ইউরোপে অভিবাসন: কপাল পুড়ছে বাংলাদেশিদের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৪, ০৮: ০৯
আপডেট : ১৮ মে ২০২৪, ০৮: ৩৪

যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অবৈধ হয়ে পড়া হাজার হাজার বাংলাদেশি অভিবাসীকে ফেরত পাঠাচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যই ফেরত পাঠাবে কমপক্ষে ১০ হাজার বাংলাদেশিকে।

ফেরত পাঠানোর কাজটি সহজ করতে যুক্তরাজ্য গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার্স–এসওপি) সই করেছে। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন গতকাল শুক্রবার বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, দুই দেশের স্বরাষ্ট্রবিষয়ক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) প্রথম সভায় এসওপি সই হয়েছে। এর আগে ১০ মে ইতালি অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর কথা জানায়। রোমানিয়ায় আটক তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশিও ফেরত আসার ঝুঁকিতে রয়েছেন। অবৈধ অভিবাসী বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই আছেন।

ব্রিটিশ অবৈধ অভিবাসনমন্ত্রী মাইকেল টমলিনসন জেডব্লিউজির বৈঠকে আলোচনার সূত্রপাত করেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা টেলিগ্রাফে গতকাল এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈঠকে ব্রিটিশ মন্ত্রী বলেছেন, অবৈধভাবে লোক আসা ও থাকা ঠেকাতে তাঁদের দ্রুত ফেরত পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ। এটিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সঙ্গে সহায়তা জোরদার করা হয়েছে।

লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বৈঠকে অবৈধ অভিবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতার’ নীতি তুলে ধরে বলেন, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী খুব কম। কারণ, এক দশকের বেশি সময় ধরে অবৈধ হয়ে পড়া অনেককে দেশে ফেরত পাঠাতে হাইকমিশন সহায়তা করে চলেছে।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে আগের এক বছরে প্রায় ১১ হাজার বাংলাদেশি পড়াশোনা, ভ্রমণ ও কর্মী ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান। তাঁদের প্রায় সবাই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন। এমন আবেদনের ৯৫ শতাংশ খারিজ করেছে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। এই ১০ হাজারের বেশি আবেদনকারীকে নতুন এসওপির আওতায় ফেরত পাঠানো যাবে।

সূত্র জানায়, ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে উভয় পক্ষ বিদ্যমান ভিসা ব্যবস্থার মাধ্যমে দক্ষ কর্মীদের জন্য বৈধ অভিবাসনের সুবিধা চালু রাখা, আইনি সহায়তা ও বন্দীদের ফেরত পাঠানো এবং গুরুতর অপরাধ মোকাবিলায় তথ্য আদান-প্রদানে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়।

চুক্তিটির আওতায় যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়ে আবেদন নাকচ হয়েছে, ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও অবস্থান করছেন এবং অপরাধের রেকর্ড আছে, এমন ব্যক্তিদের ‘বাধ্যতামূলক সাক্ষাৎকার’ ছাড়াই সহজে ফেরত পাঠাতে পারবে দেশটি।

টেলিগ্রাফ বলছে, গত এক দশকে যুক্তরাজ্যে যাওয়া প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ পাকিস্তানিরা, প্রায় ১৭ হাজার ৪০০। এরপরই বাংলাদেশ, প্রায় ১১ হাজার। ভারতীয় ৭ হাজার ৪০০। আফগানিস্তান ও নাইজেরিয়ার প্রায় ৬ হাজার করে।

যুক্তরাজ্য শুধু ২০২৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত পাঠিয়েছে, যা ২০২২ সালের চেয়ে ৭৪ শতাংশ বেশি।

যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সই হওয়া এসওপি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে বিশদ মন্তব্য করতে অপারগতা জানান অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নতুন নয় জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকৃত আশ্রয়প্রার্থী যেমন থাকেন, তেমনি ভুয়া আশ্রয়প্রার্থীও থাকেন। প্রকৃত আশ্রয়প্রার্থীরা নিজেদের আশ্রয় চাওয়ার কারণগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলেন কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। 

ইতালিও ফেরত পাঠাবে
ইতালিতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন। তাঁদের অনেকে অবৈধভাবে গিয়ে সেখানে থাকার আবেদন করেছেন। ১০ মে ইতালির পুলিশের কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ানো ম্যরিনোর বরাত দিয়ে মিলানের গণমাধ্যম স্কাই টিজি টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের প্রায় ৭৮ শতাংশকে ফেরত পাঠানো হবে। 
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই বাংলাদেশিদের সেখানে থাকার আবেদন নাকচ হচ্ছে। এ ছাড়া মিসর (৯০ শতাংশ), তিউনিসিয়া (৯০ শতাংশ), মরক্কো (৮৪ শতাংশ) ও গিনির (৬৪ শতাংশ) অভিবাসীরাও একই ঝুঁকিতে রয়েছেন।

স্থানীয় পুলিশ বলছে, ২০২২ সালের আগের ১৪ বছরে অবৈধ হয়ে পড়া অভিবাসীদের মধ্যে ৬০ শতাংশের আশ্রয় চেয়ে করা আবেদন বাতিল হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৮ শতাংশকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। 

রোমানিয়ায় আটক ৩,১৩৫
দেশে ফেরত আসার ঝুঁকিতে রয়েছেন রোমানিয়ায় আটক ৩ হাজার ১৩৫ বাংলাদেশি। কর্মী হিসেবে বৈধ ভিসা নিয়ে রোমানিয়ায় যাওয়া এই বাংলাদেশিরা ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময়ে হাঙ্গেরি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকালে আটক হন। রোমানিয়ার আরাদ কাউন্টি পুলিশের মুখপাত্র দিসনা আন্দ্রেই আলেকজান্দ্রাকে উদ্ধৃত করে ইনফোমাইগ্র্যান্টস অনলাইন এ কথা জানায়।

এর আগে এভাবে আটক অনেক বাংলাদেশিকে রোমানিয়া ফেরত পাঠিয়েছে—এমন তথ্য দিয়ে ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা বলেন, এই ৩ হাজার ১৩৫ বাংলাদেশিকেও ফেরত পাঠানো হতে পারে।

অবশ্য বুখারেস্টে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী বলেন, আটক ব্যক্তিদের ফেরত না পাঠিয়ে রোমানিয়াতেই সম্মানজনক কাজের সুযোগ দেওয়া যায় কি না, দূতাবাস সেই চেষ্টা করছে।

যুক্তরাজ্যের বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জোটভুক্ত দেশগুলোতে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার্স—এসওপি) করে ইইউ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই এসওপির আওতায় প্রতিবছর গড়ে এক হাজার থেকে দেড় হাজার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীকে ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশ ফেরত পাঠানো হচ্ছে। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত