একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্রসৈকত; ওপরে বিশাল আকাশ, নিচে সুনীল জলরাশি; পাড়ে হাজার একরের বিশাল ট্যুরিজম পার্ক। থাইল্যান্ডের পাতায়ার মতো একাধিক আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, কটেজ, বিচ ভিলা, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, ওয়াটার ভিলা, নাইট ক্লাব, কার পার্কিং, সুইমিংপুল, কনভেনশন হল, বার, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক।
বিদেশি পর্যটক টানতে ক্যাসিনোসহ সবই থাকার কথা সেখানে! তবে সবই আছে শুধু কাগজে আর পরিকল্পনায়। কবে এসব আলোর মুখ দেখবে তা কেউ জানেন না।
জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে কক্সবাজারে তিনটি বিশেষায়িত ট্যুরিজম পার্ক বা পর্যটন অঞ্চল গড়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। পার্কগুলো হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। সাবরাংয়ে প্রাথমিক কাজ চলছে। অন্য দুটির কাজ শুরু হতে না হতেই বন্ধ।
দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন অবশ্য আশা করছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সাবরাংয়ে ভূমি উন্নয়নকাজ শেষ হবে। এরপরই জমি হস্তান্তর ও অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু হবে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, ‘সাবরাংয়ের প্রাথমিক কাজ শেষ হলে নাফ ও সোনাদিয়ার কাজ শুরু করব।’ দেরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পে নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়েছি, সেগুলো সমাধানও করেছি। এলাকাবাসী, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও মিয়ানমারের আপত্তি ছিল।’
কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৮২ কিলোমিটার দূরে সাবরাংয়ে প্রস্তাবিত ট্যুরিজম পার্কের সঙ্গে যোগাযোগ মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে। নভেম্বরের শেষ দিকে মেরিন ড্রাইভের শেষ মাথায় নামতেই চোখে পড়ে বালুর ধু ধু প্রান্তর। সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ ও এক কিলোমিটার প্রস্থের প্রান্তরে একমাত্র স্থাপনা তিনতলা প্রশাসনিক ভবন। বাইরে রং লাগানো হলেও ছাদের কাজ শেষ হয়নি। বিদ্যুৎ-সংযোগ বাকি।
ভবনের দায়িত্বে থাকা বেজার সহকারী ব্যবস্থাপক মির্জা আবুজর শুভ জানান, ২০ নভেম্বর ভবনটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাজ অসমাপ্ত রেখে কীভাবে ভবন উদ্বোধন হলো জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।
বেজা জানায়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাফ ট্যুরিজম পার্ক প্রকল্পে মাটিভরাট শুরু হয়েছিল। সোনাদিয়ায় দেশের একমাত্র ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণকাজও শুরু হয়েছিল একই বছরে। দুই বছর ধরে বন্ধ দুটিরই কাজ। প্রথমে ভাবা হয়েছিল সমুদ্র থেকে বালি তুলে জমি ভরাট করা হবে। কিন্তু তাতে দেখা গেল ১৫ ফুট নিচে পাথরের শক্ত স্তর। এরপর নাফ নদীর মোহনা থেকে বালি তুলতে গেলে মিয়ানমার আপত্তি জানায়। এ নিয়ে দেনদরবার করতে করতে সব পিছিয়ে যায়।
জানা যায়, প্রথমে সাবরাংয়ে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল করার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের। কিন্তু পাঁচ বছরে তারা মহাপরিকল্পনাও করতে পারেনি। ২০১৪ সালে দায়িত্ব পায় বেজা।
সাবরাং প্রকল্পের হাল
১ হাজার ৪৭ একর ট্যুরিজম পার্কের অর্ধেক সমুদ্রসৈকত। প্রায় ৫৫০ একর ভূমির উন্নয়ন হবে। হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৫ ফুট উঁচু বাঁধ দেওয়া হয়েছে। জিও ব্যাগ দিয়ে ঢেউ ঠেকানো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা মো. আলী বলেন, ‘আগে পরিত্যক্ত জায়গা ছিল। এখন ট্যুরিজম পার্ক হওয়ায় দুইটা কাজ হইছে—পাঁচ কিলোমিটার বিচ; আবার পুরা সাবরাং ইউনিয়ন সেভ (নিরাপদ) হইছে।’
সৈকতঘেঁষা বাঁধের ওপর রাস্তা হচ্ছে। পাউবোর পুরোনো বাঁধ থেকে দক্ষিণে মাটি সমান করা হচ্ছিল। কিছু দূরে কয়েকটি এক্সকাভেটর পড়ে থাকতে দেখা যায়। সীমানাপ্রাচীর নির্মাণও শুরু হয়নি।
স্থানীয় আলী আহমদ বলেন, ‘কাজ অনেক দিন ধরে চলছে। দ্রুত শেষ হলে আমাদের জন্য ভালো হতো।’
অবকাঠামো গড়তে বাধা
