ইসলাম বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘বয়স্ক ও বিধবা ভাতার জন্য অনেকেই ছবি ও কাগজপত্র দিয়ে যান। ওই বৃদ্ধার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কেউ আসেননি। কোনো দিন চাননি। তাই হয়তো বাদ পড়েছে।’

১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সংরক্ষিত নারী সদস্য মলি আক্তার বলেন, ‘তিনি বয়স্ক, বিধবা এমনকি প্রতিবন্ধী তিন ক্যাটাগরিতে ভাতা পাওয়ার যোগ্য। আমি ওই বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে দুই দিন ছবি ও কাগজপত্র চেয়েছি। কিন্তু কিছুই দেননি।’

ফুলকী ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘তিরঞ্চ গ্রামে অনেক কার্ড দেওয়া হয়েছে। তারপরও এমন একজনের বাদ পড়া খুবই দুঃখজনক। বয়স্ক ও বিধবা ভাতার বরাদ্দ এলেই তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নুর-ই-লায়লা বলেন, ‘এমন ব্যক্তি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সুবিধা থেকে বঞ্চিত! বিষয়টি দুঃখজনক। এ বছর আর বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ এলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা করা হবে।’