অবকাঠামো তৈরির জন্য সাগরের পানি লবণমুক্ত করতে শোধনাগার হবে। সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। সেখানে থাকা বিদ্যুতের ১১ কেভি লাইনকে যথেষ্ট মনে করছেন না বিনিয়োগকারীরা। তাঁদের মতে, সবচেয়ে বড় সমস্যা নিরাপত্তার। জমির মালিকানা নিয়ে পাউবোর আপত্তিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ শুরুই হয়নি। এসব কারণে প্রস্তুতি সত্ত্বেও অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করতে পারছে না গ্রেট আউটডোর অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার লিমিটেড, গ্রিন অরচার্ড হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড এবং সানসেট বে লিমিটেড।
সানসেট বের চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ পাটোয়ারি বলেন, ‘সাবরাং পর্যটন অঞ্চলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে পাঁচ তারকা কটেজ বানাব। আমরা প্রস্তুত; কিন্তু নিরাপত্তা ছাড়া কীভাবে হবে? এ জন্য বেজার কাছে তিনটি বিষয় চেয়েছি— মিঠাপানি, উচ্চক্ষমতার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ লাইন এবং নিরাপত্তা। বেজা এসব সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে। তবে কবে নাগাদ পাব, তা নিশ্চিত করেনি।’
জমি পেল যারা
জানা যায়, স্থাপনা হবে ৩১৫ একর জমিতে। ইজারা দেওয়া হবে ২০৫ একরের মতো। এরই মধ্যে নয়টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইজারা-চুক্তি হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দপত্র দেওয়া হলেও চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য পরিশোধের পর চুক্তি হবে। প্রায় ৮১ একর জমির ইজারা-প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে।
বেজা জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টার এশিয়া গ্রুপ এবং নেদারল্যান্ডসভিত্তিক লিজার্ড স্পোর্টস সাবরাংয়ে হোটেল ও স্থাপনা বানাবে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে হোয়াইট অর্চিড গেস্টহাউস, মুনলাইট ওভারসিস, গ্রেট আউটডোর অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার, সানসেট বে, গ্রিন অরচার্ড হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস, এস এস রিসোর্টস অ্যান্ড হোটেল, ডার্ড কম্পোজিট অ্যান্ড টেক্সটাইলস, ডার্ড গার্মেন্টস, দীপ্ত গার্মেন্টস, ইফাদ মোটরস, ইস্ট-ওয়েস্ট ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, পাটওয়ারি এন্টারপ্রাইজ, বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট, বিসিএস (প্রশাসন) বহুমুখী কল্যাণ সমবায় সমিতি।
সর্বাধিক ৪০ একর জমি পেয়েছে ইন্টার এশিয়া গ্রুপ। বিসিএস (প্রশাসন) বহুমুখী কল্যাণ সমবায় সমিতি লি. ও পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট পেয়েছে ১০ একর করে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের হোটেল সেবা খাতে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। পাঁচবার সময় দেওয়া হলেও এখনো জমির মূল্যের কিছুই দেয়নি বিসিএস (প্রশাসন) বহুমুখী কল্যাণ সমবায় সমিতি।
বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাঁর একান্ত সচিব মোহাম্মদ নাজমুল আহসান জানান, বিষয়টি দেখাশোনা করছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক আবু সালেহ ফেরদৌস খান। তাঁর সঙ্গে কথা বললেই চলবে। আবু সালেহ ফেরদৌস খানের নম্বরে গতকাল সোমবার কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। সমিতির কোষাধ্যক্ষ আবুল ফজল মীরের ফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি আলমগীর হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা বিদেশি বিনোয়াগকারী খুঁজছি। করোনার কারণে সারা বিশ্বে মন্দা, তার প্রভাব পড়েছে সাবরাং প্রজেক্টেও। সে কারণে বিলম্ব হচ্ছে।’
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ‘একটি ছাড়া সবাই মোট দামের কমপক্ষে ৪ ভাগের ১ ভাগ দিয়েছে। যারা টাকা দেয়নি তাদের সময় বাড়িয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুনদের অভিজ্ঞতা না থাকলেও অন্যান্য বিষয়ে হয়তো তাদের প্রস্তাব বিনিয়োগযোগ্য মনে হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞ মত
ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পার্ক তিনটি একই এলাকায় নির্মিত না হয়ে দেশের অন্যান্য স্থানে হলে সবদিক দিয়েই ভালো হতো। কক্সবাজারে যেহেতু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করা হয়েছে, সেহেতু প্রকল্পটি দেরিতে হলেও ট্যুরিজমের জন্য অনেক ভালো হবে। তবে করোনার কারণে পুরো প্রকল্প আড়াই বছর পিছিয়ে গেছে। এখন দরকার দ্রুত কাজ শেষ করা।